শিপ্রা কাঁড়ার :- এই বুড়িটা-এই বুড়ি!তোমার মরার ইচ্ছা আছে নাকি?
রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটছো?যতসব উটকো ঝামেলা!
আর একটু হলে তো অক্কা পেয়ে যেতে বুড়ি!ধাক্কা লাগলে কোথা থেকে নিজের লোক বেড়িয়ে পরবে-ছেলে, নাতি,ভাইপো।দাবি করবে গাদাগুচ্ছের টাকা!এক বাইক আরোহীর সামনে বুড়িটা চলে আসায় সকাল সকাল এই বিপ্পত্তি।
লাঠি হাতে,কোমরে একটা বোচকা নিয়ে কোমোর নুয়ে পরা বুড়িটা ঠুকঠুক করে আপন গতিতে আবার হাঁটা শুরু করলো।
আবার একজন সাইকেল আরহীর সামনে বুড়িটা এসে পরে।সাইকেল আরোহী সাইকেল থেকে নেমে বুড়িকে বলে -ও বুড়িমা রাস্তার একধার দিয়ে যাও,না হলে ধাক্কা লেগে যাবে তো।আর একটু হলে এক্ষুনি ——
বুড়িমা তুমি যাচ্ছ কোথায়?
বুড়িটা বললো-মন্দিরের সামনে বসে ভিক্ষে করবো।
সাইকেল আরহী ছেলেটার কেমন মায়া হলো।
বুড়িটার হাত ধরে বললো-চলো বুড়িমা তোমায় পৌঁছে দিই।
বুড়িটা খুব শান্তস্বরে বললো-দরকার নেই সে একাই পারবে।
ছেলেটাও নাছরবান্দা।বুড়িটার হাতধরে মন্দিরের সামনে বসিয়ে দিলো।তারপর পকেটের এদিক ওদিক খোঁজাখুঁজি করে দশটা টাকা বুড়িটার হাতে দিয়ে বলে -এই নাও বুড়িমা।
বুড়িটা বলে -দশ টাকা লাগবে নারে বাবা,তুই আমাকে একটাকা না হয় দুটাকা দে।এই তো সকালবেলা এখনই যদি দশটাকা হয়ে যায় তো সারাদিন কি করবো?
ছেলেটা কিছু বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে বুড়িটার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।
বুড়িটা বললো আমার ত্রিশ টাকার দরকার।বলাইএর দোকানে ত্রিশটাকা দিয়ে দিই,আমার ঝামেলা শেষ।বলাই দুপুরে,কুড়িটাকার ডালভাত দেয়,আর সকাল সন্ধ্যে দশ টাকায় দু কাপ চা ঐ দেয়।বেশি টাকার দরকার কি?ও জিনিস যত কম থাকে ততই ভালো।
ছেলেটা এক মায়াময় দৃষ্টিতে বুড়িমার মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবে -ক—ত–অল্পে বুড়িমা খুশি। বুড়ি র কাছে বসে,জিঙ্গেস করে তোমার কেউ নেই বুড়িমা?
বুড়িটা সহজ ভাবে উত্তর দেয়-আছে তো আমার এক ছেলে,দু -দুটো নাতি নাতনি।
ছেলেটা ভাবে তার মায়ের কথা । কোন্ ছোটো বেলায় মাটা মরে গেল!মায়ের মুখটা আজ আর মনে করতে পারে না।অথচ যাদের মা আছে তারা —–
ছেলেটি আগ্রহ ভরে জানতে চায় তাহলে ভিক্ষে কেন করছো বুড়িমা?
ছেলে বললো-একলা উপায় করে পাঁচ পাঁচটা পেট চালাতে পারবে না।একটা কুঁড়েঘরে পাঁচজনের ঠাসাঠাসি করে শুতে হয় ।তাই একদিন ছেলে মন্দিরের সামনে বসিয়ে দিয়ে গেলো।যাবার সময় একটা বাটি আর বাটিতে একটা টাকা দিয়ে বলে গেল একটা পেট ভিক্ষে করলে চলে যাবে।সরল শিশুর মতো কথাগুলো বললো বুড়িটা।
ছেলেটা জিঙ্গেস করে এই যে এত লোক মন্দিরের ভেতরে মায়ের কাছে পূজো দিতে যাচ্ছে তোমার যেতে ইচ্ছে করে না বুড়িমা?
বুড়িটা ফোকলা দাঁতে মুচকি হাসলো।
ছেলেটা জিঙ্গেস করলো হাসছো কেন গো বুড়ি মা?
মন্দিরে তো সবাই শুধু চাইতে যায় রে আমার তো কিছু চাইবার নেই!
ধূপ,ধূনো,ফুলের গড়ে মালা,ফলমূল,কাঁসর ঘণ্টা বাজিয়ে মায়ের দমবন্ধ করার যোগাড় করে,তারপর মাকে বন্দি করে রেখে ভক্তরা চলে যায়।মা একা ঘরে পরে থাকে।
কথাগুলো বলে তোবরানো গালে এক গাল হাসলো বুড়িটা।তারপর আবার নিজেই বলতে শুরু করলো-বড়োলোকের মায়ের ও সেই এক দশা!অনেক টাকা পয়সা আছে কিন্তু ছেলে ভালো চাকরি নিয়ে ভিন দেশে চলে গেলো অতবড়ো বাড়িতে ব্যাচারি মা একা একা কাতরায়।
আমার ছেলে ছোটলোক,লেবারের কাজ করে খায়,ঘরে জায়গা হয়নি তাই নড়া ধরে এখানে বসিয়ে দিয়ে গেছে।ফোকলা দাঁতে ফিক করে হেসে বুড়িটা বলে -পৃথিবীর সব মায়েদের ঐ একই অবস্থা সন্তানের স্নেহের চৌকাঠে বন্দি!সে ঐ মন্দিরের মা হোক বা মাটির পৃথিবীর মা হোক!
এবার বুড়িটা লাঠি উঁচিয়ে বললো-তুই যা তো বাপু!তোরসাথে বকবক করতে গিয়ে আমার একটা টাকাও হলো না।
টলমল চোখে ছেলেটা বুড়িটাকে একটা প্রনাম করে চলে যাচ্ছিল, তখন বুড়িটা ছেলেটাকে বললো- একটা কথা তোর কানেকানে বলি শোন,মন্দিরে বছরে একদিন যাই।
ছেলেটা চুপিচুপি জানতে চায় কবে বুড়িমা?
আমার ছেলের জন্মদিনে।
কথাটা বলার পর মায়াময় মুখটা এক প্রসন্ন হাসিতে ভরে উঠলো।
মায়েরা বুঝি এরকমই হয়।