মহাত্মা গান্ধীর আগে তিনিই ছিলেন ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতা। একই সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদ ও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে আন্তর্জাতিকভাবে এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব।খুবই অল্প বয়স থেকে তিনি এমন সব প্রগতিশীল কাজের জন্য আন্দোলন করেছেন, যেগুলো মোটেই জনপ্রিয় ছিল না।ভারতীয়দের মধ্যে তিনিই প্রথম ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য।দাদাভাই নওরোজি।নামটি আজকের যুগে বেশীর ভাগ ভারতীয়ের কাছে অপরিচিত।
বোম্বের তুলনামূলকভাবে দরিদ্র এক পরিবারে ১৮২৫ খ্রীষ্টাব্দের ৪ সেপ্টেম্বর নওরোজির জন্ম। তবে ‘ফ্রি পাবলিক স্কুল’ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা তখন চলছে, সেটির সুবিধাভোগী ছিলেন তিনি। এজন্যে তিনি আজীবন বিশ্বাস করেছেন, বিনামূল্যে শিক্ষালাভের যে সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন, সেই নৈতিক ঋণ একমাত্র পরিশোধ করা যেতে পারে জনসেবার মাধ্যমে।
১৮৪০ এর দশকেই তিনি ভারতে মেয়েদের জন্য স্কুল খুলেছেন। এজন্যে তাকে গোঁড়া ভারতীয়দের রোষের শিকার হতে হয়েছে।তিনি তৎকালীন সমাজকারদের বুঝিয়েছিলেন “ সবাই একদিন বুঝতে পারবে, এই পৃথিবীতে পুরুষরা যত ধরণের অধিকার ভোগ করে, যত ধরণের সুযোগ পায়, যত ধরণের দায়িত্ব পালন করে, নারীদেরও এর সব কিছুতে সমান অধিকার আছে।”
তার এই উদ্যোগের পাঁচ বছরের মধ্যেই বোম্বের স্কুলগুলো মেয়েদের কোলাহলে ভরে উঠেছিলো। দাদাভাই নওরোজি তখন তার লক্ষ্য ঠিক করেন নারী-পুরুষের সমান অধিকারের দাবিতে সোচ্চার হবেন।
১৮৫৫ সালে দাদাভাই নওরেজি প্রথম বারের মতো ব্রিটেন সফরে আসেন।পরবর্তী বছর ইউনিভার্সিটি কলেজ অব লন্ডনে গুজরাটি ভাষা বিভাগের অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হন।
ব্রিটেনে এসে সম্পদের প্রাচুর্য এবং সমৃদ্ধি দেখে তিনি হতবাক হয়ে যান। তখন তার মনে প্রশ্ন জাগে, তার নিজের দেশ কেন এত দরিদ্র।তিনি যুক্তি দিয়ে দেখালেন, ব্রিটিশ শাসনের কারণেই ভারতের অর্থনীতিতে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, ভারত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, ভারতে একের পর এক ভয়ংকর দুর্ভিক্ষ হচ্ছে। তার এই কথায় প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়েছিল ব্রিটেনের অনেক মানুষ। তারা দাদাভাই নওরোজির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতা এবং আনুগত্যহীনতার অভিযোগ আনলো। ব্রিটেনেরই একটি উপনিবেশের লোক প্রকাশ্যে এরকম একটা কথা বলতে পারে, এটা তারা বিশ্বাসই করতে পারছিল না।
লন্ডনের প্রবাস জীবনেই তিনি রাজনীতির সাথে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েন। ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় ভারতীয়দের অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়ার দাবিতে তিনি আন্দোলন শুরু করেন এবং ভারতবর্ষের সমস্যাদি ইংরেজদের সামনে তুলে ধরার অভিপ্রায় থেকে অন্যান্যের সহযোগিতায় গড়ে তুলেন লন্ডন ইন্ডিয়ান সোসাইটি। ১৮৬৯ সালে তিনি স্বদেশে ফিরে আসেন। দাদাভাই নওরোজি ১৮৮৫ সালে বোম্বাই শহরে অনুষ্ঠিত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সর্বপ্রথম অধিবেশনে যোগ দেন। পরে তিনি ইংল্যান্ডে যান এবং ১৮৯২ সালের নির্বাচনে মধ্য-ফিন্সবেরি এলাকা থেকে উদারনৈতিক দলের সদস্য হিসেবে পার্লামেন্টে নির্বাচিত হন। ১৯০৬ সালে কংগ্রেসের কলিকাতা অধিবেশনে দাদাভাই দলের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং এই অধিবেশনেই তিনি ভারতের স্বায়ত্তশাসনের দাবি প্রথম উত্থাপন করেন।
যখন দাদাভাই নওরোজি ভারতে স্বরাজের দাবি তুলেছিলেন, তখন তার বিশ্বাস ছিল এটি অর্জন করতে ৫০ হতে একশো বছর সময় লাগবে।দাদাভাই নওরোজি যখন স্বরাজের দাবি করছেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্য তখন তার শিখরে। আর বেশিরভাগ ভারতীয় তখন এতটাই দরিদ্র আর ক্ষুধার্ত যে ‘স্বশাসন’ নিয়ে ভাবনার সময় যেন তাদের নেই।
আজ থেকে প্রায় ১৫০ বছর আগে তার মতো একজন ‘কালো মানুষ’ এর ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হওয়া এবং এই পরাধীন দেশের দরিদ্র আর ক্ষুধার্ত মানুষদের মনে স্বাধীনতার আগুন জ্বলাতে সলতে পাকানোর প্রচেষ্টা চালানো কতটা কঠিন আজকের ডিজিটাল যুগের মানুষদের কাছে কল্পনার অতীত।
“গ্রান্ড ওল্ড ম্যান অফ ইন্ডিয়া” এবং “আন-অফিসিয়াল অ্যাম্বাসাডার অফ ইন্ডিয়া” উপাধিতে ভূষিত দাদাভাই নওরোজি ১৯১৭ সালের ৩০ জুন ৯১ বছর বয়সে বোম্বাইতে প্রয়াত হন।
স্বাধীনতার ৭৫ বছরের আলোকেও অন্ধকারে থেকে যাওয়া দাদাভাই নওরোজিকে এখন সংবাদ পরিবারের শতকোটি প্রণাম