Select Language

[gtranslate]
২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ শুক্রবার ১৮ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

মানিয়ে চলা

মানিয়ে চলা
জয়ন্ত ঘোষ

বুবু জোরে চিৎকার করতেই, বনশ্রী দৌড়ে চলে গেলো সামনের ঘরে | দুটো স্টিলের থালা আর ওর ওপর রাখা একটা গ্লাস পড়ে যেতেই শাশুড়ি মা আর ননদের তীব্র শাসনের সামনে ও বেশ জড়সড় হয়ে রয়েছে | তবে মাত্র মাস আষ্টেকের বয়সের একটা শিশু কি-ই বা করতে পারে ? চুপটি করে বসেছিল, মা আসতেই কান্নার সুরে অভিযোগ জানাতে অবশ্য ভোলে নি ! ওরাও বেশ তৈরিও ছিল, তাই প্রতিবাদের ভাষায় প্রশ্ন করেছিল,
-বৌমা, সাত সকালে একটু ওকে ধরে বেঁধে রাখতে পারো না ? প্রতিদিন হামাগুড়ি দিয়ে এসে এটা ভাঙছে আর না হয় সব কিছু ওলোট পালোট করে দিচ্ছে |
বনশ্রী ভেবেছিলো কোনো উত্তরই দেবে না, কিন্তু সবসময় চুপও তো থাকা যায় না, একটু মিনতির সুরে বলেও ফেললো,
-মা, আপনি তো জানেন আপনার ছেলে এই সময় বেরোয় | আমাকে সব কিছু রেডি করতে হয়, একটু না হয় ও এখানে এসেছে, আপনি একটু সামলাতে পারেন নি ?
ওরা দুজনে যেন ওৎ পেতে ছিল, চিৎকার করে বলে উঠলো,
-কেন ? হাঁড়ি আলাদা করার সময় তো এটা আমার, ওটা আপনার, এটা আমাদের ওটা আপনাদের বলেছিলে | এখন কেন বলোতো তোমার জিনিস আমাদের সামলাতে হবে ? আর ও তো দিন দিন বড়ো হচ্ছে, আর আগের মতন সামলানোও তো যায় না, বৌমা !

আর কোনো কথা বলতে পারে না, দৌড়ে বুবুকে নিয়ে ঘরে ঢোকে | তখনও ঋষি বেরোয় নি, বনশ্রীর রাগী মুখ দেখে হেসে জিজ্ঞেস করলো,
-কি ব্যাপার ? কি যুদ্ধ করে এলে শুনি ?
বনশ্রী অবাক হয়ে গেলো, বলে উঠলো,
-এই শোনো, সবসময় তোমরা আমাকে দোষারোপ করো কেন বলোতো ? যেন আমার জন্যই সব অশান্তি, দাও না আমায় একটা আলাদা ঘরের ব্যবস্থা করে, সব ঝামেলা মিটে যায় | আমি আমার মেয়েকে নিয়ে চলে যাই |
ঋষি বুঝতে পারে, অভিমানী বৌয়ের কিছু একটা হয়েছে, জিজ্ঞেস করে,
-মা কি কিছু তোমায় বলেছে আবার ?
বনশ্রী চুপ করে থাকে, বুবুর ছটপটানিতে ওকে খাটে ছেড়ে দিয়ে উত্তর দেয়,
-আচ্ছা তুমি সত্যি করে বলোতো, এই বাড়ির হাঁড়ি আলাদা হবার জন্য কি আমিই দায়ী ? তোমার মা, বোন সবাই সাধু পুরুষ ?
ঋষি হাসে, বলে,
-ও এই ব্যাপার ? তা তুমি কেন হবে ? দোষ আমাদের সবার ! শুধু তোমাকে এই জন্য অভিযোগ করলে লাভ হবে না !

বুবু খাটে পড়ে থাকা চুলের ক্লিপটা মুখে দিতে গেলেই, বনশ্রী চিৎকার করে ওঠে,
-না, একদম না ! ফেলে দাও !
বুবু হাঁ করে দেখে মায়ের মুখের দিকে | এই শাসন অন্যদিনের মতন আবদার মেশানো কেন নয়, এটা ভাবতেই বোধহয় ওর এই নিস্চুপ হবার মতন শরীরী ভাষা !

* * *
বুবুকে খাওয়াতে একটু সকাল সকালেই ঘুম ভেঙে যায় বনশ্রীর | কিন্তু আজ যেন অন্য রকমের ছবি ! পাশের ঘর থেকে বাসন কোসনের কোনো আওয়াজ নেই ! চিৎকার করে শাশুড়ি মায়ের রান্নার আইটেম শোনানোর ব্যাপার নেই ! ননদের মুখে রাজা-উজির মারার কথাও বনশ্রীর কানে আসছে না ! তাহলে, অবশ্য দু-তিন ধরে গ্যাস ফুরিয়ে আসবার কথা কানে এসেছিলো ! তাহলে তাই কি ?
তার অনুমান যে সঠিক ছিল, বেলা হতেই তা পরিষ্কার হয়ে যায় | ঋষি অফিস বেরুনোর সময় মুখ গোমড়া করে এসে বলে,
-এই শুনেছো, ওদিকে গ্যাস শেষ, বুকিং করলেও সাপ্লাই নেই এখনো !
বনশ্রী চুপ করে শোনে, খানিকক্ষণ বাদে উত্তর দেয়,
-আমি কিন্তু চারজনের ভাতই বসিয়ে দিয়েছি, ওনাদের বলে এসো, গ্যাস ফুরিয়ে গেলেও না খেতে পেয়ে মারা যেতে হবে না !
ঋষি মনে হয়, বনশ্রীর কথায় খুশি হলো, বলে উঠলো,
-তোমায় এই জন্যই আমার ভীষণ পছন্দ হয় বনশ্রী | পরিস্থিতি তোমায় কোনোদিনও বশ করতে পারে নি, তুমি পরিস্থিতিতে বশ করেছো !
বনশ্রী হাসি মুখে করজোড়ে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে বলে,
-আপনি কোনোরকম দুশ্চিন্তা না করেই কাজে বেরোতে পারেন, এই বাড়িতে আমি যতদিন থাকবো, কাউকে না খেতে পেয়ে মারা যেতে দোবো না !

* * *
আজ অনেকদিন পর সবাই মিলে খেতে বসেছে | ননদের মুখ দেখে বনশ্রী ওর পাতে আরও একটু তরকারি তুলে দেয় | শাশুড়ি মা অবশ্য চিৎকার করে ওঠেন,
-আরে করো কি বৌমা, তোমার তো মাত্র এক হাতা রয়ে গেলো | ভাতটা খাবে কি করে ? সবই তো আমাদের পাতে তুলে দিলে | আচ্ছা একটা ডিম না হয়ে ভেজে নাও, বুবুকে আমরা দেখছি !
বনশ্রী হাসি মুখে উত্তর দেয়,
-না মা, আপনারা দুজনে খাওয়া দেওয়ার পর বিশ্রাম নিন ! আমি আমার মেয়েকে সামলাচ্ছি !

দুপুরে বুবু ঘুমিয়ে পড়বার পর কয়েক মাস আগেকার স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে ওঠে বনশ্রীর | ঋষির অফিসে খুব গন্ডগোল চলায় বেশ কয়েক মাস ও প্রায় ঘরেই বসেছিল | শাশুড়ি মায়ের পেনশনে পুরো সংসারটাই কোনোমতে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো | এর জন্য অবশ্য কম কথাও শুনতে হয় নি, উঠতে বসতে ব্যাঁকা-ট্যারা কথা শুনতে শুনতে বনশ্রীর একদিন ধৈর্য্যর বাঁধ ভেঙে পড়ে ! একদিন বলেও ফেলে রাগের সুরে,
-মা, ঋষি আমি আর বুবু তো আপনার নিজেরই ছেলে, বৌ আর নাতনি ! দুদিন পর অফিসে ঝামেলা মিটে গেলে আবার ও জয়েন করবে | এই কটা দিন না হয় একটু কষ্ট করেই চালাবো ! বাবা মারা যাবার পর এই সংসারের সিংহভাগ টাকা তো ওই যোগান দিয়ে এসেছে !

উনি যেন ধরেই নিয়েছিলেন ঋষির অফিসে আর অশান্তি মিটবে না | ওনার নরম সরম স্বভাবের ছেলে কোনো জায়গায় যে খেটে রোজগার করবে, তার সম্ভাবনাও খুব কম দেখেছিলেন | বোধহয় তাই বলেই ফেলেছিলেন,
-বৌমা, এভাবে আমি চালাতে পারবো না | তোমরা বরঞ্চ আলাদা হয়ে যাও, যেভাবে হোক চালাও | আমি না হয় মাঝেমধ্যে তোমাদের হেল্প করবো | এই সামান্য কটা টাকা দিয়ে রাবনের গুষ্ঠি চালানোর ক্ষমতা আমার নেই !

* * *
হয়তো রাগের চোটেই উনি এই কথা বলে ফেলেছিলেন, তবুও সারা রাত দু চোখের পাতা একদম এক করতে পারে নি বনশ্রী | চোখের জল যে এতো লবনাক্ত, এতো উষ্ণ তা বোধহয় সেই রাতেই সে টের পেয়েছিলো | ঋষি ঘুমিয়ে পড়তে একটা ভাঙাচোরা স্টোভ আর কাজের মাসিকে দিয়ে জোগাড় করা কেরোসিনে নতুন সংসার চালানোর কথা প্রতিজ্ঞা করেছিল | তাই আজ যখন শাশুড়ি মা দুপুর বেলা ঘরে এসে হাতের ওপর হাত রেখে নিজের শতদোষ স্বীকার করার কথা বলে, বনশ্রী উত্তর দিয়েছিলো,
-মা, ধৈর্য্য এমন একটা গাছ, যার সারা গায়ে কাঁটা কিন্তু ফল অতি সুস্বাদু | আর অসাধারণ কাজগুলো যে অসীম ধৈর্য্য দিয়েই সম্পন্ন করতে হয় | আর আপনি এটা তো মানবেন আমি একদম অসফল হই নি !
উনি হাঁ করে বনশ্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন !

সৌজন্য – প্রতিলিপি

ekhansangbad
Author: ekhansangbad

Related News

Also Read