দোলা ভট্টাচার্য্য :- বর্ষায় আবার প্রেম! ছ্যঃ। এমন স্যাঁতসেতে ভিজে ভিজে দিনে আবার প্রেম জমে নাকী! অনেকেই বলবেন একথা। আমার কিন্তু বর্ষায় ভিজে ভিজে প্রেম করতে বেশ লাগে।
ধ্যাৎ। তেমন ভাবে প্রেম আর করা হল কোথায়। কলেজ শেষ হতে না হতেই বিয়ে। বরটি আমার বেশ ভারিক্কি গোছের। একে মাষ্টার মশাই ।তার ওপরে কেমিস্ট্রি র মতো সাবজেক্ট তার দখলে। নামে রসায়ন হলেও রসকষের চিহ্ন মাত্র নাই। তাই প্রেমও নাই। বয়সে আমার থেকে বেশ খানিকটা বড় হবার সুবাদে তিনি আমারও মাস্টার মশাই হয়ে বসলেন। কি করব! সদ্য বাইশের দূরন্ত যৌবন আমার। পায়ে দিলেন নুপুরের বেড়ি পরিয়ে।
বর্ষার প্রথম বৃষ্টি মেখে গায়ে, সেদিন ঘুরছিলাম তিন তলার ছাদে। টের পেয়ে শাশুড়ি মা মহা খাপ্পা। শিগ্গির নেমে এসো, জ্বরে পড়বে। না, না আমি এখন নামব না ছাদ থেকে। আমি এখন ভিজব। “অঝোর ঝরন শ্রাবণ জলে /তিমিরমেদুর বনাঞ্চলে /ফুটুক সোনার কদম্বফুল নিবিড় হর্ষণে।” অবশেষে তিনি এলেন। কিন্তু এ কিভাবে এলেন। এ যে বঙ্কিম বাবুর চন্দ্রশেখর! উনিও কি আমাকে শৈবলীনি ভাবছেন! গায়ে টাওয়েল জড়িয়ে দিয়ে নির্দেশ দিলেন নেমে যেতে। সোনার কদম্বফুল তো ফুটল না। প্রেম কই?ঘরে এসে ভাবতে বসলাম, আমার জীবনে তো কোনো প্রতাপ আসেনি। অগত্যা, প্রেম ভিক্ষা করতে হবে এই চন্দ্রশেখরের কাছেই।
বিয়ের দ্বিতীয় বছর। মে মাস। গরমের ছুটিতে হানিমুন। এই প্রথম দুজনে একলা কোথাও যাবার সুযোগ পেলাম। আসাম, শিলং। বর্ষার প্রাক মূহুর্তে রূপসী আসামের রূপে মুগ্ধ আমি। দূর পাহাড়ের মাথায় মেঘেদের আনাগোনা। এমনটা আগে আর দেখিনি।
চলে আসার আগের দিন,নীলাচল পাহাড়ের কোলে কামাখ্যা মন্দির দেখে নেমে এলাম। এরপর ব্রহ্মপুত্র পেরিয়ে যাব উমানন্দ আশ্রম । সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হল পাহাড়ের ওপরে। অসাধারণ সৌন্দর্য এই জায়গাটার। শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ।
উমানন্দ আশ্রম থেকে ফেরার পথে নামল বৃষ্টি। সিঁড়ি দিয়ে খুব সাবধানে নেমে এলাম নিচে টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। ঘাটে এসে দাঁড়ালাম। একটাই নৌকো ছিল। আমাদের সাথে যে লোকগুলো এসেছিল , তারা পুজো দিয়েই নেমে এসেছিল । আগের নৌকোয় ফিরে গিয়েছে তারা । আমাদের আসতে দেরি হয়েছে। এরপর খেয়া পারাপার বন্ধ হয়ে যাবে। আবহাওয়া খারাপ হয়ে আসছে। আমরা বিপদে পড়েছি দেখে. মাঝি দুজন রাজি হল আমাদের পার করে দিতে। কিন্তু বেশি পয়সা দিয়ে বুক করতে হল নৌকো টা। আমরাও নৌকোয় উঠে পড়লাম। শুধুই আমরা দুজন। বেশ খানিকটা এগিয়ে আসার পর তুমুল বৃষ্টি নামল। উতলা হয়ে উঠেছে ব্রহ্মপুত্র। সজল বাতাসে কেঁপে উঠে আরও কাছে ঘেঁষে বসলাম মানুষটার। সবল দুটি বাহুর ডোরে বাঁধা পড়ে ওর বুকে মাথা রাখলাম। অভয় দিল মাঝি, ভয় নেই গো মা জননী। তোমাদের দুটিকে ঠিক পাড়ে পৌঁছে দেব। দুই বাহুতে জড়িয়ে রেখেছে আমাকে আমার প্রিয় মানুষটা। এ তো সেই চিরন্তন প্রেমের পরশ। “এই তোমারি পরশরাগে চিত্ত হল রঞ্জিত, /এই তোমারি মিলন সুধা রইলো প্রাণে সঞ্চিত” । বর্ষার অঝোর ধারায় ভিজে যেতে যেতে এই প্রথম অনুভব করলাম, আমি যে নিজে ভেসে গিয়ে তাকেও ভাসাতে পেরেছি এই প্রেমজোয়ারে। ব্রহ্মপুত্রের ঢেউএর দোলায় দুলতে দুলতে দুলিয়ে দিয়েছি রসায়নবিদের বেরসিক হৃদয় খানি ।পাড়ে উঠে দেখি ঘাটের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে ফুলে ভরা এক কদম ফুলের গাছ। সোনার কদম তাহলে সত্যিই ফোটাতে পেরেছি।