মদনলাল ধিংড়া প্রথম ভারতীয় বিপ্লবী যাঁর লন্ডনের পেন্টনভিল জেলে ফাঁসি হয়।অথচ তাঁর অবদান আজ দেশের ৭৬তম স্বাধীনতার বর্ষেও বেশীর ভাগ ভারতীয়ের কাছে অজানা।
১৮৮৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর পাঞ্জাবে সন্ত্রান্ত, ধনী পরিবারেই জন্ম হয়েছিল মদনলাল ধিংড়ার। তাঁর ছয় ভাইও বিদেশে পড়াশোনা করেছিলেন। অমৃতসরের এম.বি. ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে যোগ্যতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হওয়ার পর মদনলাল ধিংড়াও উচ্চশিক্ষার জন্য ‘কালাপানি’ পেরোলেন।
মদনলাল ধিংড়া ইংল্যান্ডে থাকাকালীন বুঝতে পেরেছিলেন— যদি স্বদেশি এবং ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের আরও গভীরে প্রবেশ করতে হয়— তাহলে পারিবারিক বড়লোকি চাল আর সাহেবি ধরাচুড়া পরা তাঁকে ছাড়তে হবে। সেজন্য ইংল্যান্ডে মালবাহকের কাজ করেছিলেন তিনি। বিলেতে আসার আগে মুম্বাইতে কারখানার শ্রমিক হিসেবেও কাজ করেছিলেন মদনলাল ধিংড়া।
সাধারণ ভারতবাসীদের হৃদয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যে কী প্রবল ক্রোধ জমে আছে। সেটা জানতে পেরেছিলেন মদনলাল। ধিংড়া। তখন থেকেই ব্রিটিশ নিধনকে জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন তিনি। বঙ্গভঙ্গের প্রধান হোতা কার্জন এবং বাঙ্গলার ছোটলাট লেফটেন্যান্ট গভর্নর ব্যামফিল্ড ফুলারকেও হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিলেন মদনলাল ধিংড়া।
১৯০৯ সালের পয়লা জুলাই, সন্ধ্যাবেলা। লন্ডনের রাজসিক ইম্পিরিয়াল ইন্সটিটিউটের আলোকমালায় সুসজ্জিত প্রাঙ্গণে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বানে সাহেবি স্যুট-মেট, গাউন পরিহিত সাহেব-মেম এবং তাঁদের বশংবদ ভারতীয় আধিকারিকেরা জমায়েত হতে শুরু করেছেন। অনুষ্ঠানের মধ্যমণি নিঃসন্দেহে ভারত সচিবের প্রধান রাজনৈতিক সহকারী রাজপুতানা রেজিমেন্টের পূর্বতন আধিকারিক তথা ব্রিটিশ সিক্রেট পুলিশের এক অন্যতম হর্তাকর্তা— স্যার উইলিয়ম হাট কার্জন। ওয়াইলি।
ইম্পিরিয়াল ইন্সটিটিউটে সভাককঢে অনুষ্ঠান শেষ হলো। অতিথিরা সভাকক্ষ ছেড়ে একে একে চলে যাচ্ছেন।
কার্জন ওয়াইলি ও তার স্ত্রীও বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎই ভারতীয়দের ওপর অনেক অত্যাচার চালানো কার্জন ওয়াইলি এবং তার পত্নীর সামনে এসে দাঁড়ায় ভারতীয় ছাত্রটি। হাতে তাঁর উদ্যত একটি ওয়েবলি অ্যান্ড স্কট রিভলবার। কার্জন ওয়াইলি ও তার স্ত্রীকে সরাসরি চারটি গুলি করলেন। যুবকটি। গুলি করলেন কার্জন ওয়ালিকে বাঁচাতে আসা পারসি চিকিৎসক কাওয়াস লালকাকাকেও। রক্তাক্ত অবস্থায়, সকলের ভয়বিহ্বল চোখের সামনে লুটিয়ে পড়ল কার্জন ওয়াইলি, তার স্ত্রী এবং কাওয়াসের শরীর।
দেশমাতৃকার অপমানের প্রতিশোধ নিতে পেরে উল্লসিত হলেন যুবকটি। আত্মাহুতি দেওয়ার জন্য নিজের মাথায় রিভলবারের নল ঠেকালেন তিনি। তবে, সাতটা বুলেট খরচ হওয়ার পর যুবকটির আগ্নেয়াস্ত্রে আর গুলি ছিল না। তাই, প্রফুল্ল চাকীর মতো আত্মহত্যা করতে পারলেন না তিনি। গোরা পুলিশ তৎক্ষণাৎ ধরে ফেলল মদনলাল ধিংড়াকে।
রাজদ্রোহের অপরাধে হত্যাকারী,২৬ বছরের তরতাজা যুবক মদনলাল ধিংড়াকে ১৯০৯ সালের ২৩ জুলাই লন্ডনের ওল্ড বেহলি আদালতের কাঠগড়াতে তোলা হলো। মদনলালের বাবা গিট্টা মল ছিলেন অমৃতসরের প্রধান স্বাস্থ্য আধিকারিক। ছেলে স্বাধীনতা সংগ্রামের চরমপন্থা এবং ব্রিটিশ বিরোধিতার দিকে ঝুঁকছে দেখে । আগেভাগেই গিট্টা মল, খবরের কাগজে ঘটা করে বিজ্ঞাপন দিয়ে ঘোষণা করে। দিয়েছিলেন বিশ্বাসঘাতক’ মদনলাল। ধিংড়াকে তিনি ত্যাজ্যপুত্র’ করলেন।
১৯০৯ সালের ১৭ আগস্ট, লন্ডনের পেন্টনভিল সংশোধনাগারে ফাসি হয় প্রবাসী এই বিপ্লবীর।পরিবারের মত সারা দেশও এই স্বাধীনতা সংগ্রামীর অবদানকে ভুলে গেছে ,চরম উদাসীনতায়।
বঙ্গভঙ্গের প্রধান হোতা কার্জন এবং বাঙ্গলার ছোটলাট লেফটেন্যান্ট গভর্নর ব্যামফিল্ড ফুলারকে হত্যাকারী মদনলাল ধিংড়া। কিন্তু প্রাপ্য মর্যাদা পাননি অগ্নিদিনের সৈনিক মদনলাল ধিংড়া।
ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন অন্যতম বিশেষ ব্যক্তিত্ব এবং অগ্নিযুগের বিপ্লবী মদনলাল ধিংড়াকে এখন সংবাদ পরিবার জানায় শতকোটি প্রণাম।