Select Language

[gtranslate]
২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ শুক্রবার ১৮ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

অসৎপথের গুরু পরিত্যাজ্য

কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী:-আপনি আপনার ইচ্ছামত যে কোন মঠ মন্দির এবং আশ্রম থেকেই দীক্ষা নিতে পারেন।কিন্তু দীক্ষা নেয়ার আগে, কাউকে গুরু বলে মেনে নেয়ার আগে; আপনার কয়েকটি প্রয়োজনীয় বিষয় মনে রাখতে হবে। যে মঠ, মন্দির এবং আশ্রমে বেদ-গীতার নিরবচ্ছিন্ন চর্চা আছে; এমন কোন সম্প্রদায় থেকেই দীক্ষা নিবেন। তবে ঈশ্বরের পথে যথাযথভাবে চলতে পারবেন।যে সম্প্রদায়ের মধ্যে, বেদ-গীতা বাদ দিয়ে শুধু ব্যক্তিকেন্দ্রিক গুরুবাদ এবং গুরুর পরিবারই শুধু পূজারবেদিতে রয়েছে ; তাদের থেকে কখনো দীক্ষা গ্রহণ করবেন না। দেববিগ্রহ বাদ দিয়ে শুধু গুরুকে এবং গুরুর অবর্তমানে তার পরিবার বা বংশধরদের পূজা করতে হবে -এ মতবাদটি অশাস্ত্রীয়। বেদ- বেদান্তকে দূরে ঠেলে দিয়ে গুরুর নামে সম্পূর্ণ ব্যক্তিসর্বস্ব মতবাদের আস্তানা যারা তৈরি করেছে তাদের থেকে সহস্রগুণ দূরে থাকবেন। এই স্বার্থান্বেষী ব্যক্তিকেন্দ্রিক গুরুবাদী ব্যক্তিরা নিজেদের গুরুগিরি ব্যবসার হীনস্বার্থে সাধারণ ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিদের বিভ্রান্ত করে বৈদিক মার্গ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। কারণ প্রজ্জ্বলিত বৈদিক জ্ঞানের স্থানে অন্ধকার থাকতে পারে না। অন্ধকার না থাকলে কুসংস্কার থাকতে পারে না। আবার সমাজ অন্ধকার কুসংস্কারাচ্ছন্ন না হলে মানুষকে প্রতারিত করা যায় না। এদের সকলের একটি ধারাবাহিক পর্যায়ক্রমিক অবস্থান রয়েছে।সামাজিক অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশ অবৈদিক ব্যক্তিকেন্দ্রিক গুরুবাদীদের বিবিধ প্রকারের অশাস্ত্রীয় দুষ্কর্মের জন্য উপযোগী। তারা শাশ্বত আলোকদীপ্ত বৈদিক পথকে ভয়ও পায়। তাই তারা তাদের নিজস্ব ব্যক্তিকেন্দ্রিক গুরুগিরি ব্যবসার স্বার্থে বেদ-বেদান্তের আলোকদীপ্ত পথকে রুদ্ধ করতে যথাসম্ভব প্রচেষ্টা করে।

ব্যক্তিকেন্দ্রিক মতবাদে গুরু নামক ব্যক্তিকে বাদ দিলে ঐ সম্প্রদায়ের কিছুই অবশিষ্ট থাকেনা। এমন স্থান থেকে দীক্ষা নেয়া অনুচিত। ভগবান আপনাকে একটা চিন্তার স্বাধীনতা দিয়েছে। সে স্বাধীনতাটা শুদ্ধাশুদ্ধ ব্যবহার করবেন। যদি আপনি চিন্তার স্বাধীনতাকে শুদ্ধভাবে ব্যবহার করতে না পারেন; তবে এর ভয়াবহ শিকার আপনি এবং আপনার পরিবার হবে।আপনি স্বাধীন, ভগবান আপনাকে চিন্তার স্বাধীনতা দিয়েছে। এ চিন্তার স্বাধীনতা আপনি কিভাবে ব্যবহার করবেন, তা আপনার উপরেই নির্ভর করছে।আমাদের শাস্ত্রের নিগূঢ়তম বিষয়গুলো পরিষ্কারভাবে বোঝার চেষ্টা করা প্রয়োজন। সাথে মত-পথ নির্বিশেষে ঈশ্বরের প্রতি সমর্পণ রাখা অত্যন্ত প্রয়োজন। সর্বদা সাধ্যমত বেদ-গীতা চর্চা করা প্রয়োজন। সাধ্যমত প্রতিদিন ওঙ্কার এবং গায়ত্রী মন্ত্রের জপ করা প্রয়োজন। চিন্তার অতীত পরমেশ্বরের প্রতীক ওঙ্কারের সর্বদা শরণে থাকা প্রয়োজন।

বাজার থেকে কিছু কিনলে আমরা দ্রব্যাদি ঠিক কি বেঠিক আসল না নকল, পরীক্ষা করে দেখি।সোনা কতটা খাদ মিশ্রিত আমরা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়েই তবেই ক্রয় করি,আগে নয়। জীবনের সকল কিছু যদি পরীক্ষা করে, তবেই আমরা গ্রহণ করি; তাহলে গুরু নির্বাচন করার সময় কেন আমরা গুরু সদগুরু নাকি ভণ্ড এ বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখব না? কিছু বুঝে উঠার আগেই কেউ একজন ধরে-বেঁধে দীক্ষা দিয়ে দিলেই কি আপনার দীক্ষা হয়ে গেল? কয়েকদিন আগে ধরে-বেঁধে দীক্ষা প্রসঙ্গে আমাদের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রের কাছে তাদের এলাকার একটি গল্প শুনলাম। আমি বিস্মিত হলাম, হতাশ হলাম গল্পটি শুনে। ছাত্রটি বললো, বান্দরবানে তাদের কয়েকজন বন্ধুদের ধরে-বেঁধে জোরজবরদস্তি করে দীক্ষা দেওয়ার জন্য এমনভাবে দীক্ষা নেয়ার কক্ষে ঢুকিয়েছে যে ওদের সাথে এক মুসলিম বন্ধু ছিল তাকে পর্যন্ত দীক্ষা দিয়ে দিয়ে দেয়া হয়েছে।দীক্ষার শেষে একটি কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলেছে, “তোমাদের দীক্ষা দেয়া হল, এখন থেকে প্রতি মাসে মাসে তোমরা ইষ্ট গুরুদেবের নামে আমাদের আশ্রমে টাকা পাঠাবে। মনে রাখবে প্রতিমাসের টাকাটি মাসের ত্রিশ তারিখের মধ্যেই পাঠাতে হবে; তা না হলে তোমাদের দীক্ষা ফলবান হবে না, নিস্ফল হয়ে যাবে।”

এমন করে দীক্ষা দেওয়া এবং নেয়ার প্রয়োজন নেই। এতে করে আমরা দীক্ষাকেই অপবিত্র এবং প্রশ্নবিদ্ধ করছি।দীক্ষা একটা পবিত্র বিধি, এ পবিত্র বিধিটিকে অপবিত্র করা নিষ্প্রয়োজন।এভাবে ব্যবসায়ী কায়দায় জোরজবরদস্তি করে লোক ধরে ধরে নিয়ে গর্তের মধ্যে ফেলাটা আধ্যাত্মিকতার সাথে যায় না। বিষয়টি শুধুই ব্যক্তিগত স্বার্থের। এভাবে করে আপনি পবিত্র দীক্ষা বিষয়টাকেই অবমূল্যায়ন করছেন। সদগুরু থেকে দীক্ষা নেয়ার সাথে সাথে মানুষ দ্বিজ হয়। দীক্ষাতে মানুষের দ্বিতীয় জন্ম হয়। কিন্তু দীক্ষা বিষয়টির সাথে যখন ব্যবসায়ী বা ব্যক্তিগত স্বার্থ যুক্ত হয়, তখন দ্বিতীয়বার জন্মের বিষয়টি দূরে থাক ; সম্পূর্ণ দীক্ষা এবং গুরুশিষ্য সম্পর্কটি নেতিবাচক হয়ে যায়। অনেক গুরুবাদি সংস্থার গুরুরা ‘মাল্টি লেভেল মার্কেটিং’ ব্যবসার মত শিষ্যদের টার্গেট দিচ্ছে। অমুক জায়গায় আমি যেতে পারি সেক্ষেত্রে নিম্নে পাঁচহাজার মানুষকে দীক্ষা নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে; তবে দশহাজার হলে ভাল হয়। গুরুর নির্দেশ দশহাজার মানুষকে দীক্ষা নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এ পাঁচ-দশহাজার মানুষ ছাড়া গুরু, তার বংশধর এবং অনুগামী গুরুরা সাধারণ মানুষের কাছে আসতে পারবেন না। এ ঘটনাগুলো সকলই আমাদের আশেপাশের, বেশি দূরের নয়। আপনি চোখ মেলে ভাল করে তাকালেই এ সকল চরিত্রদের আপনার আশেপাশেই দেখতে পাবেন।দীক্ষা নেয়ার আগে বেদান্তের সাথে শ্রীশঙ্করাচার্যের ‘বিবেক চূড়ামণি’ গ্রন্থটি পড়বেন। তখন উপলব্ধি করতে পারবেন যে, সদগুরু কতটা পবিত্র একটা বিষয়। কিন্তু সেই পবিত্র বিষয়টি কিছু মানুষের ব্যক্তিগত সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং যৌন স্বার্থে অপব্যবহারের ফলে ধীরেধীরে কলঙ্কের দাগ লেগে যাচ্ছে। দিনশেষে ক্ষতি হচ্ছে সম্প্রদায়ের।

শ্রোত্রিয়ােঽবৃজিনােঽকামহতাে যাে ব্রহ্মবিত্তমঃ। ব্রহ্মণ্যুপরতঃ শান্তো নিরিন্ধন ইবানলঃ। অহেতুকদয়াসিন্ধু্র্বন্ধুরানমতাং সতাম্৷৷
(বিবেক চূড়ামণি:৩৩)

“যিনি বেদজ্ঞ, নিষ্পাপ, নিষ্কাম ও শ্রেষ্ঠ ব্রহ্মবিদ, যাঁর মন বাহ্যবিষয় থেকে সরে এসে ব্রহ্মে স্থিত হয়ে আছে, যিনি ইন্ধনশূন্য জ্বলন্ত কাঠের আগুনের মত শান্ত ও তেজস্বী, যিনি অহেতুক দয়াসিন্ধু তিনি প্রণত সজ্জন ব্যক্তিদের কল্যাণকারী বন্ধু।”

সাধনায় সিদ্ধিলাভ করতে গেলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সদ্গুরুর প্রয়ােজন হয়। কিন্তু বর্তমানে সদগুরু পাওয়া দায়। সদগুরুর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে শ্রীশঙ্করাচার্য বলেছেন, “শ্রোত্রিয়ঃ অবৃজিনঃ অকামহতঃ যঃ ব্রহ্মবিত্তমঃ”; যিনি বেদজ্ঞ নিষ্পাপ নিষ্কাম আর শ্রেষ্ঠ ব্রহ্মবিদ, তিনিই গুরু হতে পারেন। “শ্রোত্রিয়ঃ” অর্থাৎ প্রথমেই তাঁকে বেদজ্ঞ যাতে তিনি শাস্ত্রের মর্মার্থ উপলব্ধি করে কর্তব্য অকর্তব্য নির্ধারণ করতে পারেন। “অবৃজিনঃ” কোন প্রকার পাপকর্ম তাঁকে সামান্যতম স্পর্শ করতে পারবে না। “ব্রহ্মবিত্তমঃ” অর্থাৎ তিনি হবেন বাসনাহীন নিষ্কাম, নির্মলচরিত্রের এক শ্রেষ্ঠ ব্রহ্মবিদ। তিনি শিষ্যকে অহেতুক বৈদিক জ্ঞান দান করবেন।বিনিময়ে শিষ্যদের থেকে জাগতিক কোন কিছুই প্রত্যাশা করবেন না। যোগ্য অধিকারী শিষ্যের ব্রহ্মজ্ঞানরূপ সাধনার পথ তাঁর উপদেশেই সুগম হয়। “ব্রহ্মণি-উপরতঃ শান্তঃ নিরিন্ধনঃ ইবানলঃ”; সকল প্রকার বাহ্যবিষয় থেকে প্রত্যাহৃত, হয়ে সদগুরুর মন সর্বদা ব্রহ্মে স্থিত থাকবে। তিনি হবেন যুগপৎ শান্ত এবং তেজস্বী। ব্রহ্মতেজে সদা প্রদীপ্ত থাকবেন। বিষয়টি শ্রীশঙ্করাচার্য একটি উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছেন।একটা কাঠ জ্বলছে, কোনও ইন্ধন দিয়ে সেই আগুনকে বাড়ানাে হচ্ছে না। তাই সে আগুনের শিখা স্থির, তার কোন বাড়া-কমা নেই। কিন্তু আগুনের তেজ অনুভব করা যাচ্ছে। ব্রহ্মজ্ঞ গুরু যেমন শান্ত, তেমনি তেজস্বী। ব্রহ্মের শক্তি সর্বদা তাঁকে ঘিরে থাকে। তাঁর সঙ্গ লাভ করলে বাহ্যিক চাকচিক্যময় জগতকে অকিঞ্চিৎকর বলে মনে হয়। তিনি হলেন কোন কারণ ছাড়াই শিষ্য সহ অন্যদের প্রতি দয়ার সাগর -“অহেতুক-দয়াসিন্ধুঃ”।কোন নিজের জাগতিক লাভ-ক্ষতি হিসেব করে তিনি শিষ্যকে কৃপা করেন না। “বন্ধু : আনমতাং সতাং”- যেসব সজ্জন ব্যক্তি তার শরণাগত, তাদের সকলের তিনি বন্ধু।

সদগুরু কেমন তাঁর ভাব কেমন,তাঁর শিক্ষা কেমন বিষয়টি অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব তাঁর সংকলিত কথোপকথন ‘শ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত’ গ্রন্থে বলেছেন। ব্রাহ্মসমাজের নেতা কেশব চন্দ্রকে উদ্দেশ্য করে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বলেছেন,সচ্চিদানন্দ স্বরূপ পরমেশ্বরই একমাত্র গুরু। তিনিই জীবকে সৃষ্টি করেছেন এবং তিনিই জীবকে শিক্ষা দিবেন। জগতে মানুষ গুরু মেলে লাখ লাখ। সকলেই গুরু হতে চায়; পক্ষান্তরে শিষ্য কেউ হতে চায় না।

“আমার তিন কথাতে গায়ে কাঁটা বেধে। গুরু, কর্তা আর বাবা।
গুরু এক সচ্চিদানন্দ। তিনিই শিক্ষা দিবেন। আমার সন্তান ভাব।মানুষ গুরু মেলে লাখ লাখ। সকলেই গুরু হতে চায়, শিষ্য কে হতে চায়?

লােক শিক্ষা দেওয়া বড় কঠিন। যদি তিনি সাক্ষাৎকার হন আর আদেশ দেন, তা হলে হতে পারে। নারদ, শুকদেবাদির আদেশ হয়েছিল। শঙ্করের আদেশ হয়েছিল। আদেশ না হলে কে তোমার কথা শুনবে?

… আবার মনে মনে আদেশ হলে হয় না। তিনি সত্য সত্যই সাক্ষাৎকার হন, আর কথা কন। তখন আদেশ হতে পারে। সে কথার জোর কত?পর্বত টলে যায়। শুধু লেকচার ? দিন কতক লােক শুনবে, তারপর ভুলে যাবে। সে কথা অনুসারে কাজ করবে না।

…লােক শিক্ষা দেবে তার চাপরাস চাই। না হলে হাসির কথা হয়ে পড়ে। আপনারই হয় না, আবার অন্যলােক। কানা কানাকে পথ দেখিয়ে লয়ে যাচ্ছে। হিতে বিপরীত। ভগবান লাভ হলে অন্তদৃষ্টি হয়, কার কী রোগ বােঝা যায়, উপদেশ দেওয়া যায়।
আদেশ না থাকলে ‘আমি লােক শিক্ষা দিচ্ছি’ এই অহংকার হয়। অহংকার হয় অজ্ঞানে । অজ্ঞানে বােধ হয়, আমি কর্তা। ঈশ্বর কর্তা, ঈশ্বরই সব করছেন, আমি কিছু করছি না, এ বােধ হলে তাে সে জীবন্মুক্ত। ‘আমি কর্তা’, ‘আমি কর্তা’ এই বােধ থেকেই যত দুঃখ, অশান্তি।”
(শ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত: দ্বিতীয় খণ্ড, অষ্টম পরিচ্ছেদ)

সম্প্রদায় নিয়ে আমরা যখন কাজ করি তখন অনেক ছেলেমেয়েকে পাই যারা ধর্মান্তরিত হয়ে গেছে,এ সমস্ত এই ধরে-বেঁধে গুরুর থেকে দীক্ষা নেয়ার ফলে। বাল্যকাল থেকেই তাদের পরিবার থেকে শিখানো হয় যে, ঘরের আসনে পূজিত গুরুই ভগবান। সে তখন ঐ গুরুরূপ ব্যক্তিকেই ভগবান মনে করে। সকল বিশ্বাস আস্থা তার প্রতি থাকে। সবকিছুই সে। পরে বয়স বাড়ার পরে ধীরেধীরে ঐ ব্যক্তির প্রতি যখন বিশ্বাস চলে যায়; তখন তাদের ধর্মের প্রতি আর কোন বিশ্বাসই থাকে না। সে সময়ে ধর্মান্তরিত সহ বিভিন্ন আত্মঘাতী অপকর্ম করে ফেলে। গুরু নামধারী জগতের সকলেই শ্রদ্ধেয় নয়। মহাভারতের উদ্যোগ পর্বে বলা হয়েছে, গুরুও যদি গর্বিত হয়ে নিজ কর্তব্য এবং অকর্তব্য উপলব্ধি না করে অসৎ পথে ধাবিত হয়; তবে কোনরূপ চিন্তা না করে তৎক্ষণাৎ সেই গুরুকে পরিত্যাগ করতে হবে।

গুরােরপ্যবলিপ্তস্য কার্যাকার্যমজানতঃ।
উৎপথপ্রতিপন্নস্য পরিত্যাগাে বিধীয়তে।।
(মহাভারত:উদ্যোগ পর্ব.১৬৭.২৫)

“গুরুও যদি গর্বিত হন,নিজের কর্তব্য এবং অকর্তব্য উপলব্ধি না করে অসৎ পথে চলতে থাকেন, তবে সেই গুরুকে পরিত্যাগ করা উচিত।”

কিন্তু হাস্যকর হলেও সত্য, গুরু প্রসঙ্গে বর্তমান সমাজে প্রচলিত রয়েছে কয়েকটি জনশ্রুতি। গুরু যদি বেশ্যাবাড়িতেও যায়, এরপরেও সে নিত্যানন্দ রায়। অনেকে আবার আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে সংগীত বানিয়েছে, “কৃষ্ণ নিন্দা কৃষ্ণ তবু সহিবারে পারে; গুরুনিন্দা কৃষ্ণ কভু সহিবারে নারে।” অর্থাৎ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নিন্দাও ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মুখবুঝে সহ্য করতে পারে, কিন্তু গুরুনিন্দা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ একদণ্ডও সহ্য করতে পারে না। এভাবেই সাধারণ মানুষকে গুরুনিন্দার ভয় দেখিয়ে, ভণ্ড গুরুরা নিজ স্বার্থে করে চলে সকল অপকর্ম। গুরুর সাথে শিষ্যদের সম্পর্ক হবে অহৈতুকী। অর্থনৈতিক সহ কোন প্রকার স্বার্থের সম্পর্ক গুরুশিষ্যে থাকবে না।আমি এমন গুরুদেবও ব্যক্তিগতভাবে চিনি, যারা শিষ্যদের কাছে সুদে টাকা লাগিয়েছে। অর্থাৎ শিষ্যের সাথে তার সুদের মহাজনি ব্যবসা। তাই গুরু নামেই সবাই পরমশ্রদ্ধেয় নয়; যদি সদগুরু হতে না পারে। সদগুরু কখনও অহেতুক নিজের প্রচার করবে না, সে সর্বদা বেদ-বেদান্তেরই প্রচার করবে। বর্তমানে অনেক ব্যক্তি গুরুর কথা অন্ধের মত অনুসরণ করে। একবার ভেবেও দেখে না গুরুর কথা বেদ এবং বেদান্তবাক্যের সাথে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ।ব্রহ্মজ্ঞপুরুষ লোকনাথ ব্রহ্মচারী গুরুবাক্য পালন বিষয়টি সম্পর্কে অত্যন্ত সুন্দর একটি সমাধান দিয়েছেন। তিনি বলেছেন:
“গুরুবাক্য পাইলে, এখন বেদান্তবাক্যের সঙ্গে মেলাও। এর দ্বারা নিদিধ্যাসন পযর্ন্ত করতে পারবে।”

অর্থাৎ অন্ধের মত গুরুকে অনুসরণ নয়, গুরুর বাক্য যদি বেদান্তবাক্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় তবেই গুরুকে অনুসরণ করতে হবে, নচেৎ নয়। অর্থাৎ শাস্ত্রে যা রয়েছে, সেই পরম্পরায় ব্রহ্মজ্ঞপুরুষেরাও সে একই দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। এরপরেও যদি কেউ সঠিক পথ চিনতে না পারে বা পথে চলতে গিয়ে পথভ্রষ্ট হয়; তবে বুঝতে হবে সে মুক্তির পথের অধিকারী নয়।

তথ্য সহায়তা:
১.স্বামী লোকেশ্বরানন্দ (অনূদিত),’শঙ্করাচার্যের বিবেক চূড়ামণি’, রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচার, কলকাতা: মে ২০১৫

সৌজন্যে – শ্রীরামকৃষ্ণায়তে নমঃ

ekhansangbad
Author: ekhansangbad

Related News

Also Read