রূপা মন্ডল :- স্কুলের উঠানে অনেক ছেলের ভীড়। হেডমাস্টার মশাইয়ের ঘর ঘেরাও করেছে এরা। টিফিনের পর হেডমাস্টার মশাইয়ের ভূগোলের ক্লাস ছিল। পড়াতে পড়াতে তিনি লক্ষ্য করেন লাস্ট বেঞ্চে চারটি ছেলের মাথা একেবারে একসাথে ঠুকে যাচ্ছে প্রায়। তারা নিজেদের মধ্যে কি যেন দেখাদেখি করে হেসে গড়িয়ে পড়ছে। তিনি চিৎকার করে উঠে বললেন, “এই ছেলেরা, কি করছ ওখানে? ওঠো, উঠে দাঁড়াও বলছি।” ছেলেরা উঠে দাঁড়াল। হেডমাস্টার মশাইয়ের চিৎকার শুনে অ্যাসিস্টেন্ট হেডমাস্টার মশাইসহ অন্য আরো দু’জন মাস্টারমশাই অন্যান্য ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে এসেছেন। তল্লাশি চালিয়ে পাওয়া গেল একটা মোবাইল ফোন। তাতে কি সব ছবি দেখে ছেলেরা হাসাহাসি করছিল।
মাস্টারমশাইরা ফোনটিকে বাজেয়াপ্ত করে অফিস ঘরে নিয়ে এলেন। স্কুলে মোবাইল ফোন আনা ও ব্যবহার করা বারণ সত্ত্বেও যে ছাত্ররা এ কাজ করেছে তাদের গার্জেন কল করা হ’ল এবং শাস্তিস্বরূপ তিনদিন তাদের স্কুলে ঢুকতে দেওয়া হবে না বলে ঠিক করা হ’ল। সামনেই মাধ্যমিক পরীক্ষার টেস্ট। এই সময়ে ক্লাস না করার অর্থ অনেকটাই পিছিয়ে যাওয়া।
শাস্তি পাওয়া ছেলেরা তাই অন্য ক্লাসের ছেলেদের সঙ্গে যোগসাজস করে হেডমাস্টার মশাইয়ের ঘর ঘেরাও করল। অফিস ঘর থেকেও অন্য মাস্টারমশাইদের বেরোতে দিচ্ছে না। সারা স্কুল জুড়ে চিৎকার চেঁচামেচি সে এক বিশ্রী অবস্থা। পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে হেডমাস্টার মশাই স্থানীয় থানায় ফোন করলেন। ইতিমধ্যে ছাত্রদের মধ্যে দুটো দল হয়ে গেল। একদল মাস্টারমশাইদের শাস্তি চায়। অন্যদল চায় শুধু গার্জেন কলের শাস্তিটুকু বাতিল হোক। এর মধ্যে আবার গার্জেনদের ধরে টানাটানি কেন? শেষমেশ ওসি নিজে এসে বললেন, “আমি হেডমাস্টার মশাইয়ের সাথে আলোচনা করে দেখছি উনি কি সিদ্ধান্ত নিতে চান। তবে তোমাদের এক্ষুনি ঘেরাও তুলে নিতে হবে। নাহলে আমি সব ক’টাকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যাব।”
দমে যাওয়া ছাত্ররা একটু তফাতে সরে গিয়ে নিজেদের মধ্যে কিসব আলোচনা করতে রইল। ঠিক সেই মুহূর্তে নাটকীয়ভাবে স্থানীয় যুবনেতার সদলবলে আবির্ভাব।
-আহা, ছাত্ররা না হয় একটু দোষ করেই ফেলেছে। ওদের শাস্তি দেবেন না স্যার। আমি হেডমাস্টার মশাইয়ের সঙ্গে কথা বলে দেখছি। যাও যাও তোমরা সব বাড়ি যাও। সারাদিন পড়াশোনা করে ছেলেগুলোর মুখ একেবারে শুকিয়ে গেছে! ওদের ছেড়ে দিন স্যার।
যুবনেতার করজোড়ে অনুরোধ ওসি ফেলতে পারলেন না। অভিযুক্ত চারজনকে রেখে বাকিদের ছেড়ে দিলেন।
বাকিরা মুক্ত বিহঙ্গের মতো রাস্তা দিয়ে চলল। ঠিক তখনই ক্লাস নাইনের সৌম্য তার বন্ধু পল্লবকে বলল, “একটা দারুণ ডিপি দেখবি? এই দ্যাখ।” এই বলে নিজের পকেট থেকে মোবাইল বের করে ফেসবুক খুলল। পল্লব একটু অবাক হয়ে বলল, “তোর কাছেও মোবাইল থাকে?”
-তাতে কি হয়েছে? সাইলেন্ট মোডে রাখলেই হবে।
-দেখি দেখি ডিপিটা! আরে এতো হেব্বি দেখতে! তোর সাথে আলাপ হয়েছে?
-না। এখনও সামনাসামনি আলাপ হয় নি। তবে রোজ রাতে আমার সাথে মেসেঞ্জারে চ্যাট করে।
-মেকআপ করে আছে তো। সামনাসামনি না দেখে বোঝা যায় না কতটা সুন্দরী।
-সামনের রোববার আসতে বলব দক্ষিণেশ্বরে। বালিতে বাড়ি তো। তোকেও নিয়ে যাব সঙ্গে করে।
-কি করে চিনবি এই সেই?
-ও ঠিক চিনতে পারব। তাছাড়া ফোন নম্বর আছে। নতুন কেনা গোলাপী কুর্তিটা পড়ে আসতে বলব।
-ও বাবা এতদূর! তুই কিনে দিয়েছিস গোলাপী কুর্তি?
-আরে না না। ওর জন্মদিনে ওর বাবা কিনে দিয়েছে।
-ও তাই বল। ঠিক আছে চল রোববার দুজনে একসাথে যাব!
রবিবার দুপুরে দুই বন্ধুর আর তর সইছে না। বিকাল হওয়ার আগেই ক্রিকেট ম্যাচ খেলতে যাওয়ার নাম করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছে। সাইকেল চালিয়ে পৌঁছে গেছে মেট্রো স্টেশনের কাছে। পাশেই লোকাল ট্রেনের স্টেশন। মেয়েটা বালি থেকে ট্রেনে আসবে বলেছে। অতএব ওরা স্টেশনের সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছে।
কিন্তু সময় পাড় হয়ে যাচ্ছে দেখে দুজনেই অধৈর্য্য হয়ে পড়েছে। একটা লোকাল ট্রেন স্টেশনে এসে থামল। ওদের মুখে আশার আলো জ্বলে উঠে। কিন্তু পরক্ষণেই তা নিভে যায়। সব লোকজন হুড়হুড় করে স্টেশন ছেড়ে তাদের গন্তব্যে চলে যায়। কিন্তু সেই মেয়েটির দেখা নেই।
পল্লব সৌম্যকে বলল, “একবার মেসেঞ্জারে কোন মেসেজ পাঠিয়েছে কিনা দ্যাখ।”
সৌম্য মেসেঞ্জারে কোন মেসেজ আসে নি দেখল। তাহলে? হঠাৎ দুটো সাইকেলে সেই চারজন ছেলে যারা স্কুলে মোবাইল ফোন নিয়ে ধরা পড়েছিল ওদের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে।
-কি রে তোর প্রেমিকা এল?
বলে সৌম্যর দিকে তাকাল। সৌম্যর কান লাল হয়ে গেল। ছেলেগুলো নিজেদের মধ্যে হেসে গড়িয়ে পড়ল। তারপর সাইকেলে চেপে চলে যাওয়ার সময় বলে গেল –
-সারারাত দাঁড়িয়ে থাক। যদি আসে!
ওরা চলে যেতে পল্লব বলল, “এটা মনে হয় ওদের কাজ।বিভিন্ন মেয়ের ডিপি দিয়ে ছেলেদের ফাঁদে ফেলে মজা দেখা। দাঁড়া, ওদের শিক্ষা দিতে হবে।”
-কাকে শিক্ষা দিচ্ছিস রে?
ইতিমধ্যে লালটুদা কখন ওদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে দেখতে পায় নি।
-জিভে-টিমে যাচ্ছিস?
পল্লব আর সৌম্য দুজনে না-বাচক মাথা নাড়ল।
-কাল থেকে আমার কাছে চলে আসবি। সকালবেলা।
লালটুদা আগে ওদের স্কুলে যোগা ক্লাস করাতো। এখন একটা জিম খুলেছে।
সৌম্য হঠাৎ বলে উঠল, “লালটুদা, ঐ ছেলেগুলো যারা সাইকেলে চেপে সিটি দিতে দিতে চলে গেল ওরা স্কুলে মোবাইল ফোন থেকে নানা ধরনের ডিপি খুলে অন্যদের বিপদে ফেলছে।”
-ওরা যা করে করুক। তুই বা তোরা না করলেই হবে। তোদের বাড়ির একটা প্রেস্টিজ আছে।
আজ স্কুলে আবার হৈ হৈ কান্ড। সকাল সকাল ওসি সদলবলে এসে এসে হাজির হয়েছেন সৌম্যদের স্কুলে। খোদ ডিসির মেয়ের ফেসবুক প্রোফাইল কেউ হ্যাক করেছিল কিছুদিন আগে। তারপর তা ব্লক করে দেওয়া হয়েছিল। এখন আবার ফেক প্রোফাইল ক্রিয়েট করে কেউ অন্যদের আপত্তিকর ছবি এবং মেসেজ পাঠাচ্ছে। ট্র্যাক করে দেখা গেছে এই স্কুল থেকেই কেউ সে কান্ড ঘটিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই নজর গেছে ঐ চারটি ছেলের উপর। এবারে আর ছেলেদের বাঁচানোর জন্য যুবনেতার দেখা নেই। হেডমাস্টার মশাই চুপ করে বসে আছেন নিজের ঘরে। অন্য মাস্টারমশাইরা ছেলেগুলোকে থানায় নিয়ে যাওয়ার বিপরীতে একটু আধটু আপত্তি করেছিলেন কিন্তু আজ ওসি অত্যন্ত কড়া। কোন ওজর আপত্তি শুনছেন না। চারমূর্তির অভিভাবকরা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছেন। ওসির হাতেপায়ে ধরছেন। কিন্তু আজ আর তিনি কারো কোন অনুরোধ শুনবেন না বলেই ঠিক করে এসেছেন।
-আপনাদের ছেলেদের শোধরাবার অনেক সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আর নয়। উপর মহল থেকে কড়া নির্দেশ এসেছে। ব্যবস্থা আমাকে নিতেই হবে।
-দয়া করুন স্যার। আমাদের ছেলেদের একটু দয়া করুন!
-যা বলার থানায় গিয়ে বলবেন।
পুলিশের জিপে চারজনকে তুলে নিয়ে চলে গেল।
পিছনে পিছনে অভিভাবকরাও চললেন। একজন বললেন, “একজন ভালো ল’ইয়ার ঠিক করতে হবে।”
আর একজন বললেন, “আমার জানাশোনা একজন ভালো উকিল আছে।”
-এক্ষুনি ফোন করুন না দাদা! দেরী করবেন না।
শেষ পর্যন্ত চারজন মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পেল। কোর্টে চালান করে দিলে অনেক বড় ব্যাপার হয়ে যেত। ছাত্রদের পড়াশোনার ও ভবিষ্যৎ জীবনের ক্ষতি হয়ে যেত। তাই তাদের যথেষ্ট বকুনির পর মুচলেকাতে লিখিয়ে নেওয়া হ’ল তারা প্রাপ্ত বয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত মোবাইল ফোনে কোন ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ওপেন করতে করতে পারবে না। অন্যের ফেক ফেসবুক অ্যাকাউন্ট তৈরি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তেমন কোন কাজ তারা কক্ষনো করবে না। স্কুলে কোন অবস্থাতেই ফোন আনতে পারবে না। এছাড়া অনলাইন ক্লাস করতে হলে শুধুমাত্র মোবাইল ফোন ব্যবহার করে করতে পারবে।