Select Language

[gtranslate]
৭ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ বুধবার ২৩শে অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

মা ও মেয়ে

কুহু ভট্টাচার্য

আজ তিথির চোখের সামনে ভেসে ওঠে অফিসে তার প্রথম দিন। বয়সটাও তার অল্প ছিল। দশম শ্রেণীতে উঠতে যখন ফেল করলো, পাড়ার এক কাকার কথায় এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে নাম লিখিয়েছিলো। তারা তিন বোন। বস্তিতে একটা ঘর আর একটু উঠোন নিয়ে থাকে নারকেলডাঙায়। বড়দির বিয়ে হয়ে গেছিল। সে, তার ছেলে মেয়ে নিয়ে ভরা সংসার সামলাতে ব্যস্ত। বাবা মারা যাবার আগে কিছুই প্রায় রেখে যেতে পারেনি। মা দুটো বাড়ি রান্নার কাজ করতো আর দিদি বস্তিরই ছোট বাচ্চাদের পড়াতো। সে নিজেও কিছু সেলাই এর কাজ করতো। এভাবেই দিন চলছিল।
দেখতে দেখতে বাবার মৃত্যুর পর পাঁচ বছর কেটে যায় তাদের।
অবশেষে একদিন, ডাক আসে এই অফিস থেকে। শিয়ালদার কাছে অফিস। পিওনের চাকরির জন্য ইন্টারভিউ হয়েছিল, তার দু মাসের মাথায় চাকরিতে যোগদানের চিঠি।
কি আনন্দ!

তার চাকরি হয়েছিল, সরকারি অফিসের পিওন পদে। প্রথম প্রথম একটু সংকোচ ছিল। বছর খানেক যাবার পর অনেকটা জড়তা কাটিয়ে উঠে সবার সঙ্গে মোটামুটি কাঠাবার্তা বলে, মিশে অনেকটা সহজ হয়েছিল, আর তার নিজের কাজও বুঝে নিয়েছিল। খাতাপত্র, ফাইল এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে নিয়ে যাওয়া, খাবার জল ভরে রাখা, এইসব কাজ তার। তার মতো আরো দুজন মেয়ে আর কিছু ছেলেও একসঙ্গে কাজ শুরু করেছিল, তার আগে ও পরেই । তাদের মধ্যে প্রণতির সঙ্গেই তার ভাব বেশি । যতীনদা , নকুলদাও বেশ ভালো।

সবাই তাকে বিয়ের কথা বলতো, ইয়ার্কি ঠাট্টা করতো। প্রণতিও তাকে বলতো বিয়ে করতে। তিথি প্রথমটায় লজ্জা পেত। তারপর অভ্যস্ত হয়ে গেছিল। সে বলতো, ঘরের অবস্থা আরও একটু ভালো হলে তারপর নিজের বিয়ে নিয়ে ভাববে। তাছাড়া তার মাও চাইতোনা
তখনই তার বিয়ে হয়ে যাক। তার সবে পঁচিশ। আরো বছর দুই পরে ভাববে। তার গায়ের রং ছিল কালো কিন্তু মুখশ্রী খুব সুন্দর। এভাবেই আরো বছর দুই পার হয়ে যায়।

নকুলদা একদিন অফিসে এসে বলল তার এক বন্ধুর কথা। সংসারে সেই বন্ধুর মা আর সে নিজে আছে। তার বোনের বিয়ে দিয়ে দিয়েছে গত বছর, এবার নিজে বিয়ে করবে, বয়স বত্রিশ, নিজের নামেই চালু কাপড়ের দোকান আছে বেলেঘাটা অঞ্চলে। তিথি মনে মনে রাঙা হয়ে উঠলো। মুখে শুধু বললো যে মা আর দিদির সঙ্গে কথা বলে জানাবে। দুদিন পর সে নকুলদা আর প্রণতিকে নিয়ে গেল তার বাড়ি, তার মা এর সঙ্গে কথা বলতে।
তিথির মা জানালো সে রাজি না। ঘরে সবাই স্তম্ভিত। তিথির মা বলতে থাকলো, “সবে আমাদের অবস্থা একটু ফিরেছে। একটু সুখের মুখ দেখেছি, একমাত্ৰ সরকারি চাকুরে মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলে চলবে কি ভাবে?”
তিথির যেন মরে যেতে ইচ্ছে করছিল। সত্যিই তো এতটা স্বার্থপর হয়ে উঠেছে সে নিজে! সে চুপ করে থাকলো। মনে মনে খুব কষ্ট পেলেও মুখে কিছুই বললো না।
নকুলদাই বললো, তার বন্ধু কোনো আপত্তিই করবে না তিথির আয়ের সবটাই যদি মাকে দিয়ে দেয়। এও বললো তারা এবিষয়ে তার বন্ধু প্রভাতের সঙ্গে দেখা করে কথা বলতে পারে। কিন্তু তিথির মা একেবারেই শুনলো না এবং চা বিস্কুট দিয়ে তাদের দুজনকেই একপ্রকার বিদায় করে দিল।এর পর তিথি দিন চারেক অফিস এলোনা।
প্রণতিই অগ্রণী হয়ে খোঁজ নিলো। তিথির বাড়ির দিকে প্রনতির বাপের বাড়ির পাড়া, একদিন তার স্বামীর সঙ্গে সে গেলো তিথির বাড়ি। জানলো তিথি, বীথি, আর তাদের বড়দি সবাই মিলে মা এর সঙ্গে ঝগড়া করেছিল, মা তাই কাউকে কিছু না বলে কোথায় চলে গিয়েছিল। দুদিন পর ফিরে এসেছিল, কিন্তু, কারুর সঙ্গে কথা বলছিল না। যাইহোক, গতকাল তিথি কথা দিয়েছে সে নিজের বিয়ের ব্যাপারে আর কিছু বলবে না, তবে গিয়ে মা সবার সঙ্গে কথা বলেছে।
পরের সোমবার থেকে যথারীতি আবার অফিসে আসতে শুরু করেছিলো তিথি।

এভাবেই পঁচিশ পেরিয়ে তিরিশ, তিরিশ পেরিয়ে চল্লিশ হয়ে চললো তিথির। তার কানে সমস্যা দেখা দিয়েছে, চোখে চশমা উঠেছে। তার উপরের দিদির চিকিৎসায় আর বড়দির ছেলে মেয়ের বায়নাক্কা মেটাতে তার বেতনের অর্ধেকের বেশী ফুরিয়ে যায়।
একদিন চুপ করে বসেছিল সে, প্রণতি আর নকুলদা কথা বলতে এসে জানলো, যে তিথির মা এক দোজবরে পাত্র জোগাড় করেছিল, কিন্তু, তিথি নিজেই রাজি হয়নি। তাই অশান্তি করছে মা বাড়িতে। খাওয়া দাওয়া না করেই সেদিন চলে এসেছিল অফিসে।

নকুলদা বললো, ” আরেক জন পাত্র আছে, বলিস তো কথা বাড়াই!” তিথি শুধু বললো ম্লান হাসি হেসে, “লোক হাসাবো এই বয়সে? তাছাড়া মা অসুস্থ, দিদিরও হার্টের রোগ ধরা পড়েছে, বড়দি তো আর তার সংসার ফেলে আসতে পারবে না, তাহলে?”
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে গিয়েছিল তিথি। তার চোখে জল।
এভাবেই আরো চার বছর পর তিথির মা মারা গেলো। তিথির সুগার ধরা পড়লো।
এখন সে প্রতিদিন অফিসে এসে কাজ কর্ম সেরে বাড়ি ফিরে যায়। দুই বোনে টিভিতে সিরিয়াল দেখে, খায় দায় আর রাত দশটা বাজলে ঘুমিয়ে পড়ে।
মায়ের মৃত্যুদিনে তার ছবিতে একটা সাদা ফুলের মালা দেয়। আর কেন যে এখনও সে কাঁদে! বোঝেনা।
একদিন নকুলদার সঙ্গে দেখা করতে অফিসে আসে তার এক বন্ধু, প্রভাত। তিথির কাছেই খোঁজ করেছিল সে। তিথি দেখলো লোকটিকে, বসতে বলে নকুলদাকে ডেকে আনে। তারা দুই বন্ধু কোথায় বেরিয়ে যায়।
তিথিকে পরে নকুলদা বলেছিল, এই প্রভাতের সঙ্গেই সে একদিন তিথির বিয়ে ঠিক করেছিল, ওর ছেলের একজন প্রাইভেট টিউটরের খোঁজে এসেছিল।
তিথি শোনে, কিন্তু কিছু বলে না। প্রণতি ওকে ডেকে নিয়ে যায় তার পিসির মেয়ের বিয়ের শাড়ি কেনার জন্য। এই একটা ব্যাপারে তিথির কোনো না নেই। শাড়ি দেখতে, কিনতে আর পছন্দ করাতে তার খুব আনন্দ।

এই ভাবেই নিত্য কত শত তিথি তাদের জীবন, যৌবন, শখ -আহ্লাদ সংসারের জন্য ত্যাগ করে চলেছে তার হিসেব ঢাকা পড়ে যায় মাদার্স ডে’র সাড়ম্বর উদযাপনের তলায়, কেউ তার খোঁজ রাখেনা।

ekhansangbad
Author: ekhansangbad

Related News

Also Read