Select Language

[gtranslate]
৮ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ বুধবার ২২শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

।। রত্নগর্ভা ।।

টুলু গাঙ্গুলী :- সত্যিই রত্মগর্ভা শিবানী, এরকম আবার দেখা যায় না ।
চার ছেলে মেয়ে , চার জনেই রত্ন, তিন ছেলে এক মেয়ে ৷
মেয়ে ও বড় ছেলে ঈপশ অফিসার আর মেজো ছেলে
ওবচশ অফিসার ৷ ছোট ছেলে সার্জেন্ট ডাক্তার ৷

গ্রামের মধ্যে লোকের মুখে মুখে একটা কথাই শোনা
যায় শিবানী রত্নগর্ভা ৷
তবে শিবানীর স্বামীও কম কিছু নয় যতটুকু রোজগার
করেছেন নিঃস্বার্থ ভাবে ছেলে মেয়েদের জন্য খরচা করেছেন ।
যার যেটা দরকার সেটা তখনই তাকে দিয়েছেন ৷
মোধ্যা কথা তিনি হাজার কষ্ট করেও ছেলেমেয়েদের কষ্ট পেতে দেননি।
শিবানির স্বামী মোহনবাবুর বউ অন্ত ছিল প্রাণ ।
কথায় কথায় বউয়ের সম্পর্কে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়তেন । লোকের সঙ্গে যদি পাঁচটা কথা বলেন তো তিনটে কথা শিবানীর নামে বলেন –
শিবানী না থাকলে তার ছেলেমেয়েকে এত বড় করে সে তুলতে পারতেন না।
গ্রামের লোকদের সুযোগ পেলেই বলতেন ছেলেমেয়েদের পিছনে কষ্ট করে তাদের মানুষ করো একদিন ঠিক ফল পাবে আর মহিলাদের বলতেন তোমরা শিবানীর মতো হতে চেষ্টা করো ৷
বাড়িতেও তার বউ নিয়ে কম আবেগ ছিল না সুযোগ পেলেই শিবানীর সঙ্গে ইয়ার্কি হাসি ঠাট্টা করতেন, আড়ালে আবদারে আদরও করতেন ৷
শিবানী কম বয়সে সেটা মানলেও পরবর্তীকালে একটু লজ্জা পেত আবার ভালোও লাগতো তার ৷

একদিন তো বলেই ফেলল শিবানী তোমাকে কেউ দেখলে বলবে না যে তুমি চার ছেলের মা । এখনো যেন মনে হচ্ছে সেই যে নতুন বউটি এনেছিলাম, এখনো ঠিক তেমনি আছো ।
শিবানীর চিবুকে হাত দিয়ে আদর করল ৷
শিবানী তো কি গদগদই না হল , এমন করে স্বামীর ভালোবাসা কটা মেয়েই বা পায় ৷
যাদের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরায় সেসব সংসারে এসব কথা শুনলে হাসি পায়।
সবাই তো আর তখনের সময়ে পেট ভরে খেতে
পায়নি ৷
অনেক সংসারে প্রচুর অভাব দেখা গেছে হয়তো কারো পাঁচ সাতটা ছেলে মেয়ে তার মধ্যে হয়তো দু একটা লেখাপড়া শিখেছে, হয়তো কেউ চাকরি পেয়েছে ৷

শিবানীদের কিছু ধান-জমিও ছিল, মোটের উপর খাওয়ার লেখা পড়ার কষ্ট ছিল না ৷
শিবানীর দেওর আর জা, পাঁচ বছরের মেয়ে দেবীকে রেখে মারা যায় ।
সেই মেয়েকে শিবানী কোনরকমে মানুষ করে।
তবে তারও জমি জায়গার উপর অর্ধেক ভাগ আছে।
শিবানী এদিকটায় দেবীর সঙ্গে খুবই খারাপ ব্যবহার করেছে । কারন তার ছেলেমেয়েদের আলাদাভাবে লেখাপড়া শিখিয়েছে।
কিন্তু দেবীকে সে কখনোই লেখাপড়া বা অন্য কিছু শেখাতে চায়নি। সে যখন ক্লাস নাইনে পড়ে তখন তার সম্বন্ধ দেখে মোটামুটি রোজগেরে ছেলের সঙ্গে মাত্র ১৫ বছর বয়সে বিয়ে দিয়ে দেয় ৷
দেবী বিয়ে করতে চায়নি সে লেখাপড়ায় খুব ভালো ছিল, সে লেখাপড়া করতে চেয়েছিল।
দেবী হচ্ছে শিবানীর মেয়ে লেখার থেকে
দুবছরের বড় ৷
শিবানী তিন ছেলের কোলে মেয়ে ৷
অনেক সংসারে ছেলেমেয়েরা লেখাপড়ায়
ভালো হলেও বাবা ,মা ঠিকমতো জানে না কোন দিকে পরিচালনা করলে ছেলেমেয়েরা ঠিক ঠিক দিক নিতে পারবে ৷
সে দিক থেকে মোহন ছিল খুবই তুখর বুদ্ধির । সে ঠিক ঠিক সময়ে চাকরির ঠিক ঠিক পরীক্ষাগুলো ছেলে মেয়েদের দেওয়ায়- এটা একটা বড় জানার বিষয়।

ছেলেমেয়ে নিয়ে শিবানীর গর্বের শেষ ছিল না ।
কথায় কথায় লোককে বলতো আমার ছেলেমেয়েদের মতন হওয়া অত সোজা নয় ।
পাড়ার কেউ একজন প্রচুর কষ্ট করে লেখাপড়া করে মাধ্যমিকে দশজনের মধ্যে হয়েছিল ।
খবরের কাগজে টিভিতে বেশ কিছুদিন আলোড়ন তুলেছিল কিন্তু ওই যে অভাব !
তারপর কোন রকমের লেখাপড়া শেষ করে একটা কাজে ঢুকতে সে ছেলে বাধ্য হয়েছিল ৷
এখানে মোহন আর শিবানী সেই ছেলেটাকে বলেছিল বিড়ালের ভাগ্যে কোনরকম শিকে ছিঁড়েছিল আর কিছু করতে পারবি না।
তাদের আর্থিক অবস্থাকে বিদ্রুপ করেছিল ৷

সেই রত্নগর্ভা মায়ের এখন অবস্থা দেখলে পথের কুকুরও কেঁদে যাবে।
এখন তার ঠাঁই হয়েছে সেই দেওরের মেয়ে দেবীর বাড়ি।
যাক মোহন বাবুকে আর এ অবস্থায় আসতে হয়নি তিনি কয়েক বছর আগেই মারা গেছেন ৷
তাকে আর এ দৃশ্য দেখতে হয়নি।
তার সফলভাবে সন্তানদের মানুষ করার পরিণতি যে অসফল হয়েছে গর্ব যে তার খর্ব হয়েছে এটা তিনি দেখে গেলে খুবই কষ্ট পেতেন ।
তাই এখন তিনি মরে বেঁচেছেন ।
তার চার ছেলে মেয়ে নিজ নিজ কেরিয়ার নিয়ে সংসার নিয়ে ব্যস্ত ৷
মাকে দেখার তাদের সময় কোথায় ?
একবার বড় ছেলে মাকে তার কাছে নিয়ে গিয়েছিল কিন্তু সে মাকে ,দেখলো দিনরাত খ্যাঁচ খ্যাচ করছে, কোঁত পারছে ।
সেই নিয়ে তার বউও খুব অশান্তি শুরু করেছে ।
সে রেগে গেল, তারও ছেলেমেয়ে আছে ।তাদেরকে বড় করতে হবে মানুষের মতো মানুষ করতে হবে ৷
তাই গ্রামের বাড়িতেই মাকে রেখে গেল ৷
এখন মায়ের বয়স হয়েছে নিজে কিছু কাজ করতে পারত না।
একদিন দেবী এসে তাকে নিয়ে গেল ৷
তিন ছেলে এক মেয়ে যে মায়ের খরচ খরচা দরুন টাকা পাঠাবে , সেটাও তাদের আলোচনা করতে হয়েছে।
তারা ভেবেছে আমরা সবাই মিলে টাকা দিলে দেবী সব টাকা নিজের সংসারে খরচা করবে।
মাকে দেখবে না ।
তাই তারা বলল দেশের বাড়ি আর জমি জায়গা বিক্রি করে দিয়ে আমরা প্রত্যেকে দুমাস দুমাস করে মাকে নিজেদের কাছে রাখবো ৷

দেবী, গরিব বলে তার বাড়ি শিবানির ছেলেমেয়েরা যেতে চায় না বা কারো সময় নেই ।
কিন্তু জমি বাড়ি বিক্রি করার বেলা তারা গ্রামের বাড়ি আসে ৷
সকলে মিলে মিটিং করে এই সিদ্ধান্ত হয় যে জমি এবং বাড়ির দরুন যা টাকা পাবে তা তারা চারজনে সমান ভাবে ভাগ্য করে নেবে ।
তাই তারা জমি বাড়ি বিক্রি করার জন্য সব পাকা ব্যবস্থা করল ৷
এবার মাকে নিয়ে এসে সইটা করিয়ে নেবে কারন মায়ের নামে দলিল ৷
বড় ছেলে অরুময় বলল কাকারও সমান ভাগ আছে কিন্তু সেটা দেবীকে জানতে দিলে চলবে না ৷
সেটা কোনরকমে ম্যানেজ করে নিতে হবে।
মাকে আনতে লোক যাবে বলে ছেলেরা দেবীকে ফোন করে জানায় ৷
পাড়ার লোকে নানা কথা কইতে লাগলো বলল এই রত্নগর্ভা মায়ের রত্ন ছেলে মেয়েরা !
বাহ বাহ কি ভালো !
মাকে দেখার কারো সময় নেই –
এই মা, ছেলেমেয়েদের নিয়ে কি অহংকার না করত বাবাও কম কিছু ছিল না !

কিন্তু এ সব দেখে এখন তাদের নিজেদের সংসারেই ঘেন্না ধরে গেছে ৷
তারা ভাবে আমরা তো সে ভাবে ছেলে মেয়ে মানুষ করতে পারিনি ৷ না জানি আমাদের ভাগ্যে কি আছে !হায়রে কপাল !
মাকে আনতে গেল পাড়ার দুইজন ব্যক্তি সুফল কাকা ও দীনু কাকা ।
সেখানে গিয়ে তারা শোনে মা আর দেবী আগেই বেরিয়ে গেছে ৷
বাড়িতে এসে শিবানী দেখে তার চার ছেলে মেয়ে আর কিছু পাড়া প্রতিবেশি আবার মাতব্বর কিছু ব্যক্তি বসে দাড়িয়ে আছে ৷
গাড়ি থেকে শিবানী কে নামতে দেখে ছেলেমেয়েরা থ’বনে গেল ।
এই ছয় মাসে তাদের মায়ের কত পরিবর্তন হয়েছে !চলা বলা ;সৌন্দর্য যেন ফেটে পড়ছে এই ৭২ বছর বয়সে দেখলে চেনা যায় না ৷
মনে মনে সকলে এটা দেবীর কৃতিত্বই ভাবল কিন্তু এমন ভাব দেখালো যেন মায়ের খুব কষ্ট হচ্ছে ৷

শিবানী আর দেবী গাড়ী থেকে নামতেই শিবানীর মেজো ছেলে বিজয় গাড়ীর ভাড়া মেটাতে গেল তখন ড্রাইভার বললো এটা দেবী বউদির বাড়ির গাড়ি ৷
অন্য ভাই দাদারা কথাটা শুনে অবাক এত দামি গাড়ি আবার ড্রাইভার রেখেছে ৷

শিবানী ছেলে মেয়েদের মুখ থেকে বাড়ি জমির ব্যাপারে সব শুনলো আর মুখে বললো সত্যিই তো তোরা একদম ঠিক কথা বলেছিস ৷
বলে হারিয়ে গেলো কয়েক বছর আগে –
একদিন দেবীর খুব জ্বর হয়েছে শুধু ঘুমের ঘোরে বড়মা বড়মা বলে ডাকছে আর লেখা মানে শিবানীর মেয়ে বললো আমার মা কেন তোর কাছে থাকবে ?

অত জ্বরেও তার কাছে থাকেনি, তার মাথায় হাত বোলাইনি শিবানী।সে সেই রাত্রে কত কষ্ট পেয়েছে ছোট্ট দেবী ৷
সেই লেখা যখন ঊপশ্চ পরীক্ষায় দুবার ফেল করলো একদম ভেঙে পড়লো ৷ শিবানী তাকে মনে সাহস জোগালো তার পর গলার হার ,বালা জোড়া বিক্রি করে দিল ৷ লেখার পড়ার খরচ চালালো ৷
তৃতীয় বারে পাশ করে কি আনন্দ লেখার, ঈপশ অফিসার হলো ৷
আর দেবীর অমতে তার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ জেনেও তাকে অল্প বয়েসে পড়া ছাড়িয়ে বিয়ে দিয়েছিল ৷ যৎসামান্য জিনিস দিয়ে গা থেকে দায় ঝেড়ে ফেলেছিল।

ছোটো ছেলে সৌম্য আজ বড় সার্জেন ডাক্তার সে আবার অন্য জনের থেকে আরও এক ধাপ এগিয়ে ৷
বলে ব্যাঙ্গালোরে গিয়ে থাকাটা মায়ের খুব অসুবিধা হবে ।
কারও সঙ্গে কথা বলতে পারবেনা মা ওখানের ভাষা ও বুঝবে না ৷

মেয়ে লেখা, তাকে কি বলবো সে তো শাশুড়িকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে দিয়েছে ৷

মেজো ছেলে মদ খায় পার্টি করে সঙ্গে বউও থাকে । একটা খারাপ পরিবেশ বানিয়ে ফেলেছে বাড়ির ।

একদম মেজো ছেলের কাছে ভালো লাগে না শিবানীর।কত বুঝিয়েছে উল্টে মাকে দুটো কথা শুনিয়েছে ছেলে । বলেছে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে শেখো ৷

শিবানীদের গ্রামের একটা গ্রাম পরে সেটেলমেন্ট অফিস ।
সেখানে সবাই মিলে যাওয়া হল যাতে করে বাড়ি জমি বিক্রি করা হয় ৷ সেখানে সকলে মিলে যাওয়া হল ছেলেরা দেবীকে যেতে বারণ করল । শিবানী বলল না দেবী সেখানে যাবে, তার যাওয়ার প্রয়োজন আছে ৷

সেখানে গিয়ে যা হল তা শুনলে সবাই অবাক হবেন ছেলেদের মুখে চুনকালি পরল দেবীর শত আপত্তিতেও শিবানী তার অর্ধেক সম্পত্তি বাড়ি সবকিছু আজ দেবীর নামে করে দিল।
দেবীর বাবার যে সম্পত্তিতে অর্ধেক ভাগ ছিল তাও দেবীর হল ৷
শিবানী সবকিছু করে ছেলে মেয়েদের বলল তোমরা হলে আমার গর্ভের সন্তান আর দেবী হলো আমার গর্বের সন্তান।
তোমরা এখন দেবীর বাড়ি যাওয়া-আসা করতে পারো। তোমাদের থেকে দেবীর আর্থিক অবস্থা এখন ভালো বই খারাপ নয়।

শিবানী ও দেবী সেখানে আর এক তিলও দাড়ায়নি। গাড়ি করে দেবী ,শিবানীকে নিয়ে চলে গেল নিজের শ্বশুর বাড়ি।

ekhansangbad
Author: ekhansangbad

Related News

Also Read