আমি রুমা আমাদের পরিবারের একটা ঘটনা খুব মনে পরে ৷
আমরা সাত ভাই বোন মা, বাবা ঠাকুমা মিলে মোট দশজন ৷
আমার ঠাকুমার ছিল নাতী-নাতনী অন্তপ্রান ৷
আমাদের আর্থিক অবস্থা তখন খুব খারাপ ৷ কোনো রকমে দিন অতিবাহিত হয় ৷
কোনোদিন গোটা ডিম প্রত্যেকের ভাগ্যে জুটতো না। ঐ দু-একটা ডিম ভেজে আলু দিয়ে ঝাল করে কপালে ফোটা দেওয়ার মত করে আমাদের ভাগ্যে জুটতো ৷ মায়ের ডিমে এলার্জি । ঠাকুমা নিরামিষ খায় ৷
আমার ঠাকুমা একদিন আটটা ডিম কিনে আনে। ঠাকুমা খেজুর পাতার চাটাই বুনতো ৷ সেই বাইশপাটির চাটাই বিক্রি করে আমাদের জন্য ডিম এনে, বলে বউমা ওদের জন্য ডিমের ঝোল ভাত করে দাও আর তোমার আমার জন্য ব্যাসমের (বেসনের) বড়ার ঝাল কোরো ৷
গোটা গোটা ডিমের ঝোল হবে শুনে আমাদের সে যে কি খুশি সে কাউকে বলে বোঝানোর নয় ৷
আমার এক বড়লোক পিসি আছে সে আমাদের দিকে অত ফিরেও তাকায় না ৷ আমাদের যে এত কষ্ট কোনোদিন কিছু সাহায্য করেনি উল্টে কিছু হাতিয়ে নিতে চায় ৷ সেই পিসিকে ঠাকুমা
দু-চক্ষে দেখতে পারে না ৷
কড়াইতে ডিমের ঝোল টকবক করে ফুটছে পিঁয়াজ রসুনের গন্ধে যেন বাড়ি আকুল করেছে ৷
বেলা এগারোটা বাজে তখন যেন আমাদের মনে হচ্ছে একথালা ভাত এক্ষুনি উড়িয়ে দেবো ৷
ঠাকুমা আমাদের গল্প বলে একজায়গায় বসিয়ে রেখেছে কারণ এখোনো ভাত বসেনি ৷
মা ডিমের ঝোল নামিয়ে এবার ভাত বসালো ৷
আমি বললাম মা আগে ডিমের ঝোল কেন করলে ভাতটা আগে হলে তো ভালো হোতো ।
আমরা আর থাকতে পারছি না ৷
মা বললো চালটা তোর ছেলে (মানে বাবা ) এইমাত্র কিনে এনেছে তাই ৷
মা একটা বাটিতে একটু ঝোল আলু দেবে ? সকলে ভাগ করে চেকে দেখবো ৷
সেই সময় পাশের বাড়ির এক কাকা সাইকেলের খুব বেল দিচ্ছে আমাদের দরজা গোড়ায়। শুনে সকলে ছুটে যাই ৷ সেই কাকা বললো এই রুমা তোর পিসি আর তার তিন ছেলে মেয়েকে বাস থেকে নামতে দেখলাম। এবার ভাতের চাল বেশি করে নিতে বল তোর মাকে ৷
তখন তো এত ফোনের ব্যবস্থা নেই তাই সবার বাড়িতেই প্রায় যখন তখন হুট-হাট কুটুমজন বিনা খবরে এসে পড়তো । বাড়ির লোক যে কি মুশকিলে পড়তো তা বলার নয় ৷
সেই সময় অনেক সংসারেই আর্থিক সচ্ছলতা ছিল না ৷
এই বাসট্যান্ড হচ্ছে আমাদের বাড়ি থেকে হেঁটে পনেরো কুড়ি মিনিটের পথ ৷
পিসি আসার খবর শুনে ঠাকুমা গেলো ভীষণ চটে ৷
সেদিন ঠাকুমা যা করলো ভাবলে আজও আমার খুব ভালো লাগে ৷
একটা জায়গায় আটটা ডিম ঝোল থেকে তুলে বলে তোরা সকলে এই তালে একটা করে খেয়েনে । এখুনি শোরের পাল (শুয়োরের পাল) এসে সব খেয়ে নেবে ৷ ওরা অনেক খায় ৷
বাবা বললো আমিও, সে কিগো মা !
আমার মা পড়লো ফাঁপরে কারন এতদিন নিজের ভাগের টা সকলকে খাইয়েই এসেছে কিন্তু আজ কি করবে ?
মায়ের ভাগের ডিমটা থাকলেও নয় ওদের ভাগ করে দেওয়া যেত ৷সকলের ভাতের ক্ষিদে, ডিমের ঝোল হচ্ছে তার আকর্ষন ৷
সেই ডিম ছাড়া ঝোল দুপুরের আশায় গামলার তলায় একটু খানি আলুর দমের মত পরে রইলো- এ দৃশ্য বড়ই করুন ৷
সেদিন ঠাকুমার কথায় সকলে ভাত ছাড়া ডিম খেয়ে নিয়েছিলাম ঠাকুমার ভালোবাসায় ৷
সে দৃশ্য আজও আমার স্মৃতিপটে ভাসে ৷
পরে পিসিরা আসতে দুপুরে সকলে একসঙ্গে ভাত
খাই যতসামান্য উপকরণ দিয়ে ৷
তবে পিসি আসায় খুব আনন্দও হয়েছিল আমাদের। কারন পিসির ছেলে মেয়েরা আমাদের খেলার সঙ্গী ৷
-এই হলো সেদিনের ডিমের ঝোলের গল্প ৷
সৌজনে – প্রতিলিপি