Select Language

[gtranslate]
৮ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ বুধবার ২২শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

কুন্ডলীনি কথা-

কুন্ডলীনি কথা-দিলীপ ঘোষ

….. শক্তিকে ,অর্থাৎ কুণ্ডলিনীকে সহস্রারে নিয়ে যেতে সময় লাগে বছরের পর বছর। কারো পূর্ব-জন্মের সুকৃতি থাকলে তবে তিনি অল্প সময়েই পারেন এই দুরূহ কাজকে সম্পন্ন করতে। যেমন শ্রী রামকৃষ্ণ,লাহিড়ী মহাশয়,যোগানন্দজী,নিগমানন্দজী প্রভৃতি মহাপুরুষগণ পূর্বজন্মের সুকৃতিস্বরূপ অল্পসময়ের মধ্যেই এই শক্তিকে জাগিয়ে তুলেছিলেন।

কিছুদূর পর্যন্ত কুণ্ডলিনী উঠবে সহজেই ,তারপর তার গতি হবে ধীর। কিন্তু যিনি সামান্য ঊর্ধ্বগতি সৃষ্টি করতে পারবেন কুণ্ডলিনীতে’ তার যদি ইচ্ছাশক্তি প্রবল হয় এবং নিরন্তর সাধনা চালিয়ে যেতে পারেন তাহলে তিনি বাকিটুকুও পারবেন ‘তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে কুণ্ডলিনী যত বেশি ঊর্ধ্বমুখী হবে ততই বেশি চেষ্টা চাই সাধকের। চক্রে চক্রে তার ঊর্ধ্বগতিতে আছে বিশেষ ধরণের আনন্দবোধ।একের একের ভূত-জগতের নানা স্তর অতিক্রান্ত হয় চক্রভেদে।এই ভূত-স্তর থেমে যায় আজ্ঞাচক্রে এসে। আজ্ঞাচক্রে এসে কুণ্ডলিনী উপস্থিত হলেই সমস্ত বিশ্ব-ব্রম্ভান্ড অনুভূত হয়। প্রথম দিকে শক্তির ঝোঁক থাকে নেমে যাওয়ার দিকে। অনবরত যদি চেষ্টা থাকে তবেই তাকে ধরে রাখা যায় উর্ধ্বচক্রে।নাড়ী যদি শুদ্ধ থাকে’তাহলে তাকে যেমন সহজে সহস্রারে ওঠানো যায় , তেমনই যায় সহজেই নামানোও। যিনি সিদ্ধযোগী দীর্ঘ অভ্যাসে শরীরকে করেছেন নিয়ন্ত্রন ‘ তিনি যতক্ষণ খুশী সহস্রারে কুণ্ডলিনীকে ধরে রাখতে পারেন।ইচ্ছা হলে শক্তিকে তিনি ভিন্ন দেহেও চালনা করে দিতে পারেন। শঙ্করাচার্য যেমন ঢুকে পড়েছিলেন এক মৃত রাজার দেহে। ভারতীয় ও তিব্বতীয়ো যোগীদের মধ্যে অনেকেই জানেন ওপরের দেহে প্রবেশ করার কলাকৌশল। তিব্বতী তন্ত্রে একে বলে ফোয়া (Phowa)।

ভগবান বুদ্ধ যে এই মতে সাধনা করেছিলেন তার বহু প্রমানাদি বৌদ্ধ ধর্ম শাস্ত্রে আছে। তিব্বতী লামারা এই সাধনাই করে থাকেন। কুলকুণ্ডলিনী যোগ সাধনে সুষুস্মা নাড়ীর বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। প্রসিদ্ধ যোগশাস্ত্র ‘হঠযোগ প্রদীপিকা’-যাতে কুণ্ডলিনী সাধনার বিবিধ বর্ণনা রয়েছে এবং বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্রের ‘মন্ধিমা পটিপদ’- যাতে বুদ্ধের মধ্যমপথ আবিষ্কারের কথা রয়েছে, তাদের মধ্যে বহু মিল দেখতে পাওয়া যায়। হঠযোগ প্রদীপিকায় আছে “সুষুস্মা শুন্যপদবী ব্ৰহ্ম রন্ধ্রং মহাপথ। শ্মশানং শাম্ভবী মধ্যমার্গশ্চেত্যেক বাচকঃ।” অথাৎ সুষুস্মা, শূন্য পদবী, মহাপরিচালক, শ্মশান,শাম্ভবী ও মধ্যপথে এই সমস্ত শব্দের অর্থ এক রূপ’ অথাৎ এই সমস্তই সুষুস্মা বোধক”।।

এই কুণ্ডলিনী জ্ঞান সম্বন্ধে শ্রীমদ্ভগবতগীতায় রাজবিদ্যা-রাজগুহ্য যোগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন ,”এই জ্ঞান শ্রেষ্ঠ জ্ঞান,অতিশয় গুহ্য ,পবিত্র,প্রতক্ষ্য ফলপ্রদ,ধর্মানুগত,সহজে অনুষ্ঠেয় এবং অব্যয়। “—(গীতা ৯/১২)

আমাদের সনাতন ধর্ম ছাড়াও বিভিন্নদেশে এবং বিভিন্ন ধর্মসমূহেও এই কুণ্ডলিনী সাধনার কথা কোনো না কোনো ভাবে ব্যক্ত আছে। আমাদের বাংলায় শৈব,শাক্ত, এবং বৈষ্ণব ভেদে প্রধানতঃ তিনটি তান্ত্রিক সম্প্রদায় আছে। এইসব সম্প্রদায়ে কুণ্ডলিনী সাধনা সম্পর্কিত নানা তথ্য ও বর্ণনা রয়েছে।

ইতিহাস বলে ‘ মধ্য-প্রাচ্যের ইউফ্রেটিস নদী অববাহিকায় এই কুণ্ডলিনী উপাসনা রীতির উন্মেষ লক্ষ্য করা গিয়েছিলো। গ্রীক এবং রোমান সভ্যতার শিল্প-কলার নিদর্শনে সর্পপূজার বিবরণ পাওয়া যায়। প্রাচীন মিশরে ফ্যরাওদের দুই ভ্রূ-যুগলের মধ্যে সর্প-প্রতীক অঙ্কিত থাকতো। মেসোপটেমিয়ার মন্দিরে সর্প-মূর্তি দেখা গিয়েছে। সর্প হলো কুণ্ডলিনী শক্তির প্রতীক ; তাই খুব সহজেই অনুমান করা যায় ঐ সকল স্থানে কুণ্ডলিনী সাধনার প্রচলন ছিল।।

বেদের রচনাকাল (মূলতঃ যজুর্বেদ) থেকে কয়েক সহস্র বছর পর্যন্ত এই শক্তির বহূল প্রচলন ছিল’ কিন্তু সেই সময় এবং মহাভারতের মধ্যবর্তী যুগে ক্ষাত্রধর্মের ব্যাভিচারে এই সাধন পদ্ধতির প্রচার কমে আসে এবং ব্যভিচার বৃদ্ধি পায়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে সেই গুপ্ত জ্ঞান পুনরায় অর্জুনকে প্রদান করেন। তারপর ব্রাহ্মণদের উদাসীনতায় এই গুপ্তযোগ পুনরায় বিলুপ্ত হয়ে যেতে বসে সেই সময় (প্রায় ২৬০০ বছর আগে) ভগবান বুদ্ধ আবার গভীর অন্ধকার থেকে এই সাধন পদ্ধতি উদ্ধার করেন। তিনি উপবাসক্লিষ্ট সর্বত্যাগী দেহের পরিবর্তে আহারপুষ্ট কায়সাধনায় বেশী গুরুত্ব দেন যা পরবর্তীকালে বৈদিক যোগের সাথে সমন্বয় ঘটিয়ে বৌদ্ধতন্ত্র নামে প্রসিদ্ধ হয়। পরবর্তীকালে এই উগ্র তান্ত্রিকদের ব্যভিচারে এবং তাদের গুপ্ত বিধি-নিষেদের ফেরে এই সাধন-পদ্ধতি পুনরায় বিলুপ্ত হয়ে যেতে বসে।।

তখন সেই সাধন প্রনালীকে পুনরুদ্ধার করে কখনও শ্রী চৈতন্য তাকে পরকীয়া সাধনা রূপে , কখনও বাউলরা সহজিয়া সাধনা রূপে, কখনোও আবার যোগীরাজ শ্যামাচরণ লাহিড়ী মহাশয় ক্রিয়াযোগ রূপে পুনরাস্থাপিত করেছেন।। নামের প্রকারভেদ থাকলেও আদপে তা একই যোগ; প্রয়োজনে এবং সাধকের অধিকারভেদে এই সাধন-প্রনালীর মধ্যে কিছূ পরিবর্তন ও সংযোজন করা হয়েছে মাত্র।।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার: কালিকানন্দ অবধূত

ekhansangbad
Author: ekhansangbad

Related News

Also Read