আলোকরেখা চক্রবর্তী :- কোনো প্রত্যাশা ব্যতিরেকে নিজের সব টা যিনি দিতে পারেন তিনি হলেন মা। তাঁর স্নেহ পৃথিবীর সবথেকে মহার্ঘ্য বস্তু এবং অতুলনীয়। অন্য দিকে এই স্নেহের বর্ণনা করাও একটি কঠিন কাজ। কিন্ত কবি সর্বজয়া আচার্য নন্দ এই দুরহ কাজ টি সম্পন্ন করেছেন তাঁর ‘মাতৃ স্নেহ’ বইটির মাধ্যমে। সদ্যই এই বই টি পড়লাম। প্রাসঙ্গিক ভাবে বলি কোনো কিছু পাঠ করার পর পাঠকের মনে এক নতুন অনভূতি তৈরি হয় এবং সেই অনভূতির প্রকার অবশ্যই নির্ভরশীল। এটা বলার কারণ এই বই টি পড়ে আমার যে সুখানুভূতি হলো তা যেন আমার পূর্ব উপলব্ধ।হোক বাহুল্য তবু স্মৃতিটুকু ভাগ করে নেওয়া যেতেই পারে।
ঘটনা টি হলো কোনো এক খর দিনে ক্লান্ত-উত্তপ্ত দেহ-মন নিয়ে বসেছিলাম এক বট গাছের ছায়ায়। কারণ যাই হোক বৈজ্ঞানিক বা শাস্ত্রীয় সেই ছায়া ধীরে ধীরে আমার শরীর মন একেবারে শীতল করে দিয়েছিল। প্রশান্তির সেই আবেশ বহুদিন আমাকে আবিষ্ট করে রেখেছিল। তাই ‘মাতৃ স্নেহ’ বই এর স্রষ্টা কবি সর্বজয়া আচার্য নন্দ কে আমার আন্তরিক ভালোবাসা এমন একটি সুন্দর অনুভূতির পুনরায় উপলব্ধ করানোর জন্য।
তবে এ প্রসঙ্গে বলা উচিৎ একটি বই মুদ্রিত হয়ে পাঠকের হাতে এসে পৌঁছানোর জন্য আরও অনেকগুলো কৃতী হাতের ছোঁয়া থাকে। এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে এবং এঁদের মধ্যে আমি প্রথমেই যাঁর নাম নেবো তিনি হলেন ‘জ্বলদর্চি’পত্রিকার সম্পাদক ঋত্বিক ত্রিপাঠী। তাঁর সন্ধানী দক্ষতার জন্যই পাঠক এমন সুন্দর একটি বই উপহার হিসেবে পেয়েছেন। এছাড়াও সুপ্রচ্ছদের জন্য বিবেকানন্দ ভোজ মহাশয় এবং পার্থ অফসেটের বিশেষ ধন্যবাদ প্রাপ্য কারণ তাঁদের কুশলী দক্ষতা বই টির মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছে। আর এরপরে আমি যে দুজন গুণী মানুষের কথা বলবো তাঁদের একজন হলেন অবসর প্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক শ্রী কমলেশ ত্রিপাঠী মহাশয় এবং দ্বিতীয় জন অবসর প্রাপ্ত শিক্ষিকা উমা পাত্র মহাশয়া। তাঁদের লেখা মুখবন্ধ দুটি যেন দুই নির্ভরযোগ্য সেতু- কবি, কবিতা এবং পাঠকের- সাথে সম্বন্ধ স্থাপন করেছে। পুনরায় আমার নিজের একটি অভ্যেসের ব্যাপারে বলবার ইচ্ছে রোধ করতে পারলাম না। তা হলো নতুন কোনো বই হাতে পেলেই আমি সবার প্রথমে দেখি বই টি কাকে(বহুবচন ও হতে পারে)উৎসর্গ করা হয়েছে। কবি সর্বজয়া আচার্য নন্দ তাঁর বই টি তাঁর পুত্র, কন্যা এবং পুত্রবধূ কে উৎসর্গ করেছেন। মাতৃ স্নেহ বর্ষিত হবার উপযুক্ত আধার।
এবার বই এর মূল সম্পদ কবিতা গুলি নিয়ে কিছু বলতে চাইবো। যদিও কবির ভাবনা অনুসরণ করে বলা যায়,-
এ তো কবিতা নয়…
এ হ’ল হৃদয়ের ছন্দে লেখা
কিছু কিছু কথা….
ছোট ছোট অনুভূতি-
আবেগ ও উপলব্ধি..
রেশ ধরে বলা যায় পুরো বই জুড়েই তাঁর আবেগ ও উপলব্ধির বিস্তার। কবির হৃদয়ের গভীর ও সুসংহত চিন্তা রামধনুর মতো ছড়িয়ে আছে পাতায় পাতায়। যদিও তাঁর ভাবনার রামধনু তে সাত রঙের সাথে সাদা-কালো রঙের উপস্থিতিও(রামধনু রংপৃ-৬৩)বিদ্যমান।
তবে শুধুই আবেগ দিয়ে কবিতা গুলিকে মাপা যাবেনা। কবিতা গুলির ভেতর এক জীবন দর্শনের দেখা মেলে এবং এই দর্শন খুব সাধারণ নয় বরংএর বিপরীত, উচ্চ মার্গের। তাই কবি বলতে পারেন,-
এই দেহ নিয়ে বিলাসে ব্যাস্ততায়
কেটে যায় দিন-
চিন্তাতেই জানিনা-এর
স্থায়িত্ব-অস্তিত্ব কত ক্ষীণ….
………..। (পৃ-৩৪)।
এখানেই শেষ নয় আরও যে কয়েকটি বিষয়ে না বললে বিশ্লেষণ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে তা হলো কবির ভাবনার ব্যাপ্তি। যেমন এই যে তিনি মায়ের কথা বলেছেন এই মা শুধু তাঁর জন্মদাত্রী মা নয়। প্রকৃতির সব কিছুর মধ্যেই তিনি মায়ের অব্যক্ত ভালোবাসার খোঁজ পেয়েছেন। তাই তো তাঁর কলম বলে ওঠে,-
অনাদি অনন্ত কাল ধ’রে
মা রেখেছে বুক পেতে
শত কোটি সন্তানের তরে……. মাতৃ স্নেহ, পৃ-১১)।
এবং এই ব্যাপ্তির সাথে মিশেছে ভাবের সংবেদনশীলতা। তাই তো ‘নিগড়’ এ
কেন ঠেলে দাও দূরে-
কোন অপরাধে-
কেন ব্যাথা দাও বার বার-? (পৃ-৩১)
কিংবা ‘কে তারা'(পৃ-৮৫)তে বলে ওঠেন-
সমাজের বর্তমান প্রেক্ষাপটে
জীবনের অস্তিত্ব সংকটে
নরহত্যার…………।
আর উদাহরণ টেনে বইটির নতুনত্ব নষ্ট করবো না। শুধু বলবো এসব কিছু বাদ দিলেও শুধু কবিতা ভেবে নিয়েও বই টি সম্পূর্ণ পাঠ করা যায় কারণ প্রতিটি কবিতা এতো প্রাঞ্জল ভাবে লেখা যে পাঠের মন্দন ঘটে না বরং মনের ভার মুক্ত হয়।
প্রসঙ্গত বলি কবির জীবন যেন মাতৃ স্নেহ নিয়ে ধন্য এবং তাঁর কবিতার মাধ্যমে সেই মাতৃ স্নেহ সিঞ্চন করেও তিনি ধন্য।
পরিশেষে বলবো ‘বৃষ্টি’শব্দের প্রকৃত মূল্য তখন যখন তা বই এর পাতায় নয় গাছের পাতায় ঝরে পড়ে।
সব শেষে এটুকু বলার এই বই পড়ে তাঁরা আনন্দ পাবেন যাঁরা শুধুমাত্র কবিতা প্রেমী আর যাঁরা জীবনের অন্যরকম আস্বাদ নিতে চান তাঁরাও বিফল মনোরথ হবেন না এবং লেখিকা সর্বজয়া আচার্য নন্দ ও প্রকাশকের উপর কৃতজ্ঞ থাকবেন।