ব্রিটিশ শাসিত বাংলায় চিকিৎসা ব্যবস্থাকে সুলভ্য করতে তৈরি করেছিলেন এশিয়ার প্রথম বেসরকারি মেডিক্যাল স্কুল। নিজের জীবনের সমস্ত উপার্জন মানুষের চিকিৎসার স্বার্থেই দান করে গিয়েছিলেন রাধাগোবিন্দ কর।
প্রখ্যাত চিকিৎসক ডা: রাধাগােবিন্দ কর ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দের ২৩ আগস্ট হাওড়া জেলার সাঁতরাগাছিতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা হলেন ডা: দুর্গাদাস কর। তিনি হেয়ার স্কুল থেকে প্রবেশিক পরীক্ষা পাশ করার পর চিকিৎসাবিজ্ঞান শিক্ষার জন্য মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। চিকিৎসাশাস্ত্রের পাঠ গ্রহণ করে রাধাগােবিন্দ ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে ইউরােপ যাত্রা করেন। ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি নিজ উদ্যোগে ‘করপ্রেস’ নামে একটি ছাপাখানা গড়ে তােলেন। তার প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ‘কারমাইকেল কলেজ’ বর্তমানে তাঁরই নামাঙ্কিত ‘আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ এন্ড হাসপাতাল ‘ নামে পরিচিত।
১৮৯৯ সালের মার্চ মাস প্লেগ তখন মহামারীর আকার নিয়েছে। সেই সময়ে উত্তর কলকাতায় ঘুরে ঘুরে রোগীদের সেবা করে চলেছেন এক আইরিশ মহিলা। জেলার স্বাস্থ্য আধিকারিক পদে নিয়োজিত এক ডাক্তারও উত্তর কলকাতার অলিতে গলিতে ঘুরে রোগী খুঁজে বেড়াচ্ছেন। রোগ থেকে বাঁচার পরামর্শ দিচ্ছেন। পথ্য কিনতে অপারগ রোগীকে নিজেই অর্থ তুলে দিচ্ছেন। এর পরে সেই বিদেশিনি ও চিকিৎসকের আলাপ হবে। কলকাতায় প্লেগের সংক্রমণ রুখতে ও মৃত্যুর হার কমাতে দু’জনে একজোট হয়ে কাজ করবেন। সেই আইরিশ মহিলা হলেন মার্গারেট এলিজ়াবেথ নোবেল, যিনি ভগিনী নিবেদিতা নামেই পরিচিত। স্বামী বিবেকানন্দের ডাকে তিনি কলকাতায় প্লেগ সংক্রমণের আগের বছরেই ভারতে এসেছেন এবং গুরুর শিবজ্ঞানে জীবসেবা মন্ত্রকে জীবনের ব্রত করেছেন। আর সেই চিকিৎসক ছিলেন রাধাগোবিন্দ কর।
১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসাশাস্ত্রে ডিগ্রীলাভ করে দেশে ফিরে আসেন।
ডা: রাধাগোবিন্দ কর ভারতে ফিরে আসলে কলিকাতায় একটি জাতীয় চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান তৈরীর উদ্দেশ্যে তিনি একটি বৈঠক আহ্বান করেন । ঐ সালের ১৮ অক্টোবর ডা: মহেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, ডা:অক্ষয় কুমার দত্ত, ডা: বিপিন বিহারী মৈত্র, ডা: এম্. এল. দে, ডা: বি. জি ব্যানার্জী এবং ডা: কুন্দন ভট্টাচার্য্যের মত কলিকাতার বিখ্যাত চিকিৎসকদের উপস্থিতিতে ঐ বৈঠকে ব্রিটিশ শাসকদের অধীনে সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে পৃথক একটি মেডিক্যাল স্কুল স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়।এই সিদ্ধান্ত থেকে ১৬১, বৈঠকখানা বাজার রোডে ক্যালকাটা স্কুল অব মেডিসিন প্রতিষ্ঠিত হয় এবং শীঘ্রই ১১৭, বৌবাজার স্ট্রীটে স্থানান্তরিত হয়।ডা: রাধাগোবিন্দ কর প্রথম সম্পাদক নির্বাচিত হন।
এশিয়ার প্রথম বেসরকারি মেডিক্যাল স্কুল নির্মানের পাশাপাশি তাঁর প্রধানতম অবদান বাংলায় চিকিৎসাশিক্ষার বিস্তার ঘটানো। সেইসঙ্গে যুক্ত হয়েছিল স্বদেশি ভাবধারা। বেঙ্গল কেমিক্যালের ওষুধ যাতে বাজারে সহজে ছড়িয়ে পড়তে পারে, সেই কাজে হাত বাড়িয়ে দিলেন তিনি।
রাধাগোবিন্দ কর বেশ কিছু ডাক্তারি বই রচনা করেছিলেন । এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ধাত্রীসহায়, ভিষক সুহৃদ, ভিষক বন্ধু, সংক্ষিপ্ত শারীরতত্ত্ব, কর সংহিতা, সংক্ষিপ্ত ভৈষজ্যতত্ত্ব, প্লেগ, স্ত্রীরোগচিকিৎসা, স্ত্রীরোগের চিত্রাবলী ও সংক্ষিপ্ত তত্ত্ব, গাইনিকল্যাজি, সংক্ষিপ্ত শিশু ও বাল চিকিৎসা, রোগীর পরিচর্যা প্রভৃতি ।
প্লেগের মতো মারণরোগের মোকাবিলায় নিজের জীবন বিপন্ন করে ঝাঁপিয়ে পড়া, মাতৃভাষায় চিকিৎসা বিজ্ঞানের বই লেখা ও সম্পাদনা, শত বাধা পেরিয়ে এশিয়ার প্রথম বেসরকারি মেডিক্যাল স্কুল স্থাপন— এ সমস্তই ছিল রাধাগোবিন্দ করের দেশ ও দেশবাসীর প্রতি ভালবাসা ও দায়িত্ববোধের পরিচায়ক।তাঁর সমস্ত কীর্তির কথা মাথায় বলাই যায় যে, রাধাগোবিন্দ কর ছিলেন উনিশ শতকের বাংলায় প্রকৃত রেনেসাঁ পুরুষ।
১৯১৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন রাধাগোবিন্দ কর। এই কর্মবীর চিকিৎসকের মৃত্যুর পরে কেটে গিয়েছে একশো বছরেরও বেশি। জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর পরেও তিনি তাঁর প্রাপ্য যথার্থ সম্মান পেয়েছেন, এ প্রমাণ মেলে না।
আজ বহু মানুষের ভরসা ‘আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ এন্ড হাসপাতাল ‘ । কেউ ফেরেন, কেউ ফেরেন না। কিন্তু সবার অলক্ষে বসে আছেন যে মানুষটি, তাঁর কথা অনেকেই ভুলে গেছেন। অথচ তিনি না থাকলে এর কিছুই হত না। মাতৃভাষায় ডাক্তারি শিক্ষার শুরুটাও বোধহয় অনেক দেরিতে হত। বিস্মৃত বাঙালি হয়েই হাসপাতাল প্রাঙ্গণে মূর্তি হয়ে আছেন ডাঃ রাধাগোবিন্দ কর, নিজেরই নামের তলায়।
এখন সংবাদ পরিবার এই মহান মানুষটিকে তাঁর জন্মদিনে জানায় শতকোটি প্রণাম