Select Language

[gtranslate]
৮ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ বুধবার ২২শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

বাংলা সাহিত্যে কল্পবিজ্ঞানের পথিকৃৎ জগদানন্দ রায়কে শ্রদ্ধাঞ্জলী।

সুস্মিত মিশ্র
‘জগদানন্দ বিলান জ্ঞান/ গিলান পুঁথি ঘর-জোড়া।/ কাঁঠাল গুলান কিলিয়ে পাকান,/ গাধা পিটিয়ে করেন ঘোড়া’

জগদানন্দ রায়।ঊনবিংশ শতাব্দীর কল্পকাহিনী রচনার অগ্রদূত ছিলেন জগদানন্দ । ঊনবিংশ শতাব্দীতে নবজাগরণের সময়ে যে বিজ্ঞানচর্চার সূত্রপাত ঘটেছিল তারই ফসল ছিল বিজ্ঞানভিত্তিক কল্পকাহিনী যাঁর জনক জগদীশচন্দ্র বসু হলেও কল্পবিজ্ঞানের পথিকৃৎ ছিলেন জগদানন্দ রায়।তিনি একাধারে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আর অন্য দিকে বিজ্ঞানভিত্তিক সাহিত্য রচয়িতা। জগদানন্দ রায়ের লেখা ‘শুক্র ভ্রমণ’ বাংলা সাহিত্যে কল্পবিজ্ঞানের এক অন্যতম নিদর্শন।


১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা অভয়ানন্দ রায় ছিলেন কৃষ্ণনগরের জমিদার।  মায়ের নাম বসন্তসুন্দরী।

১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দে স্থানীয় বিদ্যালয় থেকেই প্রবেশিকা এবং ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে কৃষ্ণনগর কলেজ থেকে এফ.এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি সাধারণ মানুষের বিজ্ঞান চেতনা গড়ে তোলার জন্য সরল বাংলায় বিজ্ঞান বিষয়ক রচনা প্রকাশ করতে থাকেন।


গড়াই-এর মিশনারি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার মধ্যে দিয়ে কর্মজীবন শুরুকরেন জগদানন্দ। বিজ্ঞান-বিষয়ক প্রবন্ধ রচনার হাতেখড়ি ছাত্রাবস্থাতেই। সাধনা পত্রিকায় প্রকাশিত তার প্রবন্ধের সুত্র ধরেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচিতি।

জগদানন্দের লেখা পড়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন—‘‘আমি তখন ছিলাম ‘সাধনা’র লেখক এবং পরে তার সম্পাদক। সেই সময়ে তার সঙ্গে আমার পরিচয়ের সূত্রপাত। ‘সাধনা’য় পাঠকদের তরফ থেকে বৈজ্ঞানিক প্রশ্ন থাকতো। মাঝে মাঝে আমার কাছে তার এমন উত্তর এসেছে, যার ভাষা স্বচ্ছ সরল— বৈজ্ঞানিক প্রসঙ্গে এমন প্রাজ্ঞল বিবৃতি সর্বদা দেখতে পাওয়া যায় না। পরে জানতে পেরেছি, এগুলি জগদানন্দের লেখা। তিনি তাঁর স্ত্রীর নাম দিয়ে লেখা পাঠাতেন। একদিন যখন জগদানন্দের সঙ্গে পরিচয় হলো তখন তার দু:স্থ অবস্থা এবং শরীর রুগ্ন। আমি তখন শিলাইদহে বিষয়কর্মে রত। সাহায্য করিবার অভিপ্রায়ে তাঁকে জমিদারি কর্মে আহ্বান করলাম।…. মনে আক্ষেপ হলো— জমিদারি সেরেস্তা তাঁর উপযুক্ত কর্মক্ষেত্র নয়।…. তখন তাঁকে অধ্যাপনার ক্ষেত্রে আহ্বান করে নিলুম শান্তিনিকেতনে।’’


গল্প দু-চারটির বেশি না লিখলেও ছোটদের জন্য জগদানন্দ রায়ের বিজ্ঞান বিষয়ক গদ্য রচনার সংখ্যা কম-বেশি ২৭৫। আঠারোটি মৌলিক গ্রন্থ এবং সতেরোটি পাঠ্যপুস্তকের প্রণেতা তিনি। রবীন্দ্রনাথের কথায়: ‘জগদানন্দ রায়ের নাম বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা আর তাদের বাপ-মা সকলেই জানেন। জ্ঞানের ভোজে এ দেশে তিনিই সর্বপ্রথম কাঁচা বয়সের পিপাসুদের কাছে বিজ্ঞানের সহজ পথ্য পরিবেশন করেছিলেন।’ 

১২৭ বছর আগে ‘ভারতী’ পত্রিকার কার্তিক ও অগ্রহায়ণ সংখ্যায় দুই কিস্তিতে প্রকাশিত হয়েছিল ‘শুক্র ভ্রমণ’। বাংলা ভাষায় কল্পবিজ্ঞানের প্রথম গল্প হেমলাল দত্তের ‘রহস্য’ ছাপা হয়েছিল তারও তেরো বছর আগে, ‘বিজ্ঞান দর্পণ’ পত্রিকায়। তবে বাংলা ছোটগল্পে ভিন্নগ্রহের প্রাণীর প্রথম আবির্ভাব এই ‘শুক্র ভ্রমণ’। সত্যজিতের ‘বঙ্কুবাবুর বন্ধু’ অ্যাং দেখা দেবে এর ঠিক সাড়ে ছয় দশক পরে।

১৩৩০ বঙ্গাব্দে নৈহাটিতে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের বিজ্ঞান শাখার সভাপতি ছিলেন জগদানন্দ। অভিভাষণে বলেছিলেন: “বিজ্ঞানের শিক্ষা যখন আমাদের দেশের সর্ব্বসাধারণের অস্থি-মজ্জায় আশ্রয় গ্রহণ করিবে, তখন বুঝিব দেশে বিজ্ঞানের চর্চা সার্থক হইয়াছে।”



কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষক ছিলেন দীর্ঘ দিন। জীবনের অন্তিম পর্বে বীরভূম জেলা বোর্ড ও লোকাল বোর্ডের সভ্য হন, এমনকি বোলপুর ইউনিয়ন বোর্ড বেঞ্চকোর্টের সাম্মানিক ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব সামলেছেন। সব ভূমিকার পরেও বিজ্ঞানের বার্তা প্রচার করাকেই তিনি জীবনের প্রধান কর্তব্য বলে মনে করতেন।১৯৩৩-এর ২৫ জুন ৬৪ বছর বয়সে প্রয়াত হন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর শ্রাদ্ধবাসরে বলেছিলেন: “তাঁর কাজ আনন্দের কাজ ছিল, শুধু কর্তব্যের নয়। তার প্রধান কারণ তাঁর হৃদয় ছিল সরস, তিনি ভালবাসতে পারতেন।”

নীরবে চার বছর আগে পেরিয়ে গেল তাঁর জন্মের সার্ধশতবর্ষ। বিজ্ঞান সাধক গুরুদেব জগদানন্দ রায়কে এখন সংবাদ পরিবার জানায় শতকোটি প্রণাম

ekhansangbad
Author: ekhansangbad

Related News

Also Read