Select Language

[gtranslate]
৮ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ বুধবার ২২শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

।। নতুন ঠিকানায় ।।

চন্দ্রানী মিত্র বোস :- কফির কাপ রেখে যেতে যেতে ফিরে তাকালো ঐন্দ্রিলা ডোডোর দিকে,অয়নের দিকে আরো সরে যেতে যেতে একটু জোরে বলে উঠলো সে,”এখন আমার স্টাডি টাইম নয় মাম্মা ,আমি এখন পাপাই এর সাথে খেলছি তুমি প্লিস ডিস্টার্ব কোরো না আমাদের।”
উদাস আজকাল হয়না ঐন্দ্রিলা মন খারাপ করেও লাভ কি !

মাত্র কয়েক বছর আগে কলেজে তাকে একবার দেখার জন্য অনেকের মাঝে অয়নও যে ছিল ভাবতে গেলে অবিশ্বাস্য লাগে তার,কত দিন পার্লারে যায় নি সে,নিজের ম্যানিকিউর করা নখগুলো এখন কেমন যেন বিবর্ণ রংহীন হয়ে গেছে! এত সে বদলে গেলো কেন !

ঐন্দ্রিলা এই একবছর ধরে সম্পর্কটা জাস্ট টেনে নিয়ে চলেছে, সিঁথের ওই মিলিয়ে যাওয়া সিঁদুরের মতো কখন যেন হারিয়ে গেছে তাদের ভালোবাসার রেশটুকু।আসলে মানিয়ে নেওয়ার মধ্যে মেনে নেওয়াও থাকে কোথাও না কোথাও লুকিয়ে !

পায়ে পায়ে নিজের ঘরে কখন যেন এসে পড়েছিল সে,দক্ষিণের বিশাল বারান্দায় একটা মস্ত বড় টেরাকোটা বুদ্ধের পাশে এসে দাঁড়ালো নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্লেসমেন্ট অধিকারী ম্যাডাম ঐন্দ্রিলা সেনগুপ্ত,চোখে যার সব সময় কিছু নতুন স্বপ্ন সাজানো থাকে,স্টুডেন্টরা আড়ালে যাকে পাইলট নাম দিয়েছে,জানে সে একথা আর এটাও জানে ভালোবেসে তাদের মধ্যেই কেউ কেউ এসে জানিয়ে গেছে তাকে একথা !

এখন আর ভাবতে অন্য কিছু ভালো লাগে না তার ,অন্যকিছু মানে নিজের জন্য !শুধু নিজের জন্য কিছু ভাবতে গেলে ভিড় করে আসে অয়নের চোখ দুটো,যাতে ধীরে ধীরে ভালোবাসা হারিয়ে কখন যেন একগাদা ঘৃণা আর অবহেলা বাসা বেঁধেছে ,

চমকে ফিরে তাকালো ঐন্দ্রিলা,পায়ের আওয়াজ পায়নি আগে শুধু উগ্র সিগারেটের গন্ধ ওর পুরো শরীর মনে উত্তপ্ত ছোঁয়া দিলো ,ঠিক বৈশাখের রোদের মত,না চাইতেও বলে উঠলো “কিছু কি বলা বাকি আছে!”

অবহেলায় ফিরে তাকালো অয়ন”ব্যাঙ্ক আর দুটো ফ্ল্যাটের পেপার সমস্ত রেখে দিয়েছি হলঘরের কাবার্ডে ,আর কিছু থাকলে পাঠিয়ে দেবো”

চলে গেলো সে,একটু পরেই ডোডো এসে গম্ভীর মুখে বসে পড়লো সোফা ঘেঁষা ডাবল বেডের কোণে,হাতে ধরা ট্যাবে চলছে ভিডিও গেম তখন না দেখেই বুঝে গেলো ঐন্দ্রিলা।

তারমানে অয়ন চলে গেছে কোথাও,হয়তো কোনো কাজে কিংবা নিজের নতুন ফ্ল্যাটে,

অসহিষ্ণু গলা কানে এলো ডোডোর”কেন মাম্মা তুমি পাপাকে যেতে দিলে আর যদি পাপা গেলোই তো আমাকে কেন যেতে দিলে না!”

কান্না নয় কিন্তু দশ বছরের ডোডো হঠাৎ কেমন যেন ছোট্ট হয়ে গেলো,সেই ছোট বেলায় পাপা ট্যুরে গেলে এমনটাই জল ভরা চোখে দেখতো ওকে,আধো আধো গলায় তখনো এমনটা জেদ করতো সে,কেন আমায় যেতে দিলে না পাপার সাথে !

চিন্তার রেখা পড়লো,না চাইতেও ঐন্দ্রিলার কপালের মাঝে, ও তো জানে না ওর পাপা আর কোনোদিন থাকবে না ওদের সাথে ,ও তো জানে না আজ নয় কাল সে চলে যাবে একেবারে আর মাসে একবার বা দুবার দেখা হবে তাদের,কি করে বোঝাবে ওকে ওর পাপার জীবনে এখন ওর মাম্মার আর কোন জায়গা নেই !

ফিরলো অয়ন একটু পরেই আর এসেই ছেলেকে নিয়ে স্টাডিতে ঢুকলো দড়াম করে দরজা বন্ধ করে,কি ভেবে দরজা হালকা নক করে ঢুকলো ঐন্দ্রিলা।

ফোনটা বেজে উঠলো ,অন্যমনস্ক ঐন্দ্রিলা দেখলো একবার,অ্যাডভোকেট মিস্টার সেনের ফোন ।কাল থেকে দুবার ফোন করেছেন কিন্তু অয়নকে বলা হয়নি,উইকেন্ড হলে ছেলে আর বাবা একেবারে এক মুহূর্ত কেউ কাউকে ছাড়ে না আসলে কিন্তু উপায় কি বলতে এবার তাকে হবেই !

ফটাফট মেসেজ টাইপ করে ফরওয়ার্ড করলো সে ,টুং টাং আওয়াজ শুনেই ডোডো বলে উঠলো”পাপাই তুমি কিন্তু প্রমিস করেছো আজ পুরো দিন আমার সাথে কাটাবে,নো ফোন কলস, নো হোয়াটসআপ মনে আছে তো”

রুম থেকে বেরোতে বেরোতে আরেকবার মেসেজটা সেন্ড করে ব্যালকনির দিকে এগিয়ে গেলো ঐন্দ্রিলা ,বিকেল পাচঁটায় চেম্বারে ডেকেছেন মিস্টার সেন ।

নিজের রুমে এসে দরজাটা ভেজিয়ে বারান্দায় আবার এসে দাঁড়ালো সে ,

কিছু তো ভাবতে হবে ডোডোকে নিয়ে কারণ আর একমাস পরেই ওর ফাইনাল এক্সাম ,ওর পাপাই ছাড়া ও পারবে তো ওকে ঠিকঠাক রাখতে ! কে জানে !

হঠাৎ মনে হলো ,মাম্মাকে ডেকে নিলে কেমন হয় ,মা ওর সাথে থাকলে ও পারবে হয়তো ডোডোকে সামলে নিতে।

মাকে ফোন মিলিয়ে আবার কি ভেবে কেটে দিলো ,অয়ন অফিস চলে গেলে তবেই কথা বলতে পারবে সে ঠিক করে, মাথার চুলে অন্যমনস্ক হাত বুলিয়ে ঘরে ফিরে এলো ঐন্দ্রিলা ,

এখন অনেক কাজ ,সামনে দেখলো অয়ন দাঁড়িয়ে !

“কিছু বলবে !”

মাথা নাড়লো অয়ন,

“কি সব ড্রামা শুরু করেছো !বুঝতে পারছো না ,না কি জেনেও না বোঝার ভান এটা তোমার !”

তাকালো ঐন্দ্রিলা একবার অয়নের চোখের দিকে,রাত জাগা ক্লান্তি বাসা বেঁধেছে ওর দুচোখের কোলে,

আচ্ছা ও কি এখনো বৈশালীর সাথে সময় কাটায় না কি আরো অন্য কেউ !ডিভোর্সটা হলে ওরা হয়তো নতুন ফ্ল্যাটে শিফট করে যাবে।এই ফ্ল্যাটটা ওর নামে না হলে এখন ডোডো আর মাকে নিয়ে ও যে কোথায় যেত!

টুং করে মেসেজ ঢুকলো অয়নের ফোনে ,একটু রাগত গলায় বলে উঠলো অয়ন”একটু বাঁচতে দাও আমাকে প্লিস আর আমি পারছি না”চলে গেলো সে ।

ডিভোর্সটা হয়ে গেছে ওদের বেশ কিছুদিন হলো,এই রবিবার অয়ন আসবে ডোডোর সাথে দেখা করতে প্রথমবার বাড়ি ছাড়ার পর।

নীল মার্সিডিজটা ঢুকলো যখন তখন বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যে নামছে এই ষষ্ঠী ব্যানার্জী লেনের সব আকাশ ছোঁয়া বাড়ি গুলোর ছাদ ছুঁয়ে ছুঁয়ে।একটু আগেই ডোডোকে দেখেছে ঐন্দ্রিলা নিজের আঁকার ছোট্ট ক্যানভাসের সামনে দাঁড়িয়ে কিছু আঁকছে ।

ওদের বাবা ছেলের মাঝে থাকবে না বলেই নিজের গানের খাতা নিয়ে আজ অনেক বছর পরে নিজের ঘরের এক কোণায় বসলো সে,তানপুরা আর হারমোনিয়ামের পাশে রাখা গীতবিতান তুলতে গিয়ে হাতটা কেমন কেঁপে গেলো তার ,বিয়ের পরে প্রথম জন্মদিনে উপহার দিয়েছিল অয়ন সোনালী অক্ষরে লেখা “আমার ভালোবাসা”

অন্যমনস্ক পাতা ওল্টাতে লাগলো ,আচ্ছা ডোডো যাবার জন্য জেদ করছে না তো !কে জানে কান্নাকাটি করছে কি না !

হঠাৎ হাতের স্পর্শে ফিরে তাকালো ঐন্দ্রিলা,ডোডো দাঁড়িয়ে জলভরা চোখে !এই বুঝি বলে উঠবে সে “কেন আমাকে যেতে দিলে না মা পাপাই এর সাথে কিংবা পাপাই এখানে আর কেন থাকে না মা “

কিন্তু না আরো কাছে সরে এসে দাঁড়ালো ডোডো”আজ রাতে আমাকে একটা গল্প বলবে মাম্মা !”একটা কাগজ এগিয়ে দিলো ডোডো নিজের মাম্মার দিকে আর হঠাৎ কেমন ছোট্ট হয়ে গিয়ে বুকে মুখ লুকোলো।

অবাক ঐন্দ্রিলার হাত থেকে গীতবিতান পড়ে যাবার আগেই সামলে নিলো ডোডো “পাপাই আমাকেও ভালোবাসে না মাম্মা ,ভালোবাসলে কি ছেড়ে যেতে পারতো !”

ছেলের মাথায় হাত বোলালো ঐন্দ্রিলা একেবারে সেই ওর জন্মের পর যেমন করে বুকে চেপে ধরেছিলো ,

কিছু হারিয়ে কিছু পাওয়ার নামই হয়তো জীবন ,খুব ফিসফিস করে বললো “ভালোবাসে পাপাই তোমাকে অনেক এখনো শুধু এখন ভালোবাসা ঠিকানা বদলে ফেলেছে”

নামলো রাত আরো ধীরে জানলার কাঁচ পেরিয়ে এই ফ্ল্যাটের আনাচে কানাচে কিছু সম্পর্কের ইতি বা পুনশ্চঃ কথা লিখতে লিখতে ডোডোর আঁকা কাগজের টুকরো ছুঁয়ে…যেখানে এক মায়ের কোলে তার ছেলে বসে আছে আর একটা নীল গাড়ি গেট পেরিয়ে চলে যাচ্ছে দূরে ,অনেক দূরে ঠিকানা বদলে কোনো নতুন ঠিকানায় ..কোনো নতুন ভালো -বাসায় ..

ekhansangbad
Author: ekhansangbad

Related News

Also Read