শাশ্বতী রায় :- একমনে কম্পিউটারে হিসাব কষছিলাম। অবনীদার ডাকে মুখ তুললাম।
– এই শাড়িটা বিল হবে।
সবুজ বর্ডার দেওয়া গাঢ় হলুদ সিল্ক শাড়িটা কাউন্টারে রেখে চলে গেল অবনীদা। অবনী কিশোর মজুমদার। মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোকটি এই দোকানের প্রাণ বলা যায়। মিষ্টি কথায় অনায়াসে এরকম ক্যাটকেটে লাল,হলুদ রঙ কাস্টমারদের গছিয়ে দেন। আজ আবার কে মুরগী হল দেখতে গিয়ে যেন ইলেকট্রিক শক খেলাম। ভীড় ঠেলে কাউন্টারের দিকে হেলেদুলে যিনি এগিয়ে আসছেন, তিনি আমার বড্ড পরিচিত। এক ছাদের তলায় আট মাস বারো দিন কাটিয়েছি তার সাথে। আমার শাশুড়িমা। থুড়ি প্রাক্তন শাশুড়িমা। জানি না মা শব্দটা জোড়া উচিত হচ্ছে কিনা। ভদ্রমহিলা সামনে এসে গেছেন একেবারে। মুখটা কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে ঘুরিয়ে বিল করায় মন দিলাম।
সম্ভবত মানিব্যাগ বের করতে গিয়ে উনি খেয়াল করেননি আমায়। ঠাণ্ডা স্বরে বললাম
– দু হাজার তিনশো নব্বই। ক্যাশ না কার্ড?
চেনা স্বরে ভদ্রমহিলা চমকে তাকালেন।
– তুমি!
উত্তর দেবার প্রয়োজন বোধ করলাম না। উনি আবার প্রশ্ন করলেন
– তুমি এই দোকানে কাজ করো?
মাথা কাজ করছে না আমার। কোনোমতে উত্তর দিলাম,
– হ্যাঁ।
আমার পাশে পরপর শাড়ি জমা পড়ছে বিলের জন্য। ওনার পিছনেও সাত আটজনের লাইন পড়ে গেছে। বাধ্য হয়ে বললাম
– প্লিজ একটু তাড়াতাড়ি করুন। অনেকে অপেক্ষা করছেন।
– হ্যাঁ হ্যাঁ। নিশ্চয়ই।
পাঁচটা পাঁচশো টাকার নোট এগিয়ে দিলেন উনি। বাকি টাকাটা ফেরত দিয়ে পরের কাস্টমারের দিকে মন দিলাম। পাশে না তাকিয়েও বুঝতে পারছিলাম উনি দাঁড়িয়ে আছেন। মিনিট পনেরো পর কাউন্টার খালি হল। অবাক হয়ে দেখলাম উনি তখনও দাঁড়িয়ে। আর অভদ্রতা করতে পারলাম না।
অরূপকে কিছুক্ষণের জন্য কাউন্টার সামলাতে বলে বেড়িয়ে এলাম।
– কিছু বলবেন?
– হ্যাঁ, মানে তোমার কি একটু সময় হবে? বাইরে কোথাও বসতাম তাহলে।
– এখন?
ঘড়ির দিকে দেখলাম পৌনে তিনটে। আজ কাজের চাপে লাঞ্চ হয়নি আমার। সেই অজুহাতে বাইরে যাওয়াই যায়। তাছাড়া ওনার কি বলার আছে সেটা জানারও কৌতুহল হচ্ছিল। বললাম
– একটু দাঁড়ান। চেষ্টা করছি।
অবনীদাকে বলে বেরিয়ে এলাম ওনার সাথে। উল্টো দিকের ফুটপাথেই ছোটখাটো রেস্তোরাঁ আছে একটা। সেখানেই এসে বসলাম। লাঞ্চের সময় পেরিয়ে গেছে তাই একটা দুটো টেবিল ছাড়া তেমন লোকজন নেই। ভালোই হল। এই মহিলা তো আবার সীন ক্রিয়েট করতে ওস্তাদ।
ফাঁকা জায়গা দেখে বসলাম দুজনে। মেনু কার্ড নিয়ে ওয়েটারও হাজির। জিজ্ঞাসা করলাম
– কি খাবেন?
– কিছু না। এই অসময়ে খাই না কিছু।
– কিছু না নিয়ে তো বসতে দেবে না। তাছাড়া আমার আজ খাওয়া হয়নি।
ভদ্রমহিলা যেন ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
– সেকি এত বেলা অবধি না খেয়ে আছ। পিত্তি পড়বে যে।
মনে মনে হাসলাম। এই খেয়ালটা তখন রাখলে সবকিছু অন্যরকম হতো হয়তো। মুখে বললাম
– আমি তো খাবই। আপনি অন্তত এক কাপ চা নিন।
উনি ঘাড় নাড়তেই অর্ডারটা দিয়ে দিলাম। কেমন অবাক চোখে আমাকে দেখছেন উনি।
– তুমি কিন্তু অনেক রোগা হয়ে গেছ।
– তাই!
– তাই তো দেখছি। কাজের চাপে নাকি?
– হবে হয়তো।
– আর বাড়িতে সবাই ভালো? বাবা,মা?
ওনার এই ভনিতা অসহ্য লাগছিল। বলে ফেললাম
– আপনি কিছু বলবেন বলছিলেন।
আমার কড়া সুরে উনি সামান্য থতমত খেলেন
– হুম বলছি।
কোলে রাখা শাড়ির বাক্সটা অকারণেই নাড়াচাড়া করলেন একটুক্ষণ। তারপর বললেন
– শাড়িটা কেমন ?
– কোন শাড়ি?
– যেটা নিলাম।
চোখের সামনে সবুজ, হলুদের ঝলকানি দেখলাম যেন। হেসে বললাম
– ওহ, ভালো তো। বেশ ভালো।
– কার জন্য কিনলাম জানো?
– কি করে জানব বলুন? আমি তো জ্যোতিষী নই। আপনার জন্য কেনেননি এটা বলতে পারি।
ছোট্ট একটা শ্বাস ফেললেন উনি।
– খোকনের আশীর্বাদ রবিবার। এটা ওর…
নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো আমার। রণজয় তাহলে আবার বিয়ের পিঁড়িতে বসতে রাজি হয়েছে। শেষ দিনও তো বলেছিল আমায় ছাড়া কারুর সঙ্গে থাকার কথা ভাবতে পারে না ও। সবই তাহলে মুখের কথা। আর আমি পাগল, কিছুক্ষণ আগেও ভাবতাম পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকি না কেন, আমরা দুজন নিজেদের জীবনে অন্য কাউকে আসতে দেব না। সব ভুলে গেছে রণজয়। ভুলে যাওয়া এতই সহজ যখন আমি কেন ভুলতে পারিনা? কেন আজও আমার প্রতিটা রোমকূপ ওর নামে শিহরিত হয়!
– কিছু বলবে না?
মাথার ডান দিকটা দপদপ করছে। মাইগ্রেনের ব্যথাটা বোধহয় আবার ফিরে আসছে। ভদ্রমহিলা উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন। কি উত্তর দেব একে। সব কিছু শেষ হয়ে যাবার মূলে তো ইনিই। বিয়ের পরের একটা দিনও মনে করতে পারিনা যেদিন একটু শান্তিতে থেকেছি। রোজ কিছু না কিছু নিয়ে অশান্তি হত। প্রথম দিকে রণ পরিস্থিতি সামাল দেবার চেষ্টা করলেও পরে সেও মাকেই সমর্থন করেছিল। আমাকে বলত অ্যাডজাস্ট করতে। সে চেষ্টাও করেছিলাম। কিন্তু ভদ্রমহিলার যেন জেদ চেপে গেছিল, ছেলের ভালোবাসার মানুষকে যেভাবে হোক দূরে সরিয়ে দেবার। অন্যমনস্ক মুখে বললাম,
– ভালোই তো। পুরোনোকে আঁকড়ে কতদিন বসে থাকে মানুষ।
– থাকে না বুঝি? তুমি নেই?
পুষে রাখা রাগটা আবার ফিরে আসছিল।
– আপনি কি এসব বলার জন্য আমায় ডেকে নিয়ে এলেন? তাহলে বলি, আপনার ছেলের কোনো ব্যাপারে আমার আর কোনো আগ্রহ নেই। যেদিন ডিভোর্স পেপারে সই করেছি সেদিনই সব মুছে ফেলেছি মন থেকে।
– এটা তোমার রাগের কথা। আমি জানি আজও তুমি ওকে…
কথার মাঝেই ওনাকে থামাতে বাধ্য হলাম।
– আপনার ধারণা তো আমি বদলাতে পারব না। তবে এটাই সত্যি।
ভদ্রমহিলা যেন একটু হতাশ হলেন। আরো একটু খোঁচা দেবার জন্য বললাম।
– তা এবার নিজে পছন্দ করে মেয়ে আনছেন তো?
দুদিকে মাথা নাড়লেন উনি।
– নাহ্, খোকনের কলিগের বোন। ওরাই উদ্যোগ নিয়ে সব করছে।
– বাহ, খুব ভালো।
– আসলে তুমি চলে যাবার পর থেকে ছেলেটা কেমন যেন বাউন্ডুলে হয়ে যাচ্ছিল। খাওয়া,পরা কোনদিকে কোনো খেয়াল ছিল না। অফিসও রোজ যেত না শুনেছি।
চকিতে একটা দিনের কথা মনে পড়ে গেল আমার। গত বছরের মহালয়া। বাড়ির সবার জন্য কেনাকাটায় বেড়িয়েছিলাম। বালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে দেখেছিলাম রণকে। উদাস মুখে সিগারেটে টান দিচ্ছিল। উস্কোখুস্কো চুল, দাড়িতে বড্ড দুঃখী লেগেছিল মানুষটাকে। খুব ইচ্ছে করেছিল একবার কথা বলতে। পরমুহূর্তেই বিয়ের পরের একের পর এক দৃশ্য চোখের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। আবারও পাঁচিল তুলে দিয়েছিল আমার আর রণর মাঝে।
ওয়েটার খাবারের ট্রে হাতে এসে গেছে। টেবিলের ওপর রাখা আমার মোবাইলটা তুলে নিলাম। খাবার রেখে চলে গেছে ছেলেটি। অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে ছোট্ট টেবিলটাকে ঘিরে। কেউই খাবারে মন দিতে পারছিলাম না। কি মনে হতে জিজ্ঞাসা করে ফেললাম,
– এতদিন পরে ছেলের নিঃসঙ্গতা দূর হতে চলেছে তবু আপনাকে এত উদাস দেখাচ্ছে যে?
– যেমন আছি তেমনই দেখছ।
– সেকি কেন?
– তোমার এখন বয়স কম। তুমি ঠিক বুঝবে না। আসলে পুরোনোকে বদলে ফেলার পরই হয়তো আমরা তার কদর করতে শিখি।
– সত্যিই বুঝলাম না।
ভদ্রমহিলা চায়ের কাপটা হাতে তুলেও নামিয়ে রাখলেন। অদ্ভুত আকুতির স্বরে বলে উঠলেন
– বিশ্বাস করো, তোমার সাথে দেখা হবার আগের মুহূর্ত অবধি কথাটা মনে হয়নি। এখন মনে হচ্ছে তোমাকে অনুরোধ করি।
গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল আমার
– কি অনুরোধ?
– তুমি ফিরে এসো তন্দ্রা। খোকন তোমায় একবার দেখলে কিছুতেই এ বিয়ে করবে না।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম ওনার দিকে। নাহ্, অভিনয়ের ছিঁটেফোঁটাও নেই গোটা মুখে। ক্ষোভের বদলে ভাঙাচোরা মুখখানা দেখলে মায়াই হচ্ছে। তবুও যে কেন পুরনো অপমানগুলো জ্বালা ধরায়।
মুচকি হেসে বললাম
– সে সময় রণ আমায় ভালোবাসতো সেটা আপনি মেনে নিতে পারেননি। আর আজ আমাকে মেনে নিচ্ছেন রণর নতুন সম্পর্কটা গড়ে উঠতে দেবেন না বলে।
– তা নয় তন্দ্রা। তোমার সাথে রুশার তুলনা করে বুঝেছি তুমিই খোকনের যোগ্য সঙ্গী ছিলে।
অবাক হয়ে দেখছিলাম ওনাকে। আমার সদ্য সেরে ওঠা হৃদয়টা আজ আবার ক্ষতবিক্ষত করে কি লাভ হচ্ছে ওনার? নিজের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।
– সত্যি আজও বুঝে উঠতে পারলাম না আপনি কি চান। এবারটা অন্তত ছেলেকে নিজের মত করে সুখী হতে দিন প্লিজ। আপনি তো সারাজীবন ওকে পাহারা দিয়ে রাখতে পারবেন না।
উনি কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। তার আগেই ফোন বেজে উঠেছে আমার। দাদার বন্ধু কৌশিকদার ফোন। রোজ ঠিক এই সময় আসে ফোনটা।
– একটু পরে কথা বলছি।
বলে রেখে দিলাম ফোনটা।
অন্যদিন হলে বিরক্ত হতাম। কিন্তু আজ এই কলটাই এক ঝলক টাটকা বাতাস বয়ে নিয়ে এলো। রণজয়ের বিয়ের খবরে মনের কোণে যেটুকু মেঘ জমেছিল, এক নিমেষে সরে গেল যেন। একজন অন্তত আছে যাকে একবার ডাকলেই সাড়া পাওয়া যায়। ফুরফুরে মেজাজে ওনাকে বললাম
– আমার উড বির ফোন ছিল। অপেক্ষা করছে আমার জন্য। রণকে বলবেন ওর নতুন জীবনের জন্য আমার তরফ থেকে অনেক শুভেচ্ছা। আসি তাহলে। ভালো থাকবেন।
ভদ্রমহিলাকে আর একটা কথা বলারও সুযোগ না দিয়ে,বিল মিটিয়ে বেরিয়ে এলাম রেস্তোরাঁ থেকে। কৌশিকদাকে নিয়ে মিথ্যেটা বলে একটু খারাপ লাগছিল। ভদ্রমহিলার মুখটা শুকিয়ে এইটুকু হয়ে গেছিল। তবে আশ্চর্য মানুষ উনি। নিজের হাতে সম্পর্কটার মৃত্যু ঘটিয়ে আজ সেই প্রাক্তন বৌমাকেই নতুন করে ঘরে তুলতে চাইছেন। সন্তানের ওপর অধিকারবোধ কোথায় গিয়ে পৌঁছালে এমন ছেলেমানুষী করতে পারে মানুষ! একা মনেই হেসে ফেললাম। হাসতে হাসতে কখন যেন চোখে জল এসে গেল আমার। রণ সত্যিই ভুলে গেল আমায়। আমিই বা কেন স্মৃতি আঁকড়ে পড়ে আছি।
ব্যাগের মধ্যে ফোনের সুরেলা ধ্বনি। আবারও কৌশিকদা। নিজের প্রতিশ্রুতির কথা ভেবে বারবার এড়িয়ে গেছি কৌশিকদাকে। তবে আজ আর কোনো দ্বিধা নেই। ওড়নায় চোখ মুছে, ফোনটা রিসিভ করলাম
– বলো।
– কি ব্যাপার গলাটা এরকম শোনাচ্ছে কেন?
– এমনি
– বললেই হল। গলা শুনেই বোঝা যাচ্ছে কিছু একটা সমস্যা হয়েছে।
জোর করে হাসার চেষ্টা করলাম
– বললাম তো কিছু না।
– তুমি কি কাঁদছিলে তনু? সামান্য গলা নামালো কৌশিকদা। রণজয়ের সাথে দেখা হয়েছিল?
বুকটা মুচড়ে উঠলো আমার। কৌশিকদাই একমাত্র মানুষ যার কাছে কোনোদিন রণজয়কে নিয়ে কোনো গোপনীয়তা অবলম্বন করতে হয়নি আমায়। নির্দ্বিধায় আমার সব যন্ত্রণার কথা বলতে পেরেছি। আমার জীবনে রণজয়ের জায়গাটা বুঝেও অভিমান করে সরে যায়নি মানুষটা।
কোনমতে বললাম
– আজ একবার দেখা করতে পারো?
কৌশিকদার স্বরে উচ্ছ্বাস।
– আজ তো রেড লেটার ডে। দেবী নিজে দর্শন দিতে চাইছেন। কখন,কোথায় জাস্ট বলো। বান্দা হাজির হয়ে যাবে।
ফোনটা রেখে রাস্তা পার হচ্ছিলাম। অল্প অল্প বৃষ্টি হচ্ছে আজ। ধোঁয়া ধোঁয়া রাস্তায় কোত্থেকে যেন ভেসে উঠল রণর মুখখানা। আবার মিলিয়েও গেল। সেখানে এখন অন্য কারুর মুখ। যার সাথে আমি বাকি পথটুকু নিশ্চিন্তে চলতে পারি। সুখী হোক রণজয়। ভালো থাকুক ওর মাও। অতীতকে ভুলে এগোনোর জন্য ওদের ক্ষমা করে দেওয়াটা আজ বড্ড জরুরী।