Select Language

[gtranslate]
৮ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ বুধবার ২২শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

।। উত্তরণের পথে ।।

সায়ন্তনী দাস ধর :- “দামোদর, এই জামাগুলো নিয়ে যেও তোমার মেয়ের জন্য।” রঞ্জনী ময়লার প্যাকেট গাড়িতে ফেলতে ফেলতে বলে।
“আচ্ছা দিদিভাই। আপনার মত মানুষ হয় না!” বড় খুশি হয়ে বলে ময়লার গাড়ি নিয়ে আসা মানুষটি।
দামোদর পুরসভার অস্থায়ী কর্মী। মাইনেও খুব বেশি পায় না। অনেক বছর আগে তার বউটা তিন বছরের বাচ্চা ফেলে মারা গেল। সেই থেকে দামোদরের সংসারটাও এলোমেলো হয়ে গেল। ঐটুকু বাচ্চা সামলাবে, নাকি কাজে বেরোবে? দেশোয়ালি বন্ধুবান্ধবের কথা শুনে সে আরেকটা বিয়ে করল। কিন্তু তার কপালটাই খারাপ! তার এ বউটা আগেরজনের মত ভাল হল না। বড্ড মুখরা আর কুচুটে সে। বাচ্চাটাকে মোটেই ভালবাসত না। একটু বড় হতেই তাকে দিয়ে ঘরের সব কাজ করাত, ঠিকমত খেতেও দিত না! শান্ত দামোদরের পক্ষে সেরকম প্রতিবাদ করা সম্ভব হয় নি। চন্দা মানে তার মেয়েটাও মুখ বুজে সৎ মায়ের সব অত্যাচার সহ্য করত। কয়েক বছরের মধ্যেই জন্ম নিল তার সৎ ভাই, বোন। তখন থেকে চন্দার দুরবস্থার আর সীমা রইল না!
পুরসভার অস্থায়ী কাজটা পাওয়ার অনেক আগে থেকেই এই পাড়ার সাথে পরিচিতি দামোদরের। পাড়ার সকলের বাড়িতে মেথরের কাজ করত সে। প্রতিটি বাড়িতেই নানারকম নিয়মকানুন মেনে কাজ করতে হত তাকে! সে যে মেথর! সে যে অচ্ছুত! একমাত্র রঞ্জনীর বাড়িতেই সে মানুষের মত ব্যবহার পেত। সকালের চা রঞ্জনীই তাকে খেতে দিত, টুকটাক কথা বলত তার সাথে। এভাবেই তার জীবনের গল্প জেনে ফেলেছিল রঞ্জনী। রঞ্জনীকে যত দেখত, ভারি অবাক হয়ে যেত দামোদর! মেথর বলে সমাজের বেশিরভাগ মানুষই তার সংস্পর্শে আসতে ঘেন্না পায়, রঞ্জনী ব্যতিক্রম! সেই তখন থেকেই চন্দার জন্য জামাকাপড়, খেলনা দিত রঞ্জনী। পুরসভার অস্থায়ী চাকরিটা পেয়ে যেতে দামোদরের সংসারে অর্থের যোগান একটু বাড়ল, তার চেয়েও বাড়ল চন্দার উপর তার সৎ মায়ের অত্যাচার। নিজের ছেলে মেয়ে ছাড়া আর কাউকে সে তার সংসারে ঠাঁই দিতে রাজি ছিল না। এসব দুঃখের কথা দামোদর আর কাকেই বা বলবে, রঞ্জনী দিদিভাই ছাড়া!
“চন্দা আমার বাড়িতে থাকতে পারে, আমার মেয়ে তিতলির সঙ্গী হবে আর আমার হাতে হাতে টুকটাক কাজকর্ম করবে।”
রঞ্জনীর প্রস্তাবে তক্ষুনি রাজি হয়ে গিয়েছিল দামোদর। গরীব ঘরের মেয়ে, বসে বসে কি আর খাবার জুটবে! আজ না হোক, দুদিন পর থেকে তো কাজকর্ম করেই খেতে হবে! না হয় এখন থেকেই করুক! সৎ মায়ের অত্যাচার থেকে তো বাঁচবে!
“যাকে তাকে সাহায্য করছ, খেতে দিচ্ছ… এই পর্যন্ত তো আমি মেনেই নিয়েছি! একটা মেথরকে শেষে ঘরে এনে তুলবে?” নিজের অসন্তোষ গোপন করেন নি রঞ্জনীর শাশুড়ি কমলিনী।
“মা, আপনি অসুস্থ, তিতলি তিন বছরের বাচ্চা। সবসময়ের একটা মেয়ে থাকলে তো আমাদের সুবিধেই হবে! আর ঐ মেয়েটাও এখানে একটু ভাল থাকবে!” দৃঢ়কন্ঠে বলেছিল রঞ্জনী।
অবশ্য রঞ্জনীর স্বামী অতুল এ ব্যাপারে কোন হস্তক্ষেপ করে নি। সে বরাবরই সংসারের দায়িত্ব বউয়ের উপর ছেড়ে নিশ্চিন্ত থাকতে অভ্যস্ত।
দিন দুয়েক পরে তেরো বছরের চন্দা একটা জামাকাপড়ের পুঁটলি নিয়ে বাবার সঙ্গে এল রঞ্জনীর বাড়িতে। অপুষ্টির কারণে তাকে দেখলে নয় দশ বছরের বেশি বলে মনে হয় না। ছলছল চোখে বাবাকে বিদায় জানিয়ে রঞ্জনীদের বাড়িতে চন্দার নতুন জীবন শুরু হল। কিছুদিনের মধ্যেই নিজের স্বভাবগুণে চন্দা এ বাড়ির সকলের খুব প্রিয় হয়ে উঠল।
“ও চন্দাদিদি, এস না আমার সাথে খেলবে।”
“সবজিগুলো চটপট কেটে দে, চন্দা… তোর মামার অফিসের সময় হয়ে গেল।”
“আরেক কাপ চা করে নিয়ে আয় দেখি, চন্দা… সকালের ব্যস্ততার মধ্যে তোর মামীকে বললে তো তেড়ে আসবে!”
তিতলি, রঞ্জনী, অতুল সকলেরই এক ডাকে হাজির চন্দা।
ব্যতিক্রম কমলিনী…
“এই মেয়ে, তুই একদম ঠাকুরঘরে ঢুকবি না…
আমার চা আনতে তোকে কে বলল? বৌমা, শেষ বয়সে এসে মেথরের হাতের খাবার খেতে হবে তোমার জন্য?”
চন্দা চোখের জল মুছে সরে যায় কমলিনীর কাছ থেকে।
তাকে সান্ত্বনা দেয় রঞ্জনী, “কিছু মনে করিস না, চন্দা! মা পুরোনো দিনের মানুষ তো, তাই…”
শুধু কমলিনী নয়, পাড়ার বহু প্রতিবেশী ঠারেঠোরে রঞ্জনীকে শোনায়, “যাই বল ভাই, সমাজের একটা নিয়মকানুন আছে তো! ওরা যা নোংরা হয়! তুমি একেবারে মেয়েটাকে বাড়িতে এনে তুললে!”
এবারের লক্ষ্মীপুজোয় রঞ্জনীদের বাড়িতে প্রতিবেশীদের অনেকেই এল না।
“বাড়িতে মেথর রেখেছে, তাকে দিয়ে পুজোর কাজও হয়তো করাচ্ছে! অমন অশুদ্ধ পুজোয় যাব না।”
“ঠিক বলেছ… সমাজ সংস্কারক হয়েছেন উনি! কোন বাছবিচার নেই, যত্তসব!”
কানাঘুষোয় এসব কথা রঞ্জনীর কানেও এল, কমলিনী মুখভার করে রইলেন কদিন। মুখ চুন করে ঘুরে বেড়াল চন্দা।
রঞ্জনী নির্বিকার রইল। বেশ কিছুদিন পরে চন্দার আগ্রহ লক্ষ্য করে রঞ্জনী তাকে স্কুলে ভর্তি করে দিল। বুদ্ধি খুব বেশি না থাকলেও বাড়ির কাজ সামলে পড়াশোনা করে প্রতি ক্লাসে পাস করে যেতে লাগল সে। স্কুল শেষ করে কলেজেও ভর্তি হল। তারপর ছোটখাটো একটি চাকরিও পেয়ে গেল।
এভাবেই কেটে গেল অনেক বছর। ইতিমধ্যে তিতলিও পড়াশোনা শেষ করে বিদেশে চাকরি নিয়ে চলে গেল। বছর কয়েক আগে কমলিনীও এ জগতের মায়া কাটিয়েছেন। অতুল ও রঞ্জনীর বয়স হয়েছে। ইন্টারনেটের কল্যাণে তিতলির সঙ্গে তাদের যোগাযোগ অক্ষুণ্ণ থাকলেও সে বাবা মায়ের পাশে থেকে কিছু করতে পারে না।
“চন্দাদিদি, ভাগ্যিস তুমি বাবা মায়ের পাশে আছ! নইলে যে আমি স্বস্তিতে এখানে থাকতেই পারতাম না!” তিতলির সঙ্গে প্রায়ই কথা হয় চন্দার।
চন্দার স্বামী ও ছেলে নিয়ে সুখের সংসার। অতুল ও রঞ্জনীকে সে নিজের বাবা মায়ের মত করেই ভালবাসে। তাদের সব দায় দায়িত্ব সে ভালবেসেই নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে।
“তুই তো আমার বড় মেয়ে! আমার মত এত সৌভাগ্যবতী আর কে আছে?”
রঞ্জনীর কথায় তার বুকে মাথা রেখে চন্দা যেন তার ছোট্টবেলায় হারিয়ে যাওয়া মাকেই খুঁজে পায়!

ekhansangbad
Author: ekhansangbad

Related News

Also Read