Select Language

[gtranslate]
৭ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ রবিবার ২২শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

প্রয়াত হলেন ড. মৌসম মজুমদার

প্যানক্রিয়াস ক্যান্সারের সাথে দু-বছরের লড়াই থেমে গেলো,প্রয়াত হলেন বাংলার গর্ব,অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার অহংকার বিশিষ্ট মানবদরদী শিক্ষাব্রতী, গবেষক, গবেষক,লেখক, সমাজকর্মী, কুইজ মাস্টার, ‘শিক্ষারত্ন’ ড. মৌসম মজুমদার। তমলুকের সি এম এস হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর প্রয়াণ হয়। তাঁর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই শোকের ছায়া নামে গোটা অবিভক্ত মেদিনীপুর জুড়ে।বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে তাঁর মৃত্যুর খবর। সামাজিক মাধ্যমে তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে নানা পোস্ট করেন তাঁর শুভানুধ্যায়ীরা। শুভানুধ্যায়ীরা ভীড় জমান হাসপাতালের সামনে।দুপুরে তাঁর কর্ণিয়া সংগ্রহ করা হয়।তাঁর মরদেহ বাইরে বেরিয়ে এলে শ্রদ্ধা জানান বহু মানুষ। সেখান থেকে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় তাঁর কর্মস্থল বঁহিচাঁড় বিপিন শিক্ষা নিকেতনে। সেখানে শ্রদ্ধা জানান তাঁর ছাত্র-ছাত্রীরা, সহকর্মীরা ও গ্রামবাসীরা। যেখান থেকে মরদেহ নিয়ে আসা হয় আস্তাড়া গ্রামে তাঁর বাড়িতে সেখানে শ্রদ্ধা জানান তাঁর অংসখ্য গুণমুগ্ধরা,তাঁর আস্তাড়া ক্লাবের সদস্যরা,তাঁর গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠান মেদিনীপুর কুইজ কেন্দ্রের সদস্য-সদস্যারা। সেখান থেকে মরদেহ নিয়ে আসা হয় তমলুকের মানিকতলা মোড়ে। সেখানে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে ভীড় করেন গুণমুগ্ধরা। সেখান থেকে তমলুক হাসপাতালে মরনোত্তর দেহদানের উদ্দেশ্যে শুরু শেষযাত্রা। হাসপাতালে শেষযাত্রা পৌঁছালে মরদেহ তুলে দেওয়া হয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের হাতে। রেখে গেলেন স্ত্রী শিক্ষিকা সুপর্ণা মজুমদার ও দুই নাবালক কন্যা মৌপর্ণা ও সমীপর্ণাকে। রেখে গেলেন বৃদ্ধ মা ছবিরাণী মজুমদাকে।রেখে গেলেন তাঁর দুই প্রিয় সংগঠন মেদিনীপুর কুইজ কেন্দ্র ও আস্তাড়া স্পোর্টস এন্ড কালচারাল এসোসিয়েশনের সদস্য-সদস্যাদের।১৯৭৬ সালে ১লা আগষ্ট জন্মগ্রহণ করেন হিন্দ মোটরের কর্মী বিজন বিহারী মজুমদার ও গৃহবধূ ছবিরানী মজুমদারের একমাত্র পুত্র মৌসম মজুমদার। বিয়েতে যৌতুক হিসেবে পাওয়া নিজের স্ত্রীর গলার হারটা অবলীলায় অন্যকে দিয়েছিলেন বিজনবিহারী মজুমদার। আর ছবিরাণী মজুমদার প্রায়শই দিয়ে দিতেন নিজের কাপড় চোপড় সহ অন্যান্য সামগ্রী। অন্যের পাশে এভাবেই বাবা মাকে নিয়মিত ‘উড়নচণ্ডী’ হতে দেখেছেন সেই ছোটবেলা থেকেই। শুধু নিজে বাঁচা নয়, আরো অনেককে নিয়ে বাঁচার আনন্দটা কি, তা বুঝতে পেরেছিলেন তখন থেকেই। কিন্তু ‘বাপের ধনে পোদ্দারি’ করে নয়, নিজের কোমরের জোর দেখাতে অপেক্ষা করতে হয়েছিল চাকরি জীবনে প্রবেশের মুহূর্ত পর্যন্ত। তারপর আর ফিরে তাকানোর সময় ছিল না মৌসম মজুমদারের।
কুইজ। শুধু একটাই শব্দ। কখনও কখনও একটা শব্দ হয়ে উঠতে পারে ‘শব্দব্রম্ভ’। আর সেই শব্দের সাথে যখন কারোর Passion জড়িয়ে যায় আষ্টেপৃষ্ঠে, তখন তা হয়ে ওঠে তাঁর পরিচয়লিপি। হাজারো তথ্য আর হাজারো জিজ্ঞাসার রক্তমাংসের কারিকুরি নিয়েই একটা আলাদা জগত তৈরি করেছেন তিনি। আর সেখান থেকেই তাঁর জীবনের শাখাপ্রশাখা বিস্তৃত সমাজসেবা থেকে পরিবেশ সচেতনতার সোপান রচনায়।  ২৫০০ এর বেশি কুইজ প্রতিযোগিতা পরিচালনা করেছেন জাতীয় স্তর, রাজ্যস্তর, জেলাস্তর, আঞ্চলিক স্তর এবং কর্পোরেট স্তরে। এ এক বিশাল দক্ষতা। ২০১১ তে জনপ্রিয় টিভি শো “দাদাগিরি”তে রানার্স হয়েছিলেন কুইজকে আশ্রয় করেই। নিজেই সম্পাদনা করেছেন “কুইজ ডট কম” পত্রিকা। অবিভক্ত মেদিনীপুরের অন্যতম সমাজসেবী সংস্থা “মেদিনীপুর কুইজ কেন্দ্র সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি”র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক তিনিই। যে সংস্থা আজ জেলা ছাড়িয়ে রাজ্যের আর্ত দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ধৃষ্টতা দেখানোর সাহস পেয়েছে।
তিনি ড. মৌসম মজুমদার। ভূগোলের এমিথিস কিংবা মুনস্টোন। কুইজের জগতে ‘লং লেগ ছক্কা’। সমাজসেবামূলক কাজে ‘মন্দিরের দানপাত্র’। আর পরিবেশ সচেতনতার প্রসারে ‘Heritiera fomes’। স্রেফ পরিবেশ বাঁচানোর অসম লড়াইতে করে ফেলেছেন দুখানা করে সাইকেল এবং বাইক Rally। লাল কাঁকড়া বাঁচাতে চাঁদিপুর থেকে শঙ্করপুর পর্যন্ত ১০৭ কিমি কোস্টাল ট্রেকিং করেছেন। বৈচিত্র্যময় ছিল তাঁর জীবনের রঙগুলি।
প্রথমে বৈষ্ণবচক হাইস্কুল এবং তারপর কৃষ্ণগঞ্জ কৃষিশিল্প বিদ্যালয়ে পড়াকালীন সান্নিধ্য পেয়েছিলেন তিন শিক্ষক সুকুমার রায়, বানেশ্বর জানা এবং অর্ধেন্দু পড়িয়ার। কুইজের হাতেখড়ি এনারাই করে দিয়েছিলেন। এরপর ভূগোল নিয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরে দুই ক্ষেত্রেই GOLD MEDALIST হওয়ার অনন্য কৃতিত্ব অর্জন তাঁর পক্ষেই সম্ভব। আর ভূগোলে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়ার জন্য ‘লক্ষ্মীবালা সামন্ত স্মৃতি পুরস্কার’ পেয়েছেন তিনি। “জঙ্গলমহলের পরিবর্তিত পরিবেশে আদিবাসীদের জীবনযাত্রার উপর প্রভাব” শীর্ষক বিষয়ে গবেষণা করে PhD লাভ করেও কলেজ বা ইউনিভার্সিটিতে পড়াতে যাননি। স্কুলে পড়ানোর অদম্য ইচ্ছেতেই তাঁর স্বপ্ন লালিত হত দুই চোখে। ২০০০ সালে SSC পরীক্ষায় Western Zone এ প্রথম হয়ে বেছে নিয়েছিলেন তমলুক শহরের প্রান্তে এক অখ্যাত অনাড়ম্বর ‘বঁহিচাড় বিপিন শিক্ষা নিকেতন’কে। এখানকার পরিবেশ, সহকর্মী, অভিভাবক এবং ছাত্র ছাত্রীদের জন্য নিজেকে উজাড় করে দিতে চেয়েছেন বারংবার। বাবা ও দাদার নামে বিদ্যালয়ে দুটো কক্ষ বানিয়েছেন। স্থাপন করেছেন বিদ্যাসাগর ও এপিজে আবদুল কালামের মূর্তি। স্কুলের হঠাৎ অসুস্থ ছাত্র ছাত্রীদের প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য দিয়েছেন Sick Bed।

সেই ২০০১ থেকে লেখালেখিতে মনোনিবেশ। অনেকটা পথ পেরিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন জেলার তথা রাজ্যে অন্যতম লেখক। শিক্ষকতা, কুইজ, সমাজসেবা, আর লেখার সূত্রেই বহু মানুষের সান্নিধ্য লাভ করার সাথে সাথে নিজেও হয়ে উঠেছিলেন সেলিব্রেটি। ভালোবাসতেন গান শুনতে আর গাইতে। ক্যাকটাস ব্র্যাণ্ডের ৩০ বছর উপলক্ষে গায়ক সিধুর জীবনকাহিনীর বই লিখে ফেলেছেন তিনি। এ পর্যন্ত ২৭ টি টেক্সট বই, ১০ টি প্রবন্ধের বই আর ২৫ টির বেশি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য সম্পাদিত বইয়ের লেখক মৌসম মজুমদার। কর্মক্ষেত্র, আনন্দবাজার পত্রিকা, শুকতারা, নবকল্লোল সহ অসংখ্য পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে লেখা। বলা যেতেই পারে যে, “K.G. থেকে P.G.” — সব ক্লাসের বই লিখে ফেলেছেন তিনি।

একসময় বহু বেকার ছেলে মেয়েরা তাঁর লেখা Competitive Examination এর বই পড়ে SSC, PSC ও আরো নানা পরীক্ষার বৈতরণী পার হয়ে সরকারি চাকুরে হতে পেরেছে। আজ কেউ শিক্ষক, কেউ প্রফেসর, কেউ অফিসার। জেনারেল নলেজের পশরা নিয়ে বেকার শিক্ষিত ছাত্র ছাত্রীদের পাশে দাঁড়ানোর স্পর্ধা দেখানোর শক্তি দেখিয়ে তাঁদের স্বপ্নটা উস্কে দিয়েছিলেন তিনিই। শুধু মেদিনীপুর নয়, সারা রাজ্যের শিক্ষিত বেকারের চোখে তিনি হয়ে উঠেছেন “মৌসম স্যার”! পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিক্ষা দপ্তর ২০২২ এ এই শিক্ষানুরাগী শিক্ষককে দিচ্ছে মর্যাদাসম্পন্ন “শিক্ষারত্ন” পুরস্কার। যদিও এর আগেই পেয়েছেন ভারত জ্যোতি পুরস্কার (দিল্লি, ২০১৪), BEST CITIZENS OF INDIA AWARD (২০১৪), রক্তকরবী সম্মান, কচিপাতা সম্মান, BEST TEACHER AWARD ( জৈন সভা ), সকলের কথা সম্মান, উদয়ন সম্মান, গুরু সম্মান (Future Care) ইত্যাদি। নিজের কর্মতৎপরতাতেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন ‘মেদিনীপুরের মানুষ রতন’।

মৌসম মজুমদার নামটি কেবল শিক্ষকতা বা সমাজসেবাতেই আবদ্ধ নয়। তিনি জেলা তথা রাজ্যের একজন অন্যতম সংগ্রাহক। তাঁর হেফাজতে রয়েছে ৫৫০ জন সেলিব্রেটি মানুষের অটোগ্রাফ। রয়েছে ১৩১ টি দেশের মুদ্রা, ১০০ টি দেশের ২৫০০ ডাকটিকিট, ৫০ টির বেশি বিভিন্ন ধরনের হাতি, ৩৭ ধরনের শাঁখ, ৩০০ ধরনের পাথর এবং ভারতের সব উপকূলীয় এলাকার বালি! ঘরময় বই।

মৌসম মজুমদার মানেই একরাশ কর্ম তৎপরতার আঁচলা ভরা জল। রক্তদান থেকে চুলদান, দেহদান থেকে চক্ষুদান — এরকম হাজারো মহতী কাজে জড়িয়ে থাকেন বিনাবাক্যব্যায়ে। যদি সত্যিকারের ‘অনুপ্রেরণা’ নিতে হয় কারোর কাছে, তবে যাবতীয় পঙ্কিলতা, অসারতা এবং দোলাচলতা দূর করে নিঃসঙ্কোচে এবং নিঃসন্দেহে অনুসরণ, অনুকরণ এবং অনুরণন করা চলে মৌসম মজুমদারের কাজের সাথে। এতে নিজেকে আপ্লুত করা যায়। নিজেকে আবেগতাড়িত করা যায়। নিজেকে Charge করা যায়। নিত্য নতুন ভাবনার মিশেলে এক অনাবিল মনের মানুষ এই ‘রতন’টি। আমাজনের মতো দীর্ঘ তাঁর কাজের ফিরিস্তি। এভারেস্টের মতো সুউচ্চ তাঁর মানসিক প্রসারতা। আর শিশির ধোওয়া দুব্বোর মতো অন্তরের অন্তঃস্থল। এহেন মানুষটি আজ সত্যিই মেদিনীপুরের গর্ব। অসংখ্য যুবকের চলার পথের দিশারী। অনেকের কাছেই অচিরেই হয়ে উঠেছিলেন ‘আইকন পুরুষ’। তাঁর চলে যাওয়ার নক্ষত্র পতন হলো গোটা বাংলার শিক্ষা ও মানবসেবার জগতে।

ekhansangbad
Author: ekhansangbad

Related News

Also Read