কেকা দাস :- সুমেধা মেসেজের পর মেসেজ আর ফোন করেই যাচ্ছে…. একটাই কথা…. মা তুমি বাড়ি ফিরে এসো…. আমি আর সামলাতে পারছিনা।
তুমি তোমার বাড়ি ছেড়ে কেনো কোথাও যাবে!
বাড়ি ছেড়ে এই আনন্দ আশ্রমে এসেছি ছেলে নীলের জ্বালায় অস্থির হয়ে….
আমার বিয়ে হয়েছিলো সতেরো বছর বয়সে এক অধ্যাপকের সাথে…. বয়সের পার্থক্য ছিলো প্রায় বারো বছর….
নীলের বাবা অতনু সান্যালের অনেক ছাত্র ছাত্রী ছিলো যারা বাড়ি এসে পড়তো।
প্রথম প্রথম বুঝতাম না,ভাবতাম পড়াচ্ছে কিন্তু দিন যত যেতে লাগলো বুঝতে পারলাম , ছেলের থেকে মেয়ে ছাত্রীর আধিক্য।
স্পেশ্যাল ক্লাস হত দরজা বন্ধ করে আর তখন শাশুড়ি মা গজগজ করতেন….. কুলাঙ্গার একটা…. শিক্ষক জাতের কলঙ্ক…।
বুঝতে না চেয়েও বুঝতে শিখলাম।
মন যখন ভাঙতে আরম্ভ করেছে তখন কোল জুড়ে নীল এলো।
নীলকে আমি মনের মতন করে মানুষ করেছিলাম, ভেবেছিলাম মানুষ হলো কিন্তু এখন ধিক্কার জানাই নিজেকে যে আমি কত মূর্খ ছিলাম।
রক্তের ধারা নীল বয়ে চলেছে …. সুন্দরী শিক্ষিতা দেখে সুমেধাকে ঘরে আনলাম….. বেশ চলছিলো জানেন, ওদের খুনসুটিগুলো খুব উপভোগ করতাম…. তিনজনে মিলে বেড়াতে যেতাম….
তিনজন কেন! এপ্রশ্ন আসতেই পারে…. আসলে অতনু সান্যাল প্রায় সময় বিদেশে থাকেন আর এদেশে থাকলেও এক বাড়ি হলেও তার জগৎ একদম আলাদা…. আমার সাথে দেখা হয়না ,আমি মুখোমুখি হতেও চাইনা।
নীলের জগৎ যখন আলাদা হতে শুরু করলো….প্রথমে অনেক রাতে বাড়ি ফেরা দিয়ে শুরু হলো ….
জিজ্ঞাসা করলে বলতো, মামনি কাজের খুব চাপ….
আমার মনে যখন উদ্বেগের প্রকাশ হচ্ছে সেইসময় একরাতে অতনু সান্যাল ঘুমের মধ্যেই পরলোকে চলে গেলেন….
কাজকর্ম মিটলে একদিন সুমেধা এসে বললে, মামনি তোমার ছেলের মতি গতি ভালো ঠেকছে না।
মনে কুডাক অনেকদিন থেকেই দিচ্ছিলো এবার নিশ্চিত হলাম।
বললাম , কেনোরে! কি দেখে মনে হলো!
ও বললে, তুমি কি কিছুই বুঝতে পারো না!
রাত করে বাড়ি ফেরা , প্রায় সময় ট্যুর লেগে থাকে….
এবার আরো নিশ্চিত হয়েছি ওর ট্রলিতে মেয়েদের ইনার গার্মেন্টস পেয়ে….জিজ্ঞাসা করতে বললো, তোমার জন্যে কেনা….অথচ মামনি ওটা ব্যবহার করা….পরিষ্কার ডিওর গন্ধ আসছে…
সেটা বলাতে বললো ডিও স্প্রে করে এনেছে …
তোমায় আগে বলিনি ওর ট্রাউজারের পকেটে প্রায় আমি সিনেমার টিকিট না হলে কন্ডোমের প্যাকেট পাই…. সেকথা বলতে বললো, তোমার কোন সখ আহ্লাদ আমি পূর্ন করিনা… তোমার কি কি লাগবে বলো… আমি দিচ্ছি …
শুধু মামনির মতন আমায় নিয়ে সন্দেহ কোরো না।
মামনি সারাজীবন বাবাকে সন্দেহ করে গেছে … না নিজে সুখী থেকেছে না বাবাকে থাকতে দিয়েছে….
আমার পিছনে গোয়েন্দাগীরি করতে এসো না, ফল ভালো হবেনা।
সব শুনে আমার পায়ের তলার জমি কেঁপে উঠলো…. আমি তো নীলকে মানুষ করতে পারিনি … রক্তের ধারা কোথায় যাবে …
ভাবতাম ছেলে আমায় বোঝে…. কি মূর্খ আমি!
ওহো দেখেছেন এতক্ষণ বকবক করলাম অথচ আমার পরিচয় দেইনি….. আমি নীলিমা সান্যাল ..বিয়ের আগে পদবী বোস ছিলো।
বাবা মা আদর করে নীলু ডাকতেন,বাবা মা নেই সেই আদরের ডাকও নেই।
নীলের ওপর খানিকটা রাগ করেই হোক বা নিজের মান বজায় রাখার জন্যেই হোক আমি নিজের ইচ্ছাতে এই আশ্রমে আসি।নীলকে বলেছিলাম, কিছুদিন একা থাকতে চাই….নীল কিছু বলেনি।
সুমেধার মেসেজগুলো আমায় বড়ো ভাবাচ্ছে , ভাবছি আরেকটা জীবন নষ্ট হয়ে যাবে…. আমার কি ওকে সাহায্য করা উচিত নয়!
আমার অনুপস্থিতিতে নীল আরো অসংযত জীবন যাপন করছে ।
আমার শ্বশুর বাড়িটি
শাশুড়িমা মারা যাওয়ার আগে বাড়ির তার ভাগের অংশ আমায় লিখে দিয়ে গেছেন …. তাই এই বাড়ির পঁচাত্তর ভাগ অংশ আমার…আমি চাইলেই সুমেধাকে একটা নিশ্চিত আশ্রয় দিতে পারি…এই মনোভাব নিয়েই আশ্রমের নিয়ম নীতি মেনে ওদের পাওনাগন্ডা মিটিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম ।
নীল অফিস থেকে ফিরলো বেশ রাত করে আকন্ঠ মদ গিলে…. আমায় দরজা খুলতে দেখে চমকে উঠে বললে,মামনি তুমি! আমায় কেউ কেনো বলেনি যে তুমি এসেছো!
অফিস পার্টি ছিলো,বুঝতেই তো পারছো….
আমি বললাম, কাল সকালে তোমার সাথে কথা আছে , অফিস যাওয়ার আগে কথা শুনে যেও।
পরের দিন সকাল নটায় নীল এসে দাঁড়ালো মামনি কিছু বলবে!
আমি সুমেধার মতামত আগের রাতেই নিয়ে নিয়েছিলাম ।
তাই বললাম, এরকম করে তো চলতে পারেনা তাই তুমি ডিভোর্স নিয়ে সুমেধাকে মুক্তো করো…. যে যার নিজের মতন করে বাঁচো….
নীল বললে, এমন বোলো না মামনি, আমি একটা ঝামেলায় ফেঁসে রয়েছি…. এই ঝামেলা মিটলে আমি আবার সব ঠিক করে নেবো।
আমি বললাম, তুমি ঠিক করলেই তো হবে না, সুমেধা আর তোমার সাথে থাকতে চায়না…
আর তোমার জেনে রাখা ভালো এই বাড়ির পঁচাত্তর ভাগ অংশের মালিক আমি ….তাই আমি চাইবো, তুমি তো ভালো আয় করো আর এতদিন সংসার খরচ বলে তোমায় কিছু খরচ করতে হয় নি … তুমি যদি অন্য কোন ফ্ল্যাট দেখে চলে যাও….তার জন্যে কিছু টাকা লাগলে আমি দেবো কিন্তু এবাড়ির সত্ত্ব তোমায় বরাবরের মতন ছেড়ে দিতে হবে।
তোমাকে আমার কথাও ভাবতে হবেনা…. তুমি সম্পূর্ন স্বাধীন…
নীল মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে চলে যাওয়ার সময় বলে গেলো মামনি আমায় কিছু সময় দাও….
কথাগুলো বলার সময় আর ওকে দেখে চোখ ফেটে জল আসছিলো… কি করবো বলুন সন্তান তো….
সুমেধাকে বললাম, আজ থেকে তোমার ওই ঘরে থেকে কাজ নেই, আমার ঘরে থেকো….
আর ভেবে বলো, যা করছো তা মন থেকে করছো তো!
সুমেধা এসে আমায় জড়িয়ে ধরে বললো, মামনি আমি আর পারছিলাম না গো…যখন ভাবছিলাম আর বেঁচে থেকে কি লাভ! তখনই তুমি ফিরে এলে আর দুদিন পর এলে হয়তো আমার মরা মুখই দেখতে ….. কেঁপে উঠলাম….ঠিক এমন কথা আমিও ভেবেছিলাম আর তখন পেটে প্রাণের উপস্থিতি টের পেয়েছিলাম আর সুমেধার তো সেই অবলম্বনটাও নেই।
না সুমেধাকে আর ডিভোর্স নিতে হয়নি…. মাসাধিক টানাপোড়েন চলছিলো…. এক বর্ষার সন্ধ্যায় নীল বাইক নিয়ে ফিরছিলো তখন একটা ট্রাক তাকে পিষে দিয়ে বেরিয়ে যায় ..
প্রথমে দুর্ঘটনা ভাবা হলেও পরে কানাঘুষাতে জানা গেলো এটা মার্ডার …. নীল এক রাজনৈতিক নেতার স্ত্রীর সাথে জড়িয়ে পড়েছিলো আর তার জেরেই এই মৃত্যু….
সুমেধা কাঁদত আর বলতো এ আমি চাইনি মামনি …. কারোর মৃত্যু আমি কখনো চাইনি ।
নীলের অফিসের সহকর্মীরা আসতো …. অনেক কথা জানতে পারলাম…. তাই এই মৃত্যুতে আমার কোন শোক নেই…. ও মরে গিয়ে বেঁচেছে নাহলে হয়তো জেল খাটতেও হত।
নীলের অফিসে সুমেধার চাকরী হলো..
অফিস বেরোনোর সময় প্রায় বলতাম, নিজের জীবন এবার নিজে গুছিয়ে নে…. একটাই জীবন…. নিজের মতন করে নে..
একা থাকতে চাইলে একা থাকতে পারিস আবার মনোমত সঙ্গী পেলে সময় নষ্ট করিস না…
নিজের জীবন দিয়ে বুঝেছি , একা থাকা খুব কষ্টকর…
বছর কিভাবে শেষ হয় কে জানে! নীল চলে গেছে এক বছর হয়ে গেলো… কষ্ট কি হয়না! হয় … ভাবি ও যেখানে আছে ভালোই আছে..
আজকাল হাঁটু ব্যথাটা বেশ বেড়েছে ওপর নিচ করতে পারিনা তবু তার মধ্যে দেখি সুমেধার হাসিতে ভরা মুখখানি, ওর গুনগুন করা গান….বুঝিয়ে দেয় ও ওর মতন করে ভালোই আছে ….
সেদিন জিজ্ঞাসা করেছি, এই যে রোজ সাজুগুজু করে অফিস যাস আমার বুঝি কোন সুখবর শুনতে ইচ্ছা করেনা!
একটাই তো জীবন বলুন!
ওর লাজে রাঙা মুখ দেখে সেই সুখবরের অপেক্ষায় আছি….আমি খবরটা পেলেই আপনাদের বলে দেবো ……..