সৌমেন মিত্র :- নরেন্দ্রনাথ রামকৃষ্ণ পরমহংসের কথা প্রথম শোনেন জেনেরাল অ্যাসেম্বলি’জ ইনস্টিটিউশনে পড়ার সময়। অধ্যাপক উইলিয়াম হেস্টি একটি সাহিত্যের ক্লাসে উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের দ্য এক্সকারশন কবিতাটি পড়ানোর সময় রামকৃষ্ণ পরমহংসের কথা বলেছিলেন। উক্ত কবিতায় ব্যবহৃত ‘trance’ কথাটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি ছাত্রদের বলেন, ‘trance’ বিষয়টির সত্যিকারের অর্থ বুঝতে হলে ছাত্রদের দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে রামকৃষ্ণ পরমহংসকে দেখতে হবে। এই কথা শুনে নরেন্দ্রনাথ সহ কয়েকজন ছাত্র রামকৃষ্ণ পরমহংসকে দেখতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
১৮৮১ সালের নভেম্বর মাসে এফ. এ. পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হওয়ার সময় রামচন্দ্র দত্ত একবার নরেন্দ্রনাথকে সুরেন্দ্রনাথ মিত্রের বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানে রামকৃষ্ণ পরমহংসকে ধর্মোপদেশ দানের জন্য নিমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এই সাক্ষাতকারে রামকৃষ্ণ পরমহংস তরুণ নরেন্দ্রনাথকে একটি গান গাইতে বলেন।
নরেন্দ্রনাথ যে গানটি প্রথম শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবকে শুনিয়েছিলেন, গানটি এত মধুর ও সুন্দর, গানটি শুনে ঠাকুরের ভাবসমাধি হয়েগিয়েছিল। গানটি অযোধ্যানাথ পাকড়াশীর রচিত —
“মন চল নিজ নিকেতনে।
সংসার বিদেশে, বিদেশীর বেশে, ভ্রম কেন অকারণে॥
বিষয় পঞ্চক আর ভূতগণ, সব তোর পর কেউ নয় আপন।
পর প্রেমে কেন হইয়ে মগন, ভুলিছ আপন জনে॥
সত্যপথে মন কর আরোহণ, প্রেমের আলো জ্বালি চল অণুক্ষণ।
সঙ্গেতে সম্বল রাখ পুণ্য ধন, গোপনে অতি যতনে॥
লোভ মোহ আদি পথে দস্যুগণ, পথিকের করে সর্বস্ব মোষণ।
পরম যতনে রাখ রে প্রহরী শম দম দুই জনে॥
সাধুসঙ্গ নাম আছে পান্থধাম, শ্রান্ত হলে তথা করিও বিশ্রাম।
পথভ্রান্ত হলে সুধাইও পথ সে পান্থ-নিবাসীহলে॥
যতি দেখ পথে ভয়েরি আকার, প্রাণপণে দিও দোহাই রাজার।
সে পথে রাজার প্রবল প্রতাপ, শমন ডরে যাঁর শাসনে॥
মন চলো নিজ নিকেতনে।”
নরেন্দ্রনাথের সঙ্গীতপ্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে রামকৃষ্ণ পরমহংস তাকে দক্ষিণেশ্বরে নিমন্ত্রণ করেন।
নরেন্দ্রনাথ প্রথমবার দক্ষিণেশ্বর চলেছেন — ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সঙ্গে সাক্ষাত করার জন্য। এটি ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর দ্বিতীয় সাক্ষাত। দুই বন্ধু এবং প্রতিবেশী সুরেন্দ্রনাথ মিত্র মহাশয়ের সঙ্গে ঘোড়ার গাড়িতে দক্ষিণেশ্বরে এলো নরেন্দ্রনাথ।
এই সাক্ষাত সম্বন্ধে শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলেছেন, “পশ্চিমের দরজা দিয়া নরেন্দ্র প্রথম যেদিন এই ঘরে ঢুকিয়াছিল, দেখিলাম নিজের শরীরের দিকে লক্ষ্য নাই, মাথার চুল ও বেশভুষার কোন পারিপাট্য নাই। বাহিরের কোন পদার্থেই ইতরসাধারণের মতো একটা আঁট নাই; সবই যেন আলগা এবং চক্ষু দেখিয়া মনে হইল তাহার মনের অনেকটা ভিতরের দিকে কে যেন সর্বদা টানিয়া রাখিয়াছে। দেখিয়া মনে হইল, বিষয়ী লোকের আবাস কলিকাতায় এতবড় সত্ত্বগুণী আধার থাকাও সম্ভব ?”
নরেন্দ্রনাথকে দেখে ঠাকুরের খুশী ধরে না। এদিনও ঠাকুর তাঁকে গান শোনাতে বললেন।
নরেন্দ্রনাথ এদিন ঠাকুরকে দুটি গান শুনিয়েছিলেন।
প্রথম গানটি নরেন্দ্রনাথ গাইলেন —
“মন চল নিজ নিকেতনে।
সংসার বিদেশে, বিদেশীর বেশে, ভ্রম কেন অকারণে॥
….. মন চলো নিজ নিকেতনে।”
‘কই, আর একখানা গা’ — বললেন ঠাকুর।
নরেন্দ্রনাথ আবার গান ধরলো, গানটি বেচারাম চট্টোপাধ্যায় রচিত —
“যাবে কি হে দিন আমার বিফলে চলিয়ে।
আছি নাথ দিবানিশি আশাপথ নিরখিয়ে॥
তুমি ত্রিভুবন নাথ, আমি ভিখারি অনাথ।
কেমনে বলিব তোমায় এস হে মম হৃদয়ে॥
হৃদয়-কুটীর-দ্বার, খুলে রাখি আনিবার।
কৃপা করি একবার এসে কি জুড়াবে হিয়ে॥”
গান শুনে ভাবে বিভোর ঠাকুর, হঠাৎ চমকিয়ে উঠে নরেন্দ্রনাথের হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন উত্তরের বারান্দার ঘরে। বন্ধ হলো বাইরের দরজা। মুখোমুখি বসলেন দুজনে।
ঠাকুরের চোখ জলে ভেসে যাচ্ছে, কেঁদে কেঁদে বলছেন, “তোর কি মায়া দয়া নেই ? কোথায় ছিলি এতদিন ? দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর চেয়ে আছি তোর পথ পানে। কি করে আমায় ভুলে ছিলি ?”
“সেদিন মাঝরাতে তুই এলি আমার ঘরে, আমায় ঘুম থেকে টেনে তুললি। বললি, আমি এলাম….”
ঠাকুরের কথা শুনে চমকে উঠলো নরেন্দ্রনাথ।
এই সাক্ষাত নরেন্দ্রনাথের জীবনে একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। সাক্ষাৎকারের প্রসঙ্গে নরেন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “তাহাকে [রামকৃষ্ণ] একজন সাধারণ লোকের মতো বোধ হইল, কিছু অসাধারণত্ব দেখিলাম না। অতি সরল ভাষায় তিনি কথা কহিতেছিলেন, আমি ভাবিলাম, এ ব্যক্তি কি একজন বড় ধর্মাচার্য হইতে পারেন ? আমি সারা জীবন অপরকে যাহা জিজ্ঞাসা করিয়াছি, তাহার নিকটে গিয়া তাহাকেও সেই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলাম,
‘মহাশয়, আপনি কি ঈশ্বর বিশ্বাস করেন ?’
তিনি উত্তর দিলেন — ‘হাঁ।’
‘মহাশয়, আপনি কি তাহার অস্তিত্বের প্রমাণ দিতে পারেন ?’
‘হাঁ’।
‘কি প্রমাণ ?’
‘আমি তোমাকে যেমন আমার সম্মুখে দেখিতেছি, তাহাকেও ঠিক সেইরূপ দেখি, বরং আরও স্পষ্টতর, আরও উজ্জ্বলতররূপে দেখি।’
আমি একেবারে মুগ্ধ হইলাম।”