শুভ্রা পাল :- শিবানী দেবী গ্রামের মানুষ ….গ্রামেই তার জন্ম গ্রামেই তার বিয়ে । কোনোদিনও শহর কেমন বা শহরের মানুষের ঘর বাড়ি কেমন বা তারা কেমন ভাবে জীবন যাপন করে এসব স্বচক্ষে দেখা হয়নি শিবানী দেবীর । আত্মীয় স্বজন সব এই গ্রাম ওই গ্রাম করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে …. ঘোরা বেড়ানো বলতে ওই একবার রাজুর বাবার সঙ্গে বর্ধমানের একশো আট শিব মন্দির গিয়েছিলেন তাও প্রায় বছর কুড়ি পার হয়ে গেছে !!
রাজু তখন ঐ বছর বারো হবে !! গ্রামের ভেতরে অবশ্য অনেক ঘুরেছে শিবানী দেবী । কত রকম মেলা বসে গ্রামের ভেতর ….পুজো পার্বণ তো লেগেই থাকে আর সেই সঙ্গে মেলা কীর্তন আবার মাঝে মাঝেই তো লতা কণ্ঠী কিশোর কণ্ঠী গায়ক গায়িকারা মেলার মঞ্চে সারা রাত গান গেয়ে গ্রামের মানুষ কে মাতিয়ে রাখে ।
এসব করেই তো দিব্যি জীবনের পঞ্চাশ টা বছর পার করে ফেললেন শিবানী দেবী । জীবনে কখনো আক্ষেপ করেন নি …. যেনো সব কিছুই পেয়েছেন তিনি জীবন থেকে । ভালো বাবা মা থেকে ভালো শ্বশুর শ্বাশুড়ী সঙ্গে শিবনাথ এর মত স্বামী । গ্রামের মানুষের চাহিদা হয়তো খুব বেশি নয় ও। তারা অল্পতেই নিজেদের খুশি রাখতেও পারে ! যা আছে যতটুকু আছে তাই তাদের কাছে অনেক ! অন্তত শিবানী দেবী এভাবেই থেকেছেন এবং ওনার কখনো মনে হয়নি যে তিনি জীবনে কিছু পান নি ।
শিবানী দেবীর ছেলে অনেক পড়াশোনা করে বর্তমানে কলকাতার একটা বড়ো অফিসের বড়ো বাবু । কলকাতাতেই থাকে । মাঝে মাঝে আসে বাবা মায়ের সঙ্গে দেখা করতে । শিবানী দেবী সব সময় চেয়েছিলেন তার ছেলে একজন নামী দামী মানুষ হয়ে উঠুক । তাই ছেলে কে ছোট থেকেই বাইরে মিশনে পড়তে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন । নিজেরা অশিক্ষিত হলেও ছেলের পড়াশোনার জন্য যা কিছু প্রয়োজন পড়েছে সব কিছু তাঁরা করেছেন । মনে আশার বাঁধ বেঁধেছেন ।
মাঝে মাঝেই ছেলের সঙ্গে শিবনাথ বাবু গিয়ে গিয়ে দেখা করে আসতেন…. কিন্তু শিবানী দেবী কখনো ছেলেকে দেখতে যেতেন না …. স্বামী কে বোঝাতেন মা কে দেখলে ছেলে কান্নাকাটি করতে শুরু করে দেবে …. তারপর ওনারও আরও বেশি মন খারাপ হবে ছেলের জন্য । তা ছাড়া শিবানী দেবী এটাও ভাবতেন ছেলের বাবা তো দেখে আসছে… তার চোখ দিয়েই না হয় ছেলেকে দেখে নেবে । তাই ছেলে ছুটিতে বাড়ি ফিরলে তবেই মায়ের সঙ্গে দেখা হতো ।
আসলে শিবানী দেবীর ভয় লাগতো ট্রেনে চাপতে …. কিন্তু সে কথা কখনো কাউকে বলতে লজ্জা পেতেন তিনি । সেই ভয়েই শহরে গিয়ে ছেলের সঙ্গে দেখা করা হতো না । আর তাছাড়া তিনি শুনেছেন শহরের রাস্তায় নাকি হাঁটা চলা করা যায় না …. এত গাড়ি !!! বাবা শুনলেই ভয় লাগে ! নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে গ্রামের চৌহদ্দির মধ্যে এভাবেই জীবনের পঞ্চাশটা বছর কাটিয়ে ফেলেছেন শিবানী দেবী ।
শিবানী দেবীর একমাত্র ছেলে রাজু বিয়ে করেছে তাও বছর পাঁচেক হয়ে গেলো।
। নিজেই পছন্দ করে বিয়ে করেছে তারই সঙ্গে একই অফিসে কাজ করা পিয়াস কে । বিয়েটা হয়েছিল গ্রামের বাড়ি থেকেই । কিন্তু সপ্তাহ খানেক ও পার হয়নি রাজু আর পিয়াস ফিরে গিয়েছিল কলকাতায় ।
রাজু নতুন ফ্ল্যাট কিনেছে …. বেশ বড়ো সরো ফ্ল্যাট। স্বামী স্ত্রী মিলে বেশ সুন্দর করে সাজিয়েছে ফ্ল্যাট টা। দামী আসবাব পত্র থেকে দামী শো পিস এক একটা জিনিষ পিয়াসের পছন্দের । সে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে কাঠের মিস্ত্রির পিছনে পড়ে থেকে বাড়ির আসবাব পত্র তৈরি করিয়েছে ।
রান্না ঘরটাও তার পছন্দ মতই সাজিয়ে নিয়েছে পিয়াস । অত্যাধুনিক রান্নাঘর টুকু তার খুব ই পছন্দের ।
ঠাকুরের সিংহাসন টা কিছুদিন হলো করিয়েছে …. লক্ষী গণেশ স্থাপন করেছে ঠাকুর মশাই ডেকে ।
রাজুর বাড়ির গৃহ প্রবেশে তার মা আসেনি । মায়ের শরীরটা তখন ভালো ছিল না । বাবা এসেছিল । রাজু বাবা কে বারবার বলেছিল …. আমার কাছে তোমাদের নিয়ে চলে আসবো এবার । সেই জন্যই তো এত বড় ফ্ল্যাট কেনা । কিন্তু বাবা রাজি হয়নি । শিবনাথ বাবুর যেনো অত বড় ফ্ল্যাটেও দমবন্ধ হয়ে আসছিল । বার বার ঘরের বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন … তাতে পিয়াসের অবশ্য বেশ বিরক্ত লাগছিলো…. চেনা জানা নেই এরকম হুট পাট রাস্তায় বেরিয়ে যাওয়া টা মোটেই ভালো লাগছিলো না পিয়াসের !!! তার ওপর আবার ওই বিড়ির গন্ধ …. সহ্যই হচ্ছিল না তার !!
হঠাৎ একদিন রাজু তার মা কে গাড়ি করে নিয়ে চলে এলো নিজের বাড়ি । বাবা কিছুতেই সঙ্গে আসতে রাজি হলো না । শিবানী দেবী ছেলের উন্নতি নিজের চোখে দেখতে এই প্রথম শহরে এলেন তাও নিজেরই ছেলের বাড়িতে । ছেলের ঘর দেখে অবাক হয়ে গেলেন । ভাবলেন…..ঘর ?!!! ….নাকি স্বর্গ !! এত সুন্দর !!! কত রকম সব জিনিস …. কি সুন্দর রান্নাঘর ….ঠাকুরের সিংহাসন !! সব কিছু দেখে তাঁর মনে খুব খুশি হলো । খুশি হয়ে ছেলেকে বললেন– এরকম আলমারি শহরেই পাওয়া যায় না রে ? আমাদের গ্রামে এসব পাওয়া যাবে না ?! পুরো দেয়াল জোড়া আলমারি …. খুব সুন্দর । ছেলের ঘরে যা কিছু দেখতে লাগলেন সব কিছুই বেশ সুন্দর মনে হলো শিবানী দেবীর । ছেলে কে বলেই ফেললেন …. আমার রান্না ঘরটা এরকম করিয়ে দিবি বাবু । কত সুন্দর গোছানো !!
ছেলে বললো …. —-এটাই তো তোমার রান্নাঘর মা …. গ্রামের রান্নাঘরে আর ফিরতে হবে না তোমাকে ! বাবাও ঠিক একদিন এখানে থাকার জন্য রাজি হয়ে যাবে …তুমি এখানে থাকলে বাবাও ঠিক একদিন এখানে চলে আসবে ।
শিবানী দেবীর চোখে জল চলে আসলো ছেলের কথায় ।
নিজের মনে করে শিবানী দেবী রান্নাঘরে ঢুকে একটু নিজের মতো করে রান্না করলেন ছেলে বৌমার জন্য …. ঠাকুর পুজো করলেন মন দিয়ে …. মন যেনো ভরে গেলো !!!
ছেলে বৌমা ফিরলে শিবানী দেবী আনন্দ করে তাদের খেতে দিলেন নিজের করা রান্না …. ছেলে তৃপ্তি করে খেলেও পিয়াস একটু খেয়েই রেখে দিল !! শিবানী দেবী দেখলেন পিয়াস গম্ভীর মুখে রান্নাঘর মুছে পরিষ্কার করতে গেলো যা তিনি রান্নার পরেই মুছে পরিষ্কার করেছিলেন !! হয়তো একটু অগোছালো হয়ে ছিল বা হয়তো পরিষ্কার টা ঠিক করে হয়নি !! তিনি বুঝলেন এই রান্নাঘর তাঁর নিজের কখনোই নয় !!
শিবানী দেবী রাজুর কাছে বললেন …. —বাবু তোরা খুব সুন্দর করে নিজেদের সংসার সাজিয়েছিস …. আমি এরকম তো কখনো ভাবতেই পারিনি । গ্রামের মানুষ তো তাই এতদিন চারদিকে ফেলে ছড়িয়েই সংসার করেছি । এত সুন্দর গোছানো সংসারে আমি আর তোর বাবা বড্ডবেশি বেমানান । আমরা গ্রামের মানুষ ওখানেই আমরা সঠিক মান পাই ! এই শহুরে জীবন আমাদের জন্য নয় । আমি কাল ই ফিরে যাবো বাড়ি । না জানি তোর বাবা কি খেয়ে দিন কাটাচ্ছে !!
—-কিন্তু মা … কাল তো আমি ছুটি নিতে পারবো না ! রবিবারের আগে তো সময় হবে না আমার । এই কটা দিন থেকে যাও অন্তত …. বাবা ঠিক যা হোক করে নিয়ে খাবে ।
—না রে …. বড্ড মন টানছে বাড়িটার জন্য । তুই কাল আমাকে ট্রেন এ তুলে দিতে পারবি ?
—হ্যাঁ … সেটা পারবো ।
—-তাহলে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়বো । বাড়ি ফিরে একটু রান্না করতে পারবো তবু ।
ট্রেন এ চেপে শিবানী দেবী বাড়ি ফিরলেন …. বাড়ি ফেরার প্রবল ইচ্ছার কাছে ট্রেনে চাপার ভয়টা যেনো কেটে গেলো কখন !
ফিরে নিজের শ্বাশুড়ির আমলের রান্নাঘরে ঢুকে দুটো ডাল ভাত ফুটিয়ে নিলেন তাড়াতাড়ি । নিজের মানুষটা কে থালায় ভাত টুকু বেড়ে দিয়ে নিজেও কিছুটা বেড়ে নিলেন । তারপর নিজেদের বুকের ভেতরে জমা অভিমান গুলো চেপে রেখে হাসি মুখে ছেলের ঘরের সুখের গল্প করতে করতে দুটো মানুষ তৃপ্তি করে খেয়ে মন ভরালেন ।