সুমনা চ্যাটার্জী :- পরপর দুটি মেয়ে হয়েছিল কালীচরণ দাসের। দ্বিতীয়টির জন্মের সময় বেশ মুষড়ে পড়েছিলেন তিনি। স্ত্রীকে বলেছিলেন আর একটি সন্তানের কথা। বউ বেশ তেজী তার। বলেছিল, “কেন গো? ভগবান কি তোমাকে লেখাপড়া করে দিয়েছেন নাকি যে তিন নম্বর বাচ্চা হলেই ছেলে হবে!”
কালীদের পরিবারে এমন স্পষ্টবক্তা বউ আগে কখনও আসেনি। প্রত্যেকেই বেশ সম্ভ্রম করে চলে তাকে। কাজে কাজেই আরও একটি সন্তানের বাবা হবার চিন্তা সে মন থেকে মুছে ফেলেছিল।
কালীর বউয়ের আরও একটি দাবি ছিল। মেয়েদেরই যথাযোগ্য মর্যাদায় মানুষ করে তুলতে হবে। মেয়ে বলে মোটেই হেলা ফেলা করা চলবে না তাদের। বই, খাতা কলম, মাস্টার কোনদিকেই যেন কোনো অভাব না থাকে। মানে যতটুকু তাদের পক্ষে সম্ভব আর কি!
কিন্তু বড় মেয়েটি তেমন হল না। কোনক্রমে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করল সে। লেখাপড়ায় তেমন মন নেই দেখে কালী তার বিয়ে দিয়ে দিল।
আর ছোটটি! সে একেবারে তার মায়ের সুযোগ্য কন্যা। ভীষণ জেদী আর একরোখা। মাধ্যমিক পাশ করেই সে বায়না জুড়ল যে সে বাপের কাছে ড্রাইভিং শিখবে। কোনো কাজ কি ফেলনা নাকি? বাপ্ যেকালে এই বিদ্যাটা জানে তাই তাকে এটা শিখতেই হবে। বাবাকে শিক্ষা গুরু হিসেবে পাশে পাবার এই তো সুযোগ।
ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে বি এ পড়ছে নন্দা। ওর বাবা মায়ের ওকে নিয়ে অনেক আশা। কিন্তু বিধি বাম। কিডনিতে সমস্যা দেখা দিল কালীর। সে বুঝতে পারল, বাস চালানো তার পক্ষে অসম্ভব। মালিকও তাকে বসিয়ে দেবার কথা চিন্তা করলেন। এদিকে চিকিৎসার জন্য তার অনেক টাকার প্রয়োজন। নন্দা বলল, আমি চালাবো। ছুটিছাটায় সে বাবার পাশে বসে একটু আধটু চালিয়েছে। লাইসেন্সও আছে।
কালী তার মালিকের কাছে কথাটা পাড়ল। ভদ্রলোক রাজি হলেন। বললেন, “প্রথম প্রথম কিছুদিন তুমি ওর পাশে থেকো।”
প্যান্ট শার্ট পরে বাস চালাতো নন্দা। চুল তার ছেলেবেলা থেকেই বয় কাট। শক্ত সমর্থ শরীর তার। তাই পেছন থেকে দেখে বোঝার উপায় ছিল না যে সে ছেলে না মেয়ে। এমন নয় যে সে ছেলে সাজবার ইচ্ছে থেকে এমনটা পরত। আসলে সে এভাবে স্বচ্ছন্দ বোধ করত।
কিন্তু সেদিন তার চুড়িদার পরতে সাধ হল। সঙ্গে দুটো চুড়ি যেটা তাকে তার জামাইবাবু কিনে দিয়েছিল।
ট্র্যাফিক জ্যামে আটকে বাস থামালো নন্দা। সামনে গাড়ির লাইন দেখে চাবি ঘুরিয়ে ইঞ্জিনটা বন্ধ করল। তারপর যেই নামতে যাবে ওমনি শুনল এক যাত্রী টোন কাটছে; “চুড়ি পরে বাস চালাচ্ছে রে আনারকলি!” তারপর এমন করে হেসে উঠল গা পিত্তি জ্বলে গেল নন্দার।
ঘুরে তাকিয়ে দৃপ্ত কণ্ঠে বলল, “That’s not your lookout” , কোন যুগে বাস করেন আপনি? মেয়েরা প্লেন চালাচ্ছে, মহাকাশ পাড়ি দিচ্ছে…. চোস্ত ইংরেজিতে আচ্ছা করে ঝাড় দিল নন্দা।
সবাই বলল, দে লোকটার ঘাড় ধরে নামিয়ে। নন্দা বাধা দিল।
সেদিন বাসে একজন শিক্ষকও ছিলেন। মেয়েটির অনমনীয় ভঙ্গিটি ভারি ভালো লাগল তার। বাবাকে এসে বললেন সবটা। “আচ্ছা বাবা, ওকে যদি বৌমা করে নিয়ে আসি তোমার।” তার বাবাও একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। অত্যন্ত উদারমনস্ক। মুখে অনেকেই সেসব কথা বলে। কাজে দেখায় কজন। বাবাকে চুপ করে থাকতে দেখে সুমনের মনে হল, একজন বাস ড্রাইভারকে বৌমা হিসেবে মেনে নিতে সুনীলবাবু দ্বিধাবোধ করছেন। এদিকে সুমনের পক্ষে তার বাবার অনুমতি ব্যতীত….
আসলে ছেলের সিদ্ধান্তে কয়েক মুহূর্ত বাক্যহারা হয়ে গেছিলেন তিনি, আনন্দে। উপযুক্ত শিক্ষা তাহলে দিতে পেরেছেন তিনি তার ছেলেকে। ছেলের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন, “সাবাশ বেটা। এই না হলে বাপ্ কা বেটা”।
নন্দার বাড়ির ঠিকানা অনায়াসে যোগাড় করে ফেললেন সুনীলবাবু, তার মালিকের কাছ থেকে। তারপর সশরীরে হাজির হলেন। নন্দার মা তাদের ছোট্ট ঘরটিতে আপ্যায়ন করে বসালেন তাকে। সুনীলবাবু ঘরে ঢুকেই দেখলেন, দেওয়ালে একটি তাকে শুধু বই আর বই। যত দেখছেন ততই ভালো লাগছে।
কালী বলল, “আপনি, মানে আপনাকে তো ঠিক…”
কোনো ভনিতা না করেই সুনীলবাবু বললেন, “আপনার মেয়ে নন্দাকে বৌমা করে নিয়ে যেতে চাই আমি। আমার ছেলে স্কুলশিক্ষক। সে নিজেই নন্দাকে পছন্দ করেছে। ওর মা নেই। তাই আমি একাই কথা বলতে এসেছি।”
কালী বলল, “এ তো আমাদের পরম সৌভাগ্য।”
“তবে আমার একটা শর্ত আছে। এম এ পড়তে হবে তাকে। ওই বাস চালানোর ফাঁকে প্রাইভেটে পড়ুক!”
শেষের বাক্যবন্ধটি শুনেই নন্দার মা ভীষণ উত্তেজিত। “বলেন কি বাবু? এত ভাগ্যি আমার মেয়ের!”
সুনীলবাবু হঠাৎ বিরক্ত। ভ্রু কুঞ্চিত করে বললেন, “নাহ্, আমাকে মনে হয় বিষয়টা নিয়ে আর একটু ভাবতে হবে।”
গলার কাছে কান্না দলা পাকিয়ে উঠল নন্দার মায়ের। কোনরকমে সামলে নিয়ে বলল, “কেন দাদা!”
সুনীলবাবুর মুখে হাসি ফুটল। “ওই, ওই! ওইটা মনে থাকে যেন। দাদা ছাড়া আর কিছু বলে ডাকা যাবে না আমাকে।”