Select Language

[gtranslate]
৮ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ বুধবার ২২শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

বিশ্ব মানবতার মূর্তিমতী জীবন্ত বিগ্রহ মাদার টেরিজাকে শ্রদ্ধাঞ্জলী ।

ধর্ম-বর্ণের বেড়াজাল ভেঙে তিনি ছিলেন সবার ‘মাদার’৷ তিনি ছিলেন স্বার্থহীন সেবার মূর্ত প্রতীক৷মেরি টেরিজা বোজাঝিউ, যিনি মাদার টেরিজা বা তেরেসানামে অধিক পরিচিত ।ছিলেন একজন আলবেনীয়-বংশোদ্ভুত ভারতীয় ক্যাথলিক সন্ন্যাসিনী এবং ধর্মপ্রচারক। টেরিজার জন্মস্থান অটোমান সাম্রাজ্যের আলবেনিয়া রাজ্যের স্কপিয়ে।১৯১০ সালের ২৬ আগষ্ট তিনি জন্ম গ্রহন করেন। তবে ২৬ আগস্ট জন্ম হলেও তিনি ২৭ আগস্ট তারিখটিকে তার “প্রকৃত জন্মদিন” মনে করতেন; কারণ ওই তারিখে তাঁর খ্রীষ্ট ধর্মে সন্ন্যাস গ্রহন সম্পন্ন হয়েছিল।পিতা মাতা উভয়ই আলবেনিয়ান ।এক সচ্ছল কৃষক পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন মাদার ।

১৯১৯ সালে মাত্র আট বছর বয়সে তার পিতৃবিয়োগ হয়। পিতার মৃত্যুর পর তার মা তাকে রোমান ক্যাথলিক আদর্শে লালন-পালন করেন। জোয়ান গ্র্যাফ ক্লুকাস রচিত জীবনী থেকে জানা যায়, ছোট্টো অ্যাগনেস ধর্মপ্রচারকদের জীবন ও কাজকর্মের গল্প শুনতে বড়োই ভালবাসতেন। ১২ বছর বয়সেই তিনি ধর্মীয় সন্ন্যাস জীবন যাপনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন।১৮ বছর বয়সে তিনি গৃহত্যাগ করে একজন ধর্মপ্রচারক হিসেবে যোগ দেন সিস্টার্স অফ লোরেটো সংস্থায়। মা আর দিদিদের সঙ্গে আর তার কোনোদিন দেখা হয়নি।

১৯৩১ সালের ২৪ মে তিনি সন্ন্যাসিনী হিসেবে প্রথম শপথ গ্রহণ করেন। এই সময় তিনি ধর্মপ্রচারকদের পৃষ্ঠপোষক সন্ত টেরিজা ডে লিসিয়াস এর নামানুসারে টেরিজা নাম গ্রহণ করেন।১৯৩৭ সালের ১৪ মে পূর্ব কলকাতায় একটি লোরেটো কনভেন্ট স্কুলে পড়ানোর সময় কলকাতার দারিদ্র্যে তিনি উত্তরোত্তর উদ্বিগ্ন হয়ে উঠতে লাগলেন। পঞ্চাশের মন্বন্তরে শহরে নেমে আসে অবর্ণনীয় দুঃখ আর মৃত্যু; ১৯৪৬ সালে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গাতেও বহু মানুষ মারা যান। এই সব ঘটনা টেরিজার মনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে।

১৯৪৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর ধর্মীয় নির্জনবাসের জন্য দার্জিলিং যাওয়ার সময় তার মধ্যে এক গভীর উপলব্ধি আসে। এই অভিজ্ঞতাকে পরবর্তীতে “আহ্বানের ভিতরে আরেক আহ্বান” হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। এ নিয়ে তিনি বলেছিলেন,

“কনভেন্ট ত্যাগ করে দরিদ্রদের মাঝে বাস করা এবং তাদের সহায়তা করা আমার জন্য আবশ্যক ছিল। এটা ছিল এক সরাসরি আদেশ। এই আদেশ পালনে ব্যর্থ হওয়ার অর্থ ছিল বিশ্বাস ভেঙে ফেলা


১৯৪৮ সালে দরিদ্রের মাঝে ধর্মপ্রচার কাজ শুরু করেন। প্রথাগত লোরেটো অভ্যাস ত্যাগ করে পোশাক হিসেবে পরিধান করেন নীল পারের একটি সাধারণ সাদা সুতির বস্ত্র। এ সময়ই ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণ করে বস্তি এলাকায় কাজ শুরু করেন। মাত্র ১২ জন সদস্য নিয়ে ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ৭ অক্টোবর ‘মিশনজ অব চ্যারিট’ প্রতিষ্ঠা করেন । যার শাখা বর্তমানে পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে আছে। সমাজে অবহেলিত বঞ্চিত অনাথ শিশুদের জন্য গড়লেন নির্মলা শিশু ভবন। সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে জননী টেরিজার সেবাব্রত। গড়ে তোলেন ৬০ টি বিদ্যালয়,৫৫ টি কুষ্ঠ চিকিৎসা কেন্দ্র,২০ টি উদ্ধার আশ্রম,২ টি দাতব্য চিকিৎসালয়।

বিশ্বের অসংখ্য গৃহহীন ও অভাবী মানুষের জন্য তিনি ছিলেন একমাত্র আশার আলো। মানুষের জন্য তাঁর জীবন উত্‍সর্গ, ভালোবাসা ও যত্ন করার লক্ষ্যে দেশ ও ধর্মের কোনও বাধঁনে আবদ্ধ থাকেননি তিনি। আর্ত মানুষের যথার্থ একজন মা হয়ে উঠলেন তিনি। অসংখ্য অসহায় মানুষকে তিনি সযত্নে আশ্রয় দিয়েছিলেন।

মানুষের জন্যে নিজের জীবন উৎসর্গ করলেও তাঁকে কম সমালোচনা শুনতে হয়নি ।সমালোচকরা দাতব্য ধর্মপ্রচারক দলের সেবার নিম্নমান, বলপূর্বক ধর্মান্তর ও মৃত্যু পথযাত্রীদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষাদানের নিন্দা জ্ঞাপন করেছে এবং তাদের সাথে উপনিবেশবাদ ও বর্ণবাদের সম্পর্ক পেয়েছে।টেরিজার সঙ্ঘের ‘সবকিছুই ছিল খ্রিস্টান হবার শর্তে’ – সে খাবার হোক বা শোবার জায়গা হোক। টেরিজা গণযোগাযোগ মাধ্যমে আলোচিত ছিলেন। অনেক সমালোচক মনে করেন, ক্যাথলিক চার্চ খ্রিস্টানধর্ম প্রচার ও সমালোচনার মোকাবেলা করতে টেরিজার ভাবমূর্তি ব্যবহার করেছে।যদিও এসব কিছুই উপেক্ষা করেছেন মাদার নীরবে

মাদার টেরিজা ১৯৭১ এ শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কারে পুরস্কৃত হন যার অর্থ তিনি আর্তদের সেবায় উৎসর্গ করেছিলেন । নোবেল ছাড়াও ১৯৬২ তে ‘পদ্মশ্রী’, ১৯৭২ এ ‘নেহেরু ‘পুরস্কার, ১৯৮০ তে ভারতরত্ন উপাধি এবং বিশ্বভারতীর ‘দেশিকোত্তম’ উপাধি পান। এছাড়া ম্যানিলা থেকে পেয়েছেন ‘ম্যাগসাইসাই’, ভ্যাটিকান সিটি থেকে ২৩-তম পোপ জন পুরস্কারে সম্মানিত হন ।

অসুস্থতার কারনে ১৯৯৭ সালের ১৩ মার্চ মিশনারিজ অফ চ্যারিটির প্রধানের পদ থেকে সরে যান। ১৯৯৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর জ্যোতির্ময়ী  এই নারী অমৃতলোকে যাত্রা করেন।

১৯৯৮ সালে এক উপজাতি মহিলাকে দুরারোগ্য রোগের হাত থেকে বাঁচিয়ে তোলায় ২০০৩-এ মাদার টেরিজার আলৌকিক ক্ষমতার প্রথম স্বীকৃতি দেন তত্কালীন পোপ দ্বিতীয় জন পল। একইভাবে ২০০৮ সালে দুরারোগ্য মস্তিষ্কের অসুখে আক্রান্ত মৃতপ্রায় এক ব্রাজিলিয়ানকে সারিয়ে তুলেছিলেন মাদার।২০১৫ সালে এই ঘটনাটিকেও স্বীকৃতি দেন পোপ ফ্রান্সিস। মৃত্যুর ১৯ বছর পরে সন্ত ঘোষণা করা হয় মাদার টেরেজাকে।

মাদার টেরিজার কাছে জীব সেবাই ছিল শিবসেবা। দুঃস্থ  মানুষকে সেবার মধ্যে তিনি পেয়েছিলেন ঈশ্বরকে। তিনি খ্রিষ্টান ক্যাথলিক ধর্মে দীক্ষিত হলেও তিনি ছিলেন সমস্ত জাতি -ধর্ম -বর্ণের ঊর্ধ্বে ।এমন অক্লান্ত  কর্মপ্রচেষ্টা ,অখন্ড  আত্মবিশ্বাস, ঐকান্তিক   ভক্তি অথচ শিশুর মতো সহজ সরলতা মানব ইতিহাসে খুব কমই দেখা গেছে।

দয়াময়ী মাতৃস্বরূপা মাদার টেরিজাকে এখন সংবাদ পরিবারের সশ্রদ্ধ প্রণাম।

ekhansangbad
Author: ekhansangbad

Related News

Also Read