সুস্মিত মিশ্র
“নারী হি জননী পুংসাং নারী শ্রীরুচ্যতে বুধৈঃ।
তস্মাৎ গেহে গৃহস্থানাং নারীশিক্ষা গরীয়সী।”
আজ থেকে প্রায় ১২৫ বছর আগে তিনি বাংলার চটকল শ্রমিকদের কাছে ‘বীর মা’ তথা মাইরাম নামে পরিচিত ।ভারতের প্রথম শ্রমিক নেত্রী।অসহযোগ আন্দোলন,খিলাফত আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন, ও নারীর শিক্ষা ও স্বাধীকার প্রতিষ্ঠায় নেত্রীর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। খিলাফত আন্দোলনে তার একনিষ্ঠ কাজের জন্য মুসলমান সম্প্রদায় তাকে খিলাফত মেমসাব বলে সম্বোধন করত।অথচ দেশের স্বাধীনতার ৭৫ বছর বর্ষের আনন্দ সমারোহেও আড়ালেই থেকে গেলেন এক অত্যন্ত ব্যতিক্রমী স্বাধীনতা সংগ্রামী সন্তোষকুমারী দেবী।
১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ১৩ জানুয়ারি ব্রিটিশ ভারতের তৎকালীন অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার কাঁথি শহরে তার মাতুলালয়ে জন্ম গ্রহন করেন সন্তোষকুমারী ।পিতা ছিলেন ব্যারিস্টার প্রসন্নকুমার রায়। মাতা নগেন্দ্রবালা ছিলেন কলকাতার নামকরা বিচারক ও স্বদেশপ্রেমী ব্যক্তিত্ব অক্ষয়কুমার সেনের কন্যা। তিনিও ছিলেন স্বদেশপ্রেমী ও জনদরদী মহিলা।
সন্তোষকুমারী দেবীর পৈত্রিক ভিটে ছিল নৈহাটির গড়িফা অঞ্চলে। তাঁর বাবা ছিলেন সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মী। চাকরিসূত্রে তাঁকে যেতে হয়েছিল রেঙ্গুনে। রেঙ্গুনেই তাঁর লেখাপড়া।তার বিদ্যালয়ের পাঠ মৌলামাইনেরই আমেরিকান মিশনারী স্কুলে। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে স্কুলে তার বারো বৎসর বয়সেই স্বদেশপ্রেমের পরিচয় পাওয়া যায়। বিদ্যালয়ে প্রতিদিন পিয়ানোসহযোগে প্রার্থনা সঙ্গীত গাওয়া হত- “রুল ব্রিটানিয়া, ব্রিটানিয়া রুল দি ওয়েভস”। সন্তোষকুমারী কিন্তু গানটি গাইতে অস্বীকার করেন। তাকে প্রশ্ন করা হলে উত্তর দেন –
আমি একজন ভারতীয়, আমি দাস হতে চাই না, তবে কেন আমি এ গান গাইব? আমাদের দেশ ইংরাজের অধীন বলে বিদেশীরা আমাদের সবাইকে নেটিভ বলে, হেয় করে। আমি কেন সে দেশের রানির বন্দনাগীত গাইব স্কুলে?”
অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী হিসেবে কৃতিত্ত্বের সঙ্গে সিনিয়র কেমব্রিজে উত্তীর্ণ হন এবং ইংল্যান্ডে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পান। কিন্তু জাতীয়তাবাদী নানা কাজকর্মে লিপ্ত থাকার কারণে ছাড়পত্র মেলেনি তার। উচ্চ শিক্ষার জন্য ইংল্যান্ড যাত্রা রুখে দিয়ে ব্রিটিশ পুলিশ তাঁকে নজরবন্দী করে।অতঃপর বিদ্যাশিক্ষার পাঠ সেখানেই শেষ করে স্থানীয় বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকরি নেন এবং সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটির ব্রহ্মদেশ শাখার সদস্য হন।
বর্মার কংগ্রেস দলের প্রতিনিধি হয়ে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে দিল্লিতে কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে এবং ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে আহমেদাবাদের অধিবেশনে যোগ দেন। তেজোদীপ্ত বক্তৃতা ও অন্যান্য কাজে উল্লেখযোগ্য কংগ্রেসকর্মীর কর্তব্য পালন করেন। ভালো বক্তা হিসাবে সেসময়ে মহিলা জননেত্রীদের মধ্যে ইংরেজী বক্তৃতায় সরোজিনী নাইডুর পরই তার স্থান ছিল। কাজ শুরু করলেন লালা লাজপত রায়, মতিলাল নেহেরু, সুভাষচন্দ্র বসু, সরলা দেবী চৌধুরানী, সরোজিনী নায়ডু, অ্যানি বেসান্ত প্রমুখের সঙ্গে।
স্বদেশপ্রেমের নানা আন্দোলনের মাঝে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে তিনি দেখেন বাংলার সাধারণ মানুষের মধ্যে, অত্যাচারিত তাঁতচাষীদের মধ্যে,কৃষকদের মধ্যে ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব বাড়ছিল।১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে আরো অনেকের সঙ্গে মিলে গড়ে তোলেন বেঙ্গল জুট ওয়ার্কার্স অ্যাসোসিয়েশন।শ্রমিকেরা তাকে ভালোবেসে মাইজি বা মাইরাম বলে ডাকতেন। চটকল শ্রমিকদের আন্দোলন ছাড়াও তিনি দেশের অন্যান্য শ্রমিক আন্দোলন যেমন– ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের আসামের চা-বাগানের কুলি ধর্মঘট, ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দের বেঙ্গল নাগপুর রেল ধর্মঘট প্রভৃতিতে অন্যতম নেত্রী হিসাবে কাজ করেন।
শ্রমিকদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটানোর জন্য শ্রমিক মহল্লায় নৈশ বিদ্যালয় খোলেন। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে সুভাষচন্দ্র বসু তাকে কলকাতা কর্পোরেশনের শিক্ষা কমিটির সদস্য মনোনীত করে নেন। এছাড়াও শ্রমিকদের সচেতন ও রাজনৈতিক শিক্ষার গুরুত্ব বিষয়ে সচেতন করাতে চিত্তরঞ্জন দাশের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দেই নিজ সম্পাদনায় প্রকাশ করেন সাপ্তাহিক শ্রমিক পত্রিকা। প্রতি বৃহস্পতিবার কলকাতার শ্রীসরস্বতী প্রেস থেকে এক পয়সা মূল্যের পত্রিকাটি বের হত বাংলা, হিন্দি ও উর্দু এই তিন ভাষাতে।
আমৃত্যু নীরবে সমাজের দুঃস্থ মানুষের সেবা করে গেছেন। তার গরিফার বাড়িতে চরকা বসিয়ে গ্রামের দুঃস্থ মহিলাদের দ্বারা পারিশ্রমিকে সুতো কাটাতেন। তাদের নিয়ে তিনিই প্রথম স্বনির্ভর গোষ্ঠী তৈরি করেন।
বাংলার মহিয়সী শ্রমিক নেত্রী সন্তোষকুমারী ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দের ১৯ সেপ্টেম্বর প্রয়াত হন।জন্মের ১২৫তম বার্ষিকী তথা স্বাধীনতার ৭৫ বছর পালনের সময় ইতিহাসচর্চায় অনেকটা উপেক্ষিতই থেকে গেলেন সন্তোষকুমারী দেবী।
পরাধীন ভারতে কাঁথির মাটিতে জন্ম নেওয়া এই মহান শ্রমিক নেত্রীকে শতকোটি প্রনাম জানায় এখন সংবাদ পরিবার