অল্পন চট্টোপাধ্যায় :- হাজার অভাবের এক ছোট্ট রাজার রাজত্বের মা ছিলেন একজন দোরর্দন্ডপ্রতাপ রাজমহিষী |বিশাল সংসার জাহাজে ছিল অসংখ্য ক্ষুদ্র বৃহৎ ছিদ্র |কিন্তু মা ছিলেন সেই জাহাজের অভিজ্ঞ এবং নিপুণ সিদ্ধান্ত নেওয়া একজন ক্যাপ্টেন |অভাবের ফুটোফাটা সংসারে তাঁর কর্তৃত্ব ছিল অবিংসবাদী |তাকের অগুনতি মশলার কৌটোর একটা এদিক ওদিক হওয়ার জোগাড় ছিল না |রোগা – পাতলা শরীরের মা একাই বয়ে নিয়ে যেতেন সংসার তরণী |প্রয়োজন ছাড়া পাড়ে না ভেড়ানো জেদ ধরে |
কিন্তু ঠিক যতখানি সংসার মঞ্চে মায়ের দাপট ছিল ঠিক ততখানিই নিরীহ ছিলেন আমার পিতৃদেব |
মাস অন্তে মাস মাইনের পুরো টাকাটাই মায়ের হাতে তুলে নিজেই হাত পাততেন তাঁর সাধারণ হাত খরচের জন্য |
মাসের সামান্য বেতনের অর্থ তাতেই এক বিরাট সংসারের চারবেলা খাওয়া, স্কুলের বেতন, প্রাইভেট, দুধ, কাজের মাসি, লোকজন আসা যাওয়া, অনুষ্ঠান বাড়িতে উপস্থিত থাকা প্রভৃতি সামলেও মাসের শেষের দিকে হয় তো একদিন পিতৃদেবের হাতে কিছু টাকা দিয়ে বলতেন – ‘যাও, একটু বাজার থেকে ভাল মাছ নিয়ে এসো |’
তাঁর অর্থনৈতিক জ্ঞানের কাছে শিশু ছিলেন পৃথিবীর সেরা অর্থনীতিবিদরাও |
সারাদিন সংসারের হাজার কাজ |হাজার অভাব |তা সত্বেও হঠাৎ কোন একদিন বিকেলে পাড়ার কাকিমা, জেঠিমা, দিদিদের কাউকে প্রায় বগলদাবা করে নিয়ে ছুটতেন সিনেমা দেখতে |শখ বলতে ওটাই ছিল অন্যতম |কোন বিশেষ নায়ক নায়িকা তেমন পছন্দের ছিল বলে মনে হয় নি কোনদিন |যে কোন বাঙলা সিনেমাই ছিল পছন্দের |তাঁর এই সিনেমা দেখার ইচ্ছের কাছে পিতৃদেবের ওজর আপত্তি তেমন গ্রাহ্য হয় নি কোনদিন |
মাত্র ঘন্টা চারেক ছিল মায়ের সেই আনন্দ উদযাপন পর্ব |কিন্তু ওই টুকু সময়ই আমরা হয়ে পড়তাম অনাথ |হাঁ করে পিতা পুত্রের দল অপেক্ষা করতাম কখন তিনি ফেরেন |মা ছাড়া আমরা ছিলাম প্রায় টলমল |সিনেমা দেখে মা ফেরা মাত্র অকারণে উদ্বিগ্ন পিতৃদেব আচমকা খুব খুশি হয়ে চা বানিয়ে মাকে খাওয়াতেন |অভ্যস্থ এক সাধারণ সংসারে ওটাই ছিল অন্যরকমের ঘটনা |
প্রসাধন বলতে একটু সাধারণ পাউডার, আফগান স্নো |আর একমাথা চুলে নারকেল তেল |মিলিত সেই প্রসাধনীর মুখস্থ গন্ধ সারা বাড়ি মা মা করে ঘুরত |আমরা শোঁক করে শ্বাস টানলেই সেই গন্ধটা নাকে পেতাম |কোন কারণে শ্বাসে সেই গন্ধটা না এলেই বুকের ভিতরটা উথাল পাতাল করে উঠত – মা কোথায় হাঁকড়ে কেঁদে উঠত মন |মাঝে মধ্যে একজন নাপিত ঠাকুমা আসতেন |মা চা করে খাওয়াতেন |গল্প করতেন |এরই ফাঁকে মায়ের আলতা পরানোটাও হয়ে যেত |
মায়ের হাতে গোনা গোটা কয়েক শাড়ি ছিল |সেই ধরণের শাড়ি পথেঘাটে মায়ের বয়সী কাউকে পরে দেখলে মায়ের মত লাগত তাঁকে |
কুঁচি দিয়ে শাড়ি পরতে জানতেন না মা |বা হয় তো জানলেও তিনি চার সন্তানের মা তাই তাঁর ওভাবে শাড়ি পরা ঠিক হবে না বলেই পরতেন না |
নিমেষ দ্রুততায় পরতে পারতেন আটপৌরে ধাঁচের করে শাড়ি |
পিতৃদেব ছিলেন একেবারে পুত্র স্নেহ অন্ধ পিতা |মায়ের কথায় অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র | পুত্রদের কোন দোষ ত্রুটি তাঁর নজরে সেভাবে আসত না |কিন্তু সেদিক থেকে মা ছিলেন বাস্তববাদী এবং কঠোর শাসক |অবশ্য মেরেধরে শাসনের পক্ষপাতী তিনি ছিলেন না |তাঁর ছিল চার আনা হতাশা আর বারো আনা নিষ্ঠুর বাক্যবাণ মিশেল শাসন |আর তাতেই যা কাজ হওয়ার হত |
আমাদের বিরুদ্ধে বাইরের যা কিছু নালিশ সবটাই জমা হত মায়ের দরবারে |সবাই বলতেন -‘ অলার বাবাকে বলে লাভ নেই |বলার থাকলে ওর মাকে বল |ওতেই কাজ হবে |তবে প্রমাণ ছাড়া শোনা কথাতে অভিযোগ করতে যাস না |তাহলে কিন্তু ফল উল্টো হবে |’
স্কুল আর পিতৃদেবের ডিউটির কারণে আমাদের দুপুর বেলা খাওয়ার নির্দিষ্ট সময় তেমন ছিল না |আমরা রান্না ঘরে বসে চলমান রান্না আধাখ্যাচা খেয়ে স্কুল চলে যেতাম |
পিতৃদেব দিনে একবার অন্ন খেতেন |রাত্রে তাঁর খাওয়া ছিল মুড়ি আলু-ভাজা অথবা রুটি তরকারি |মা খুব চেষ্টা করতেন পিতৃদেবের দুপুরের খাবারটা পরিপাটি করে কাঁসার থালাতে সাজিয়ে দিতে |
কিন্তু নিজে কোনদিন কখনও পরিপাটি করে থালাতে নিজের খাবারটা নিয়ে খাননি |অন্তত কোনদিন দেখেছি বলে মনে আসে না |বেলা শেষে ডালের, তরকারির বাটিতে অথবা মাছের ঝোলের কড়াই এ ভাত নিয়ে মাখিয়ে খেয়ে নিতেন |সব খাবার শেষ পর্যন্ত তাঁর ভাগ্যে বোধহয় জুটত না |
মাঝে মধ্যেই মায়ের মাথায় ভীষণ ব্যথা হত |ব্যাথাতে কাবু হয়ে একদিন দুদিন শুয়ে থাকতে বাধ্য হতেন |ওষুধের দোকান থেকে মাথা ব্যথার ট্যাবলেট বা হোমিওপ্যাথি ওষুধ এনে দিতাম |না, ডাক্তার দেখানোর কথা ভাবা হত না |শুনেছিলাম নকশালি আমলে আমাদের বাড়িতে একবার ডাকাত পড়েছিল |ডাকাতের দল মায়ের সে সময়ের সবেধন সম্বল কানের দুল টেনে ছিঁড়ে নিয়েছিল |ডাকাতের দল যখন কানের দুল ধরে টেনেছিল তখন নাকি মা তাদের বাঁধা দিয়েছিল |তখন বাঁধা পাওয়া ডাকাতরা কিছু একটা দিয়ে মায়ের মাথায় আঘাত করেছিল |তাতেই মায়ের মাথায় রক্ত জমে গেছিল |সেই মুহূর্তে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে কিছু চিকিৎসা হলেও পরে আর কিছু হয় নি |ব্যথাটা তখন থেকেই সঙ্গী হয়েছিল মায়ের |আমাদের বাড়ি মোটেও ডাকাত পড়ার মত কোনদিনই ছিল না |পিতৃদেব পুলিশ ছিলেন তাই নকশালরা আমাদের বাড়ি এসেছিল পিতৃদেবের ক্ষতি করতে |আজও ভাবি কোনকারণে যদি সেদিন আমার পিতৃদেবের কিছু একটা হয়ে যেত তাহলে আমরা সবাই কোথায় ভেসে যেতাম |পিতৃদেবের চাকরি ছাড়া আমাদের আর কিছুই ছিল না |এখন যখন নকশালদের আন্দোলন সম্পর্কে নানা কথা শুনি মনে মনে ভাবি আজব আন্দোলন ওদের |সামান্য তিনশো চারশো টাকা বেতনের পেট চালানো গরীব পুলিশ ছিল ওদের আন্দোলনের শ্রেণি শত্রু!আমি নকশালদের বিষয়ে বেশ কিছু বই পড়ে দেখেছি এদের দৌড়ঝাঁপ সেই একসের চালের মধ্যেই সীমাবদ্ধ |এরা নিজেরাও গরীব যাদের ক্ষতি করে তারাও গরীব |অথচ মুখে বলে রাজ শত্রু খতম কর |যাকগে এতকথা বোধহয় না বললেও হত |কিন্তু আমার মনে কোথাও একটা খারাপ লাগা কিছু আছে এদের সম্পর্কে |
মাথার ব্যথাই একদিন শয্যাগত করে দিল মাকে |শেষের দিকে কিছু চিকিৎসা হয়েছিল |তবে আমাদের মফস্বল শহর থেকে আধুনিক চিকিৎসার কাছে পৌঁছানো তখনও সহজ ছিল না |না, আধুনিক চিকিৎসা হয় নি বলে মায়ের কোন আক্ষেপ ছিল বলে মনে হয় নি |শুয়ে থাকা অসহায় অথচ স্পষ্ট চোখের মা |
তাঁর একটাই স্পষ্ট কষ্ট ছিল, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সংসারটা তাঁর রাশে ছিল না বলে – – –