Select Language

[gtranslate]
২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ শুক্রবার ১৮ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

।। আশ্রয় ।।

রুমকী চক্রবর্তী :- অর্না আর রিপনের বিয়ে। সারাবাড়ি জুড়ে সবাই খুশি শুধু অর্না ছাড়া..!
অর্না একরাশ অভিমান নিয়েই পা দিলো রিপনের বাড়ি। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেই এসেছে আর ওবাড়ি ফিরবে না কোনোদিন! একদিকে সূর্য এতদিনের সম্পর্ক অস্বীকার করে ওকে ভালোবাসেনা বলে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো আরেকদিকে অর্নার বাবাও ওকে পাত্রস্থ করতে পেরেই যেন শান্তি পেলো!
সূর্য ভালোবাসেনা বলেই কী রিপনের মতোন একটা অচেনা মানুষ কে এভাবে দুম করে বিয়ে করতেই হতো ? এ আবার কোন দেশের নিয়ম !

অর্না ভেবেছিল একটা চাকরি খুঁজে নিয়ে নিজের মতোন করে বাঁচবে অথচ বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাওয়ার অজুহাতে ওকে অচেনা একটা ছেলের সাথে অন্য বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হলো.. এমনকি অর্ণার অমত পর্যন্ত কানে তোলেনি ওর বাবা! দিনরাত সূর্যের জন্যে যে অর্নার মন কাঁদে সেটা কেউ বুঝলো না..! অর্নার বাবা বিচক্ষণ আইনবিদ তাই হয়তো বাস্তবকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। অর্নাও ভেবেছে ঠিকই তো মনের খোঁজ ক’জন পুরুষই বা রাখে! আর অর্নার মা দু-একবার বুঝিয়েছেন অর্নাকে, তাছাড়া আর কী বা করবেন! নিশ্চিন্তে চোখের জল ফেলেই মা রেহাই পেয়েছে..

বিয়ের ক’দিন এদিকে একের পর এক নিয়ম দেখে আপাতত অর্নার পাগল হওয়ার জোগাড়। তার ওপর এ বাড়িতে এত লোকজনের মাঝে অর্না এক্কেবারে একা.. রিপনের সাথে বিয়ে ঠিক হওয়ার পরেও যা টুকটাক কথা হয়েছে তাতে আপন তো দূর, ঠিক করে পরিচিতও হয়ে ওঠেনি ওরা দুজনে.. তাছাড়া এত তাড়াহুড়োর বিয়েতে কতটুকুই বা সময় পেয়েছে! এখন তো থেকে থেকেই সূর্যের কথা মনে পড়ছে অর্নার.. কেন যে সূর্য ভালোবাসলো না অর্নাকে সেই ছক যেন কিছুতেই মিললো না এতদিনেও..। বিয়ের খবরও দিয়েছিল সূর্যকে কিন্তু সূর্য কিছুই বলেনি… সবদিক মিলে আর কিচ্ছু ভালোলাগছে না এখন অর্নার। এসব মনের তোলপাড় বলার মতোন আপাতত পৃথিবীতে একটা মানুষও নেই অর্ণার!

হঠাৎ রিপনের কাকিমা এসে বললেন, ‘ নতুন বৌমা র-চা খাবে ? ‘
মাথা টাও ধরেছে.. অর্নাও আপন খেয়ালে বলে ফেললো, ‘হু চা খাবো কিন্তু র-চা আমি খাইনা। দুধ চা খাবো চিনি বেশি দিয়ে।’

একটু অন্যভাবে তাকিয়ে চলে গেলেন রিপনের কাকিমা। অর্না ব্যাপারটা লক্ষ্য করেই আরও বিরক্ত হয়ে গেলো। একটু চা খেতে চেয়েছে বলে এরা এভাবে তাকালো, এমনি বাড়িতে বিয়ে দিয়েছে অর্নার বাবা! রাগে গা টা রিরি করে উঠলো অর্নার। চোখে ফেটে জল আসতে চাইলো অর্ণার…

একটু পরেই রিপনের ছোট বোন দুকাপ চা নিয়ে এলো। হাসমুখে এসে বললো, “উফ বৌদিভাই.. শান্তি! তুমিও দুধচা চিনি বেশি দিয়ে খাও? আমি কাল থেকে ওই র-চা গুলো খেয়ে যাচ্ছি। কাকিমা ভীষণ হেলথ কনসাস কাউকে একটু শান্তিতে চা খেতে দিচ্ছে না জানো তো.. অথচ দেখো বাড়ি শুদ্ধ সবাই কত রিচ খাওয়াদাওয়া করছে। চায়ের বেলায় যত নিয়ম। যেন চা খেয়েই আমরা সবাই রোগা হয়ে যাবো…” বলেই মনের আনন্দে খিলখিল করে হেসে উঠলো টিয়া। অর্নার মুখেও একচিলতে হাসি ফুটে উঠলো.. অর্নার বেশ ভালো লাগলো টিয়া কে। এখানে এসে এই প্রথম কারোর সাথে নিজে থেকে দু-একটা টুকটাক গল্প করলো অর্না। খানিক পরে খেয়াল করলো দরজার পর্দার আড়াল থেকে রিপন একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে অর্নার দিকে। রিপনকে দেখেই একটু থতমত খেয়ে অর্না চুপ হয়ে গেলো আবার।
রাতেও টিয়ার সাথে বেশ গল্প জমে গেলো অর্নার..

পরদিন নানান নিয়মের পর রাতে রিপন আর অর্নাকে সবাই একঘরে পাঠয়ে দিল। সুন্দর ফুল দিয়ে সাজানো ঘর চারদিক সুন্দর সুন্দর মোমবাতির হালকা আলো আর ফুলের সুবাসে ম-ম করছে। আলোছায়ায় চারপাশটা বেশ সুন্দর লাগছে। দরজা আটকে রিপন এসে অর্নার হাতে একটা চকলেট দিয়ে ওকে বসতে বললো বিছানায়। অর্না তবু ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো বিছানার পাশেই… কেউ যেন অর্নার পায়ে দুটো পেরেক পুঁতে দিয়েছে!

এতক্ষন এমনিও নতুন বাড়ি নতুন লোকজনের মাঝে নিজেকে কিম্ভূতকিমাকার ছাড়া আর কিছুই লাগছিল না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে কেউ একজন একটা জোরে ধাক্কা দিয়ে ওকে একটা কুঁয়োতে ফেলে দিয়েছে। এই অচেনা মানুষটার পাশে একঘরে.. এখন তো পাশেও বসতে হবে..! অর্না মনে মনে ভাবলো এখন নিশ্চয়ই ও কিছু বলতেও পারবে না কারণ তাহলেই রিপন ওকে ভুল ভাববে… চুপচাপ বসে পরা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই অর্নার..
ইতিমধ্যেই রিপন এবারে উঠে দাঁড়ালো। সামনে এসে বললো, “আপনি কোনো ভুতকে বিয়ে করেননি বিশ্বাস করুন। আপনাকে এত ভয় পেতে হবেনা। আপনি বসতেই পারেন। একটু কথা বলা যাবে তো আপনার সাথে ?”


অর্না বুঝলো এসব রিপন ঢং করেই বলছে। তবুও আর তো উপায় নেই.. এই উত্তরে কি বলবে বুঝতে না পেরে অর্না বসে পরলো চুপচাপ!
রিপন এবারে সোজাসুজি অর্নার দিকে তাকিয়ে বললো, “একটা গিফট আছে তোমার জন্যে একটু চোখ বন্ধ করো।” অর্না ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আরও বড় বড় করে তাকাতেই রিপন নিজেই হাত দিয়ে ওর চোখ বন্ধ করে দিল। তারপর হাতে একটা বড় বাক্স দিয়ে অর্নাকে চোখ দুটো খুলতে বললো.. অর্না চোখ মেলে তাকালো তারপর বাক্স টা খুলতেই অবাক হয়ে তাকালো রিপনের দিকে… বাক্স বোঝাই করে রয়েছে একগাদা বই।

অর্না বই পড়তে ভালোবাসে কিন্তু সূর্য কোনোদিন একটাও বই কিনে দেয়নি অর্নাকে। অথচ রিপন জানলোই বা কী করে…. রিপন সোনাগয়না দিলেও আজ মনটা এত খুশি হতনা অর্নার.. হঠাৎ অর্নার মন আনন্দে ভরে গেলো… বইগুলোর সাথে রয়েছে একটা কার্ড। তাতে আবার লেখা রয়েছে, “প্রথম প্রেম না হতে পারি, শেষ সাথী অবশ্যই হবো।”
এতক্ষণে প্রথম অর্নার মুখে হাসি ফুটলো এই অচেনা মানুষটার জন্যে।
অর্না মিষ্টি করে হেসে ধন্যবাদ জানাতেই রিপন হাত বাড়িয়ে বললো, “থ্যাঙ্কিউ এ কিছুই হবেনা। বন্ধু হবে তো বলো..রাগী রাগী বর হতে পারবোনা আমি। ভীষণ বিরক্তিকর হয় সেসব। বন্ধু হবে কিনা ঝটপট বলো?”
একথা শুনেই হেসে ফেললো অর্না। তারপর বললো, “বলুন তাহলে বন্ধু হতে গেলে কী করতে হবে… আর আমার ব্যাপারে কী জানতে চান?”
রিপন বললো, “কী চাও এই জীবন থেকে ?”
অর্না এবার বেশ চিন্তায় পরে গেলো। তারপর বললো, “বাব্বাহ আপনি শিক্ষক বলেই কী এত কঠিন কঠিন প্রশ্ন করতে হবে ? সোজা সোজা প্রশ্ন করুন। “
দুজনেই হেসে উঠলো। এভাবেই নানান কথা বলতে বলতেই প্রায় ভোর হয়ে এলো… রিপন মোটামুটি নিজের সম্পূর্ণ ছোটবেলার ঘটনা বলে সেরেছে একরাতেই অর্নাকে। অর্না হঠাৎ আবদারের সুরেই বললো, “ছাদে যাবেন ? ভোর হতে দেখবো..”
ক্লান্ত চোখ মুখ নিয়ে দুজনেই ছুটে গেলো ছাদে। ঠিক যেমন স্বপ্ন দেখেছিল অর্না একদিন সূর্যের সঙ্গে। নতুন সকালের আলোয় দাঁড়িয়ে রিপনকে অর্না নিজের অতীত জীবনের সমস্ত কথা বলে দিল। কিচ্ছু বাকি রাখলো না আর.. বলতে বলতেই কেঁদে ভাসিয়ে দিল অর্না। নিজেকে হালকা করে যেন ভোরের মেঘেই ভাসিয়ে দিলো অর্না… রিপন কোনো কথা না বলে অর্নার মাথায় শুধু হাত বুলিয়ে দিল। অর্না রিপনের কাঁধেই মাথা এলিয়ে দিল। বহুদিন পর আজ অর্না যেন কেঁদেও শান্তি পেলো.. রিপন ওকে বাঁধা দিলনা, শুধু শক্ত করে ওকে ধরে রইলো।
দু’জনেই আজ ভোর হতে দেখলো…তারপর রিপন ওর অর্নাকে ঘরে নিয়ে এলো। মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিল। রিপন বাড়ির কাউকে অর্নাকে ডাকতেও দেয়নি সকালে। অর্না যখন ঘুম থেকে উঠলো তখন ঘড়িতে দুপুর দেড়টা বাজে। চোখ খুলে ঘড়ির দিকে তাকাতেই অর্না লজ্জা ভয়ে একশেষ। রিপন এসেই ওকে বাইরে নিয়ে গেলো। রিপন সবার মাঝেই ওর বোন টিয়াকে বললো অর্নার জন্যে চা বানিয়ে দিতে…

ধীরে ধীরে অর্না যেন রিপনের মধ্যেই একটা আশ্রয় খুঁজে পেলো। একটা বন্ধু পেলো সাহস পেলো এগিয়ে যাওয়ার। মাঝরাতে অর্নার পড়ার সময় চা বানিয়ে রিপনের পাশে বসে থাকা অর্নার জীবনে এক নতুন মাত্রা এনে দিল..
অর্না বেশ অনেকদিন পরেই নিজে ওর বাবা কে ফোন করলো। তারপর জানিয়ে দিল ,”বাবা আমি আর রিপন কাল বাড়ি যাচ্ছি। মা কে বলবে কালকে আমার জন্যে ডিমের ঝোল রান্না করতে। আর আমি কিন্তু তোমার ওখানে সাতদিন থেকে তবে এ-বাড়ি ফিরবো..”
অর্নার বাবাও খুব খুশি হলো একথা শুনে। হাতে গুনে কয়েকবারই গেছে অর্না ওবাড়ি এর মধ্যে তাও কোনো প্রয়োজনে কিংবা নিয়মের তাগিদে। অর্নার বাবা-মা দু’জনেই তাই খুশিতে ভরে গেলো। অর্না বিয়ের পরে রিপনকে দেখেই জেনেছে একজন মানুষ অর্নাকেও নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসতে পারে। রিপনের বোনও প্রতিটা পদে বুঝিয়ে দিয়েছে অর্নাকে, বোনেরা কতটা আদরপ্রিয় হয়।

বিয়ের পর এখানে এসে অর্না দুটো বন্ধু পেয়েছে, একজন রিপন, আরেকজন রিপনের বোন অর্থাৎ অর্নার টিয়াপাখি। যারা অর্নার আজীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ।


জীবন অর্নাকে ভরিয়ে দিয়েছে। একদিন যেই অর্না একটুকরো ভালোবাসার জন্যে ছটফট করেছে আজ সেই অর্নার জীবন ভালোবাসায় কানায় কানায় পূর্ন। অর্না নিজের বিয়ের খবর খুব কাছের কয়েকজন বাদে আর কাউকেই জানায়নি সেভাবে। আজ বিয়ের প্রথম বিবাহবার্ষিকী তে ওর আর রিপনের একটা ছবি ফেসবুকে দিয়ে ক্যাপশনে লিখে দিলো “অর্নারা এভাবেই ভালো থাকে রিপনদের গল্পে কারণ রিপনদের জীবনে অর্নাদের খারাপ থাকার কোনো জায়গাই নেই.. রিপনেরা প্রতিবার অন্ধকারপুরি থেকে টেনে বের করে অর্নাদের ভালোথাকার কারণ হয়ে দাঁড়ায় এভাবেই। আর এভাবেই সত্যি হয় অর্নাদের রূপকাথারা।”

ekhansangbad
Author: ekhansangbad

Related News

Also Read