Select Language

[gtranslate]
২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ রবিবার ৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

জীবনের গান

ছেলের জন্য মুখরোচক কুড়কুড়ে আলুভাজি বানাতে বানাতেই ফোনটা ধরল নন্দা….
স্কুলবাসের কি একটা সমস্যা হওয়ায় ছাত্রছাত্রীদের বাড়ির লোক গিয়ে নিয়ে আসতে পারে নতুবা ফিরতে আজ দেরী হবে তাই জানিয়ে ফোন করেছে বাপানের স্কুল থেকে।
কিন্তু এখন তো যাওয়া সম্ভব
নয় কোনোমতেই। তাই দেরীতে হলেও স্কুলবাসেই আসুক এটাই বলে দিল নন্দা।

কি হল রে বাবা… কতক্ষণে ফিরবে আজ কেজানে… সেই একটু ম্যাগি খেয়ে কি এতক্ষণ থাকতে পারবে বাপান… ইসস্ বড্ডো ক্ষিধে পেয়ে যাবে গো ছেলেটার…
আপনমনে ভাবছিল নন্দা।
আলুভাজা বন্ধ রেখে ঘরের টুকটাক কাজগুলো সারতে লাগলো সে।
বাপান ফিরলো নির্দিষ্ট সময়ের প্রায় ঘন্টাখানেক পরে।
হাউজিং এর গেটেই নামে বাপান… কেয়ারটেকার সুখেনই ওকে ঘরে পৌঁছে দেয়।
~”জানোতো মাম্মা… কিট্টুদের আর মলিদের বাসটা আজ ছিলনা
আমাদের বাস আর একটা বাসেই সবাইকে নামাতে নামাতে এল…. জানো মাম্মা আমার পাশে আজ…”
~”উফফ্ চুপ কর তো এখন.. সব শুনবো পরে আগে স্নানে যাও সোনা…কত্তো দেরী হয়ে গেছে আজ”

তাড়াতাড়ি ছেলেকে জামাকাপড় ছাড়িয়ে বাথরুমে পাঠায় নন্দা।
বেরোতেই ভালো করে গা মুছিয়ে জামা পরাতে পরাতে বলে
~”আজ বড্ডো ক্ষিধে পেয়ে গেছে আমার সোনাটার… আমি তো ফেভারিট কুড়কুড়ে আলুফ্রাই করেছি আর সাথে কি বলোতো??গেস্ গেস্”
চোখ বড়ো বড়ো করে বাপান বলে

~ “না গো মাম্মা…. আজ আমি তো লুচি আলুভাজা…. না না… আলুচড়চড়ি খেয়েছিলাম… তাই তেমন ক্ষিধে পায়ইনি”
~”আলু চড়চড়ি!! সেটা আবার কি? পেলিই বা কোথায়”
~”ওই যে গো আলু টোম্যাটো দিয়ে কারি আর লুচি…এই বড়ো বড়ো”
~”কিন্তু কোথায় পেলি এসব? স্কুলে খাইয়েছে নাকি?”
~”আরে না না…. আমাকে তো চুমকি দিয়েছে গো… আমিও ওকে এট্টু ম্যাগি দিয়েছি মাম্মা”
~”চুমকি…!!সে কে?”
~”আরে বাবা ওই যে মেয়েটা লাস্ট এক্জামে থার্ড হয়েছিল গো… তুমি আমায় ওর সামনেই তখন বকেছিলে ফোর্থ হয়েছি বলে”… মুখ নামিয়ে বললো বাপন।
~” ও বুঝেছি… কিন্তু ওর টিফিন তুমি খেয়েছো কেন? ইটস্ ভেরি ব্যাড বেটা”
~”সরি মাম্মা… ও খুব ভালো টিফিন আনে.. আমায় আগেও দিয়েছে তোমায় বলা হয়নি মাম্মা… সরি এগেইন মাম্মা”
~”ওকে….ওকে…. বাট ভালো টিফিন মানে কি বাপান? আমি তো তোমায় কেক প্যাটিস স্যাণ্ডউইচ সবই দিই পালটে পালটে…. তারপরও তুমি অন্যের থেকে কেন খাবে?”
~”না গো মাম্মা…. ও অনেকটা করে আনে…আমি শুধু ওর সাথেই টিফিন শেয়ার করি মাম্মা”

অনেকটা দেরী হয়ে যাওয়ায় তখনকার মত সে প্রসঙ্গ বন্ধ রেখে ছেলের খাওয়াদাওয়া নিয়ে ব্যস্ত হয় নন্দা।
পরে গল্পের ছলে ছেলেকে আবার শেখানোর চেষ্টা করে কারও সাথে টিফিন শেয়ার করতে নেই…সবাই এত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয় না…স্বাস্থ্যকর খাবারও হয় না তাতে শরীর খারাপ হয় ইত্যাদি…কিন্তু ছেলেও সুন্দর করে বুঝিয়ে দেয় মাকে যে চুমকির মা খুব ভালো ভালো খাবার করে দেয় আর খুব সুন্দর করে টিফিনকৌটায় সাজিয়ে দেয় চামচও আলাদা করে কৌটোয় দিয়ে দেয়।
মিষ্টিচিঁড়ে,লুচি,পরোটা,এমনকি আলুকাবলিও কি ভালো খেতে হয়।
এইটুকু ছেলের মুখে অন্যের মায়ের প্রশংসা মোটেই সুখকর হল না নন্দার কাছে।
কিভাবে এটা বন্ধ করা যায় সে চিন্তা করতে লাগলো।
তেমন হলে গার্জেন মিটিং এ গিয়ে সরাসরি কথাটা তুলতে হবে স্কুল কতৃপক্ষের কাছে।
স্বামী দীপক কে তো এসব বলে কোনো লাভ নেই… নিজের কাজের জগত আর ল্যাপটপের জগতেই মেতে থাকে সে। না যায় ছেলের স্কুলে না তেমন গল্প করে ছেলেকে নিয়ে।
সংসারে সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের অভাব রাখেনি ঠিকই কিন্তু তার বাইরেও যে সংসারে কিছু সময় দিতে হয় কিছু বিষয়ে অংশ নিতে হয় সেটা বোঝেনা সে।

কিছুদিন পরেই ছেলের স্কুলের গার্জেন মিটিং এ গেছে নন্দা।
দীপককে কোনোদিনও এসব কাজে পাওয়া যাবে না কাজেই নন্দাকেই সবদিক দেখতে হয়।

~”নমস্কার…. আপনি তো নন্দা ম্যাডাম?”
সৌম্যদর্শন ভদ্রলোক কে স্মিতমুখে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়ে তাকাতেই ভদ্রলোক আবার বললেন,
~”আমি শঙ্কর, চুমকির বাবা”
একটুক্ষণ চুপ থেকেই মনে পড়ে যাওয়ায় মুখে আলগা হাসি ফুটিয়ে প্রতি নমস্কার জানায় নন্দা।
প্রাথমিক আলাপের পর মিটিংয়ে ঢুকে যায় দুজনেই।
যে চুমকির খাবার শেয়ার করা নিয়ে অভিযোগ জানানোর পরিকল্পনা ছিল নন্দার এখানে শঙ্করবাবুর শান্ত সুন্দর চেহারা আর ভদ্র নম্র আন্তরিক ব্যবহার,অভিযোগ জানানোর ক্ষেত্রে কোথায় যেন একটা বাধা তৈরী করলো।
সেই ছিল প্রথম আলাপ।
মানুষের মন কখন যে কি ভাবে, কি চায়, কেই বা বলতে পারে তা।
সেদিনের সেই আলাপ যে ক্রমে একটা বন্ধুত্বে পরিনত হবে কে তা জানতো।
আগে বিভিন্ন কারণে বাপানের স্কুলে যেতে বিরক্ত লাগত,দীপক যায় না বলে রাগ হত এখন যেন তার বদলে স্কুলে যেতে আগ্রহ বোধ করে আর তার পিছনে অন্যতম কারণ যে শঙ্কর বাবুর দেখা পাওয়া… সেটা বলাই বাহুল্য।
তেমনই একটা প্রয়োজনে একদিন গার্জেন হিসাবে নন্দা গেছে বাপানের স্কুলে… অন্যদিন যেখানে সে দাঁড়ায় আজও সেখানে কিন্তু কই শঙ্করবাবু তো আজ আসেননি এখনও…. অদ্ভুত একটা অনুভূতি নন্দার মন জুড়ে… কি হল তার প্রতিবার তো তিনিই আগে এসে দাঁড়িয়ে থাকেন। দেখা হলেই একগাল হেসে কেমন আছে সে জানতে চান… তারপর টুকটাক আরও কত কথা হয়… আজ কেন এলেন না… মনে মনে অস্থিরতা অনুভব করে নন্দা।
স্কুলের কাজ মিটিয়ে ফেরার সময় এক সাদামাটা সাজপোশাকে অত্যন্ত সাধারণ চেহারার এক ভদ্রমহিলা এসে দাঁড়ায় সামনে।
~”নমস্কার… আমি চুমকির মা দেবী”
~”ও ওহ্… আচ্ছা আচ্ছা”
হকচকিয়ে গিয়ে বলে নন্দা।
~”কিন্তু আমাকে চিনলেন কি করে? “
~”ওই যে চুমকি আর ওর বাবা বলেন অরিত্র’র মা একেবারে পরীর মত সুন্দরী…তাতেই মনে হল আরকি”
হাসতে হাসতে বলে দেবী
ততক্ষণে নন্দার গাল কানের লতিতে লজ্জার লালচে ছোপ্
~”না না ওসব বাড়িয়ে বলা”
~”একদমই না… আজ তো আমিও তাই দেখলাম… সত্যিই সুন্দরী আপনি দিদি”
~”শঙ্করবাবু আজ এলেন না তো?”
একটু দ্বিধা নিয়েই জিজ্ঞেস করল নন্দা
আসলে ওদের কারখানা তো অনেকদিন বন্ধ ছিল তারপর খুললেও রোজ সবার ডিউটি থাকতো না,তাই ওর বাবাই প্রায় প্রতিটা কাজেই স্কুলে আসতে পারতো.. কিন্তু আজ ওর ডিউটি পড়ে গেছে তাই আমাকেই”
~”ও আচ্ছা আচ্ছা…বেশ আসি তবে…. পরে আবার দেখা হবে”

***********************

বাড়ি ফিরে আয়নায় নিজেকে যেন নতুন করে আবার দেখলো নন্দা।
এই বয়সেও কোনো পুরুষের কাছে সুন্দরী শুনতে পেলে কার না ভালো লাগে!

একটু আধটু মেদ জমলেও এখনও ফিগারটা খারাপ লাগেনা…
সেদিন থেকে সংসার ছেলে সামলে একটু করে আবার রূপচর্চা শুরু করলো নন্দা।

~”নন্দা… নন্দা…”
স্বামীর বিরক্ত গলার ডাকে রান্নাঘর থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসে নন্দা…
~”কি হলটা কি?”
~”অফিসের জামাটা কোথায় গেল?”
~”ওহ্হো… একমিনিট দাঁড়াও এনে দিচ্ছি “

রোজ অফিস থেকে ফিরে ছাড়া জামা প্যান্ট মেলে দেওয়া ও তুলে আবার জায়গায় রেখে দেওয়া,কখনও বদলে অন্য সেট রেখে দেওয়াটাও নন্দারই, দায়িত্ব কালও মেলেছিল কিন্তু তোলা হয়নি ভুলবশত।
~”সবসময় না হাওয়ায় উড়ো না….সংসারটা সংসারের মত করে করো বুঝলে? “
একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললো দীপক।
এরকম ছোটোখাটো তিরস্কার শুনতে অভ্যস্ত হলেও আজ যেন কেমন কান্না পেয়ে গেল নন্দার।এত খুঁটিয়ে সবকিছু করা সত্ত্বেও এমন কথা কেন বলে দীপক!!

************************

সেদিন অসময়ে ডোরবেল শুনে দরজা খুলতেই একরাশ বিস্ময়…. দরজার বাইরে শঙ্করবাবু….
বুকের রক্ত যেন একটুর জন্য চলকে উঠলো নন্দার…
~”আরে আপনি!আসুন আসুন”
~”সরি,আপনাকে বোধহয় অসুবিধায় ফেললাম “
~”একদমই না… ওই তো সংসারের কাজ ভারি, তার আবার অসুবিধা… আপনি বসুন বসুন”
তাড়াতাড়ি একটু কোল্ড ড্রিংকস সুদৃশ্য গ্লাসে ট্রে তে এনে রাখে সামনের টেবিলে।
~”যা রোদ বাইরে….খান একটু”
শঙ্কর বাবু বললেন
~”ওরে বাবা এসব ফ্রীজের ঠাণ্ডা জিনিসে আমার তো এত অভ্যাস নেই…থাক একটু ঠাণ্ডাটা কাটুক তারপর খাবো”
এখনকার দিনে ঘরে ফ্রীজ টিভি থাকেনা এমন পরিবারও আছে! অথচ মেয়েকে এত নামী স্কুলে পড়াচ্ছে?অদ্ভুত তো!! ভাবে নন্দা।
~”তো যেজন্য আসা…. আগামী সোমবার আমাদের চুমকীর জন্মদিন। কোনোদিনই সেভাবে পালন করা হয়না… এবার ওর মা এবং ওর খুব ইচ্ছে দু চারজন বন্ধুদের নিয়ে একটু হৈচৈ করবে… তার মধ্যে ওর বেস্ট ফ্রেণ্ড অরিত্রও আছে আরকি…তো আপনি যদি ওকে নিয়ে ওইদিন একটু আসেন আমাদের বাড়ি তাহলে খুব আনন্দ পাব”

তক্ষুনি ঠিক কি বলবে ভেবে উঠতে না পেরে নন্দা বললো…
~ “আচ্ছা… ওর বাবা আসুক দেখি ওর যদি কোনো অসুবিধা না থাকে তো নিশ্চয়ই যাব”

আধঘন্টা বড়জোর ছিলেন শঙ্কর বাবু কিন্তু সেটুকু সময়েই তাঁর সুন্দর কথাবার্তা, সপ্রশংস অভিব্যক্তি,নম্র মার্জিত ব্যবহার যেন নন্দার মনে একটা গভীর ছাপ রেখে গেল।
দীপকের কাছে কথাটা পাড়াই সার… নন্দা কোথায় যাবে না যাবে তা নিয়ে তেমন কোনো মাথাব্যথাই নেই তার…. ছেলে যখন মায়ের জিম্মায় তখন তার সম্পর্কেও ভাবার প্রশ্ন নেই কাজেই গেলে কেনো আপত্তি আছে কিনা এর উত্তরে ঠোঁট উলটে কাঁধ ঝাঁকিয়ে একটা বিশেষ ভঙ্গিতে অতি তুচ্ছ ব্যাপারে তার কোনো ইন্টারেস্ট নেই এটাই বুঝিয়ে দিল মাত্র।

সাকুল্যে দুটি ঘর আর একফালি বারান্দা নিয়ে চুমকিদের নিতান্তই ছোটো বাড়ি।ঠিকানা খুঁজে পেতে একটু অসুবিধাই হয়েছিল নন্দার… বড়ো রাস্তা থেকে অনেকটাই ভিতরে একটু বস্তি এলাকার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।
গুনে পাঁচজন বন্ধুর মধ্যে কাছাকাছির তিনজন ছেলেমেয়ে আর অরিত্র আর একজন অরিত্রদের মতই স্ট্যাটাসের ফ্যামিলির মেয়ে.. সে আসতে পারেনি কোনো কারণে।
অন্য তিনটি ছেলেমেয়ের মা রাও এসেছিলেন তাদের বেশবাসও বেশ সাধারণ। বলতে গেলে নন্দা আর অরিত্রকে ওখানে একদম আলাদা লাগছিল।
খুব দামী একটা খেলনা উপহার দিতেই চুমকির চোখে খুশি উপচে পড়লো সঙ্গের বন্ধুরাও আগ্রহী হয়ে পড়লো সেটা নিয়ে।
সামান্য আয়োজন কিন্তু খুব পরিচ্ছন্ন পরিপাটি।সবকিছুতেই।
আর্থিক অপ্রতুলতার ছাপ থাকলেও রুচিশীলতার পরিচয়ও স্পষ্ট।
স্বল্প সময়ের মধ্যেই একটা বিষয় খুব ভালো করে বুঝতে পারলো নন্দা,এই নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের বহুকিছুর অভাব থাকলেও মানসিক শান্তি আর পারস্পরিক সুসম্পর্কে কোনো ঘাটতি নেই।
দেরি করে যাওয়ার কারণে ফিরতেও একটু রাতই হয়ে যায় নন্দাদের।
বাড়ি ফিরে দেখে ডাইনিং জুড়ে দীপকের অফিসব্যাগ,জুতো,জামা প্যান্ট সব ছড়ানো।
সে বাপানের পড়ার ঘরে ল্যাপটপ নিয়ে বসে।
~”এসে থেকে চা খাইনি… চটপট চা দাও তো একটু…আর বামটা দিও তো মাথাটা ধরে আছে খুব”
দরজা খুলতে খুলতেই বলে দীপক।
মুহূর্তে মাথাটা গরম হয়ে গেলেও নিজেকে সামলে নিল নন্দা…অরিত্রকে সব ছাড়িয়ে বাথরুমে ঢুকিয়ে নিজে ড্রেস চেঞ্জ না করেই শুধু হাতটা ধুয়ে রান্নাঘরে এসে চায়ের ব্যবস্থা করলো।
চা আর বাম টা দীপকের সামনে রেখে কি মনে হতে উল্টোদিকের চেয়ারটায় বসলো নন্দা… হালকা গলায় জিজ্ঞেস করলো
~”কখন এলে আজ?”
~”যেমন আসি সাতটার আশেপাশেই”
চোখ না তুলেই বললো দীপক।
~”চুমকিদের আর্থিক অবস্থা তেমন নয় কিন্তু কি সুন্দর ওদের সংসারটা জানো..”
~”চুমকি আবার কে?”
~”ওই তো বাপানের বন্ধু মেয়েটা… যাদের বাড়ি গেছিলাম গো”
~”অহ্…তাই বলো…উফফ্ মাথাটা খুব ধরেছে একটু টিপে দাও তো… ওহ্হো এখনও চেঞ্জ করোনি তুমি…? তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে এসো একটু”
এবার নন্দার দিকে তাকিয়েই বললো দীপক।

~”এই শাড়িটা তোমার মনে আছে?সেই প্রথম বার বিবাহবার্ষিকীতে তুমি এনেছিলে গো..”
ম্লানমুখে উঠে যেতে গিয়ে পিছু ফিরে একটু ইতঃস্তত করে বললো নন্দা।
~”আরে ধূর বাপু এসো না একটু তাড়াতাড়ি চেঞ্জ করে… বলছি মাথাটা যন্ত্রণা করছে”
জোর করে আনা উচ্ছাসটা পলকেই মিলিয়ে গিয়ে একটা বিষাদের ছায়া নেমে এল নন্দার সুন্দর মুখখানা জুড়ে।
সেদিন অনেকরাত অবধি ঘুম এলো না নন্দার চোখে।
বাড়ি থেকে দেখাশোনা করেই তার বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের পরে এম এ পরীক্ষাটা দিতে দিলেও চাকরি করার কোনো চেষ্টাই করা হয়ে ওঠেনি আর।নিজের ইচ্ছে গুলোর গলা টিপে দিতে হয়েছিল স্বামী শ্বশুরবাড়ির প্রতি কর্তব্য করতে গিয়ে।
বিয়ের সময় থেকেই শয্যাশায়ী শ্বশুরমশাই।তাঁর সেবাযত্নের সাথে সাথে রান্নাঘরের কাজেও শাশুড়িমা’র সাহায্য করা অভ্যাস করতে হয়েছিল প্রথম থেকেই।
ব্যাঙ্ক ম্যানেজার দীপক বরাবরই ভীষণ সিনসিয়ার নিজের কাজের বিষয়েে।ফলে বাড়ির বিভিন্ন দায়দায়িত্বও সে মাঝে মাঝে চাপিয়ে দিত নন্দার ওপরে অবশ্য অনুরোধের সুরেই…. তবে পরে সেগুলোও নন্দারই কর্তব্যের মধ্যে পড়ে গেছে… আর এভাবেই হাঁফাতে হাঁফাতেও নন্দা অভ্যস্তও হয়ে গেছে এই জীবনের সাথে।
বিয়ের দেড়বছরের মধ্যেই শ্বশুরমশাই চলে যান…তিনবছরের মাথায় বাপান… তার দুবছর বয়সে শাশুড়িমাও চলে গেলেন দুম করে।আরও আষ্টেপৃষ্টে সংসারে জড়িয়ে গেল নন্দা…
ঠাকুমার জিম্মায় নাতিকে রেখে একটু নিজের কাজ সামলানোর সুখটুকুও গেল তার।সংসার সন্তান সামলাতে সামলাতে কেটে গেছে আরও বছর পাঁচেক।দায়িত্ব কর্তব্যের চাপ শুধু বেড়েই চলেছে।
প্রথম প্রথম কাছেপিঠে যাও বা দুচারবার দিনকয়েকের ট্যুর হত শ্বশুরমশাই গত হবার পর থেকে সেসবও বন্ধ।
মাঝে মাঝে কেমন যেন দমবন্ধ হয়ে আসে নন্দার বড়ো ক্লান্ত হয়ে পড়ে যেন… তবুও এ জোয়াল ঘাড় থেকে নামাতে পারে কই!
আজ বিকালে মাত্র ঘন্টা দুয়েকের জন্য চুমকিদের বাড়িতে গিয়ে অনুভব করলো সংসারসুখ কাকে বলে…. কি সুন্দর বণ্ডিং স্বামী স্ত্রীর মধ্যে। আর তার নিজের সংসার!!ও যে এত সুন্দর করে সাজলো, একটা মধুর স্মৃতি জড়ানো শাড়ি পরলো সেসব কিছুই নজরে এলো না দীপকের, বলা সত্ত্বেও তার কোনো অনুভূতিই এলো না… অথচ বাপানের স্কুলে যাওয়ার সাদামাটা সাজেই শঙ্করবাবুর চোখে পরীর মত লেগেছে ওকে…. কি অদ্ভুত পার্থক্য না!!…শঙ্করের কথা মনে হতেই বুকের ভেতর একটা রিনরিনে ভালোলাগার অনুভূতি বয়ে গেল যেন…কিন্তু পরক্ষনেই মনে পড়ে গেল আজ প্রতিটা কাজে কি সুন্দর করে স্ত্রী কে সঙ্গ দিচ্ছিল শঙ্কর…এমনকি সবার সামনেই মেয়ের খাইয়ে দেওয়া কেকের টুকরোটা থেকে একটু খেয়ে বাকিটুকু কেমন গুঁজে দিল স্ত্রী’র মুখে…. কত ভালোবাসা পরস্পরের প্রতি…
মনটা আবার তেতো হয়ে গেল নন্দার…এভাবেই ক্লান্তি একসময় ঘুমের আবেশ এনে দিল তার দুচোখে।

************************

বাপানদের ফাইনাল এক্সামের রেজাল্টের দিন শঙ্কর আর দেবী দুজনেই এসেছিল ওদিকে নন্দা যথারীতি একা।
ওরা দুজনেই সেম পার্সেন্টেজ মার্ক্স পেলেও অরিত্র এক নম্বরে পিছিয়ে আছে।
কিন্তু অন্যবারের মত খুব যে খারাপ লাগছে নন্দার তা নয়… সত্যি বলতে গত মাস সাত আটের মধ্যে এই শঙ্কর আর দেবীর মত মানুষগুলো ওর জীবনদর্শন টা যেন অনেকটাই বদলে দিয়েছে।
কত অল্পেই যে খুশি হওয়া যায়
কত সামান্যতেও যে প্রয়োজন মিটিয়ে তৃপ্ত হওয়া যায়
আর কত ভালোবাসায় যে ঘর সাজানো যায় তা ওদের থেকে শিখেছে একটু একটু করে।
দেবী কোনোদিন দীঘা ছাড়া কোথাও ঘুরতে যায়নি,কোনোদিন বড়ো রেস্তোরাঁয় খেতে যায়নি
কোনো শৌখিন উপকরণে ঘর সাজায়নি
কোনো দামী শাড়িতে নিজে সাজেনি…..
তবু ওর চেয়ে সে কত্তো সুখী!!
আর শঙ্কর বাবুও এই অতি সাধারণ চেহারার অল্প শিক্ষিত স্ত্রী কে নিয়ে কী গর্বিত আনন্দিত…
কী অসাধারণ এক বন্ধন তাদের দুজনের মধ্যে..
যেন বিনি সুতোর মালায় বাঁধা ওরা।
অথচ ঢের বেশি স্বচ্ছলতার, আধুনিকতার বিলাসবাহুল্যের মধ্যে থেকেও অপূর্ব সুন্দরী হয়েও সে কতো অসুখেই না কাটায় দিবারাত্র।
এই তুলনা, এই আত্মানুভব আজকাল তাকে বড়ো অস্থির করে তোলে যেন।

************************

সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে দীপক বেল বাজিয়ে বাজিয়ে সাড়া না পেয়ে নিজের চাবিতেই দরজা খুলে ঢোকে।
ডাইনিং এ আলোটা জ্বলছে।
বাকি সব অন্ধকার… কি ব্যাপার ওরা কি কোথাও গেছে! ভাবতে ভাবতেই বেডরুমটা দেখে নিয়ে বাপানের পড়ার রুমে গিয়ে দেখে টেবিলের ওপর ল্যাপটপ টা পড়ে আর বাপানকে লেপটে নিয়ে সিঙ্গলবেডটায় ঘুমিয়ে কাদা হয়ে গেছে নন্দা।
অবাক হলেও মুহূর্তে রাগও চরম হল দীপকের।
একটু জোরেই ডাকলো নন্দাকে
ধড়মড়িয়ে উঠে বসে নন্দা…
সামনে দীপককে দেখে জিজ্ঞেস করে
~”কটা বাজে? তুমি চলে এসছো? এবাবা কতো রাত হয়ে গেছে “
তারপরেই বাপানকে আদর করে ওঠাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
ওর এরকম নিরুত্তাপ আচরণে রাগের মাত্রা আরও বাড়ে দীপকের।
~”কি ব্যাপার কি?আজকাল কি ছেলের পড়াটড়াও মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে নাকি!ভর সন্ধ্যেয় ওকে নিয়ে ঘুম দিচ্ছো যে!!”
~”ওই একটা সিনেমা দেখছিলাম কখন ঘুমিয়ে পড়েছি”
ছেলের মুখ ধোয়াতে ধোয়াতে হাই তুলে বলে নন্দা।
আকাশ থেকে পড়ে দীপক
~”মানেএএ!! সিনেমাও দেখাচ্ছো নাকি ছেলেকে আজকাল? তোমার কি মাথাটা গেছে নাকি বলোতো!!”
~”আরে দূর বাবা… ওই যে গুপীগাইন বাঘাবাইন টা দেখালাম ওকে…এগুলোও তো একটু জানা দরকার নাকি..তুমি ফ্রেশ হও আমি টিফিন চা দিচ্ছি এক্ষুনি”

বেশ কিছুদিন ধরেই নন্দাকে যেন একটু আলাদা লাগছিল কিন্তু খুব একটা গুরুত্ব না দেওয়ায় ব্যাপারটা অতটা ভাবায়নি দীপককে।আজ ছেলের রেজাল্ট কার্ডটা সামনে পেয়ে চোখ বোলাতেই ধাক্কা খেল সে।
যদিও ক্লাস থ্রী তবুও ফার্স্ট সেকেণ্ড থার্ডে থাকা ছেলে একেবারে সিক্সথ্!!অথচ এ নিয়ে তার মা কোনো চেঁচামেচি করছে না!!!
হলটা কি এদের মা ছেলের!!
মাথায় ঘুরছে বিষয়টা কিছুতেই মন থেকে বের করতে পারছে না।
নিজে সে বরাবরের অসম্ভব ভালো রেজাল্ট করা স্টুডেন্ট।
দারুণ কেরিয়ার দারুণ চাকরী।
যে কারণে এই বিলাসবহুল জীবন এই হাই লিভিং স্টেটাস।
অথচ তার ছেলের ক্রমাবনতি হচ্ছে তা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই নন্দার!!
যদিও সে নিজে এবিষয়ে দেখেনা কোনোদিন কিন্তু দেখবেই বা কেন!তার অফিসের কাজের চাপ এমনিতেই বেশি তাছাড়া নন্দার তো কাজই সংসার সামলানো সন্তানকে তৈরী করা…. কারণ তাকে চাকরি করতে তো হয় না… তাহলে সে কেন দেখবে না!!
আজকাল যেন বড্ডো বেশি আলগা দিচ্ছে ছেলেকে।
ওই কি যেন চুমকি না টুমকি সব বন্ধু হয়েছে যত মিডলক্লাস মেন্টালিটির লোকদের সাথে আসা যাওয়া ওঠা বসা হয়েছে এখন…. না না এভাবে চলতে দেওয়া যাবে না তো!!কড়া হতে হবে দেখছি..
মনে মনে এসব আলোড়ন তুলছিল দীপকের।

~”কাল বাপানদের পিকনিক আছে বুঝলে… আমি ওকে নিয়ে সকাল সকাল বেরিয়ে যাব তোমার টিফিন রেডি করে দেব কিন্তু লাঞ্চবক্স টা আর হয়ে উঠবেনা গো…তুমি একটু অফিস ক্যান্টিনে কিছু খেয়ে নিও প্লিজ”

~”মানে?ওদের স্কুলে তো এসব পিকনিক টিকনিক ছিল না কোনোদিন!এসব কবে শুরু হল আবার!!”

~”আরে না না….স্কুল থেকে না.. ওই তিনচারটে ফ্যামিলি মিলে করা হচ্ছে আরকি… কাল ওদের ক্লাস অফ আছে তাই সবাই ঠিক করেছে বাইপাসের ওধারের পার্কটায় পিকনিক করবে এই আরকি”

~”কি হচ্ছে এসব নন্দা?কি হচ্ছে বলবে?”
~”কি হচ্ছে আবার?”
~”অবাক হওয়ার ভান কোরো না নন্দা… তুমি বুঝতে পারছো না আমি কি বলতে চাইছি?”
~”না…পারছি না বুঝতে… কি বলতে চাইছো? “
~”ছেলের রেজাল্ট কার্ডের ওরকম রিপোর্ট, ছেলেকে নিয়ে সিনেমা দেখা,হুটহাট করে এ বন্ধু ও বন্ধুর বাড়ি যাওয়া…এসব কিইইই!!”
গলার স্বর এবার চড়ে গেল দীপকের।
~”আস্তে কথা বলো… ছেলেটা পড়ছে”
~”পড়ছে? তুমি এখানে জামাকাপড় বের করছো কালকের আড্ডার জন্য আর ও ওঘরে পড়ছে!!বোকা বানাচ্ছ আমাকে?”
~”নাহ্… বোকা আবার বানাবো কি?তুমি তো সত্যিই বোকা”
~”নন্দাআআআ”
চীৎকার করে ওঠে দীপক।
এবার হিসহিসিয়ে ওঠে নন্দা
~”চীৎকার কোরো না ওটাই যে শুধু তুমি করতে পারো সেটা আমি জানি ছেলেকে জানিয়ে বীরত্ব দেখিও না”
এ কোন নন্দা? এত শান্ত অথচ এত দৃঢ়…এত স্থির অথচ এত দৃপ্ত!!
একটুর জন্য থামে দীপক।
~”কি বলতে চাও তুমি?”
~”বলতে চাই না কিছুই বলে লাভ নেই যাকে তাকে বলে অকারণ পরিশ্রম করি না আমি”
~”নন্দা..”
গলাটা নিচে নামলেও রাগের ছোঁয়া স্পষ্ট।
~”তুমি যেমন জীবনে একটা টাকা রোজগারের মেশিন তৈরী হয়েছ,একটা বুদ্ধিমান রোবট তৈরী হয়েছ তেমন অমানুষ করে আমার ছেলেকে আমি তৈরী হতে দেব না।সে জীবনকে একটা নিরেট দেওয়াল ঘেরা কারাগার না ভেবে তার রস রূপ গন্ধ উপভোগ করুক।বয়সের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে অভিযোজিত করুক, রক্ত মাংস আর মগজই শুধু নয় হৃদয়টাও যে মানুষের থাকে তারও যে কিছু ভূমিকা আছে সেটা বুঝতে শিখুক এই আমি চাই…বুঝতে পেরেছো? বুঝতে পেরেছো তুমি!!”
একটানা এতগুলো কথা এভাবে বলে হাঁফাতে লাগলো নন্দা।
~”কেয়া বাত কেয়া বাত…..তা এত সুন্দর করে জীবনকে চিনতে শেখালো কে…তোমার ওই শঙ্কর!!”
হাততালি দিয়ে ব্যঙ্গের সুরে বলে ওঠে দীপক।
~”হ্যাঁ হ্যাঁ শঙ্করদা… আমার একার নয় অনেকের… অনেকের দাদা আর ‘শঙ্কর’ শুধু দেবীর… তার স্ত্রী’র… স্বামী স্ত্রীর সে রসায়ন বোঝার জন্য একটা মন লাগে সেটা তোমার নেই তাই বোঝা সম্ভব নয় তোমার পক্ষে”

একই রকম তীব্রতা নিয়ে চাপা গলায় বললো নন্দা।

সকাল সকাল সাজগোজ করে ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর দীপকের কেমন যেন একটা রোখ চেপে গেল।
নিশ্চয়ই এটা ওই শঙ্করের সাথে দেখা করার একটা গোপন অভিসন্ধি।ছেলে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া.. পিকনিক এসবই জাস্ট আই ওয়াশ….আজ ধরতেই হবে ওদের…. একেবারে হাতে নাতে ধরতে হবে…. তারপর ওপেন প্লেসে একদম মুখোশ খুলে দিতে হবে….
যেমন ভাবা তেমনই অফিসে না যাওয়ার কথা জানিয়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়ে দীপকও।
নন্দা যে ঠিকানার কথা বলেছিল সেইমত পৌঁছে গিয়ে একটু খোঁজাখুঁজি করতেই দেখতে পেল জনা বারোর দলটাকে।
কাউকেই চেনে না সে।
শুধু এটুকু বুঝলো একমাত্র সে-ই বোধহয় যায়নি…. কারণ বাপান কে নিয়ে পাঁচজন বাচ্চা আর তিনজন পুরুষ ও তিনজন মহিলা নন্দাকে বাদ দিয়ে।জায়গাটা বেশ বড়ো…আরও দুটো দল আছে অন্য দিকে…..নিরাপদ দূরত্বে একটা জায়গা দেখে বসলো দীপক।
পেটে টান পড়তে দুপুর দুটো আড়াইটে নাগাদ ওখান থেকে উঠলো বাধ্য হয়েই।

বেলের আওয়াজে রোজকার মত আজও দরজা খুললো নন্দা।
গতকালকের কথা কাটাকাটির পর আর দীপকের সামনা সামনি হয়নি সে।
রাতে ছেলেকে নিয়ে শুয়েছিল সকালে উঠে ওকে রেডি করে নিজে রেডি হয়ে বেরিয়ে গেছিল… অবশ্য কথামত দীপকের জন্য টিফিনে স্যাাণ্ডউইচ,ডিম সিদ্ধ, আর ফ্লাক্সে কফি বানিয়ে রেখেই।
দরজাটা খুলেই পিছন ফিরে রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকলো নন্দা।
চটপট একটু পকোড়া ভেজে চা করে এনে রাখলো দীপকের সামনে।না তাকিয়েও বুঝলো সে এখনও ফ্রেশ হয়নি….কিন্তু গত কালকের ঘটনায় মনটা এতটাই খিঁচড়ে আছে যে কিছু না জিজ্ঞেস করেই
পিছন ফিরে যেতে উদ্যত হল সে।তখনই কানে এল দীপকের ডাক…
“নন্দা…”
ডাকটাতেই অবাক লাগলো যেন… ফিরে তাকাতেই চমকালো নন্দা….
এ কোন দীপক!!
একদিনের মধ্যে গলা চেহারা সব যেন বদলে গেছে…
কিছু বুঝতে না পেরে ঘাবড়ে গিয়ে স্বামীর পাশে সোফায় বসে পড়ে সে..
~”কি হয়েছে গো? কিছু হয়েছে নাকি?”
~”হ্যাঁ হয়েছে…. অনেক কিছু “
সেই রকমই ক্লান্ত অবসন্ন গলায় এমন উত্তর শুনে আরও ভয় পেয়ে যায় নন্দা..
~”কি হয়েছে? অফিসে কিছু?কি গো… বলো?”
আস্তে আস্তে নন্দার হাতদুটো নিজের দু হাতের মধ্যে টেনে নেয় দীপক।
তারপর গাঢ় গলায় বললো

~ “আমি আজ খুব বড়ো একটা শিক্ষা পেলাম নন্দা….এভাবে কখনও ভাবিইনি”
~”কি বলছো বলোতো? আমি কিন্তু মাথামুণ্ডু কিচ্ছু বুঝতে পারছি না… কি শিক্ষা পেলে?কি হয়েছে বলো না ছাই”
মৃদু হেসে বললো দীপক
~”তোমরা… তোমরা আমাকে জীবন চেনালে”
~”মানে!!হেঁয়ালি ছেড়ে কি ব্যাপার বলবে একটু খুলে?”
হাতটা দীপকের হাতের মধ্যে থেকে বের করে নিয়ে বললো নন্দা।
~”তুমি বাপান,ওর বন্ধুরা,ওদের বাবা মা তোমরা… তোমরা সবাই আজ আমাকে নতুন করে জীবন চিনিয়ে দিলে।”
~”ক্-কি করে?..ততুমি কিকরে আমাদের সবাইকে দেখলে?…কি বলছো আমি কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছি না”
~”তোমার বলা ঠিকানায় আজ আমিও গেছিলাম”… ক্লান্ত গলায় ধীরে ধীরে বলে দীপক “অনেকটা দূর থেকে নজর রাখছিলাম তোমাদের দিকে…. তোমাদের ওই মিলেমিশে কাজ করা… গল্পে কথায় মেতে ওঠা… একসাথে হাত মিলিয়ে রান্না… ভাগাভাগি করে খাওয়া…. হো হো হি হি করে প্রাণ খুলে হাসি…যে যেমন করে পারে নিজেকে খুলে ধরা মেলে ধরা…. আমি আমি সবটা সঅঅবটা উপভোগ করছিলাম…. বিশ্বাস করো নন্দা….. জীবনের যে এমন সুন্দর একটা রূপ হয় আমি প্রথম বুঝলাম….. নন্দা… ছোটো থেকেই বাবা মা’র তাগাদায় আমি নিজেকে শুধু ছুটিয়ে গেছি… গুড… বেটার…. বেস্ট হয়ে ওঠার ইঁদুর দৌড়ে শুধু পাগলের মত এগিয়ে গেছি…. সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েও কিকরে আরও উঁচুতে ওঠা যায়…. কি করে নিজেকে আরও যোগ্য প্রমাণ করা যায় সে নেশায় ডুবে থেকেছি…
ক্লান্ত হয়েছি তবু থামতে পারিনি….শুধু জীবন কাটিয়েছি কিন্তু তাকে উপভোগ করিনি…. তুমি ঠিক বলেছিলে নন্দা… আআমি একটা মেশিনে পরিনত হয়েছি শুধু…. কিন্তু আজ তোমাদের চোখ দিয়ে যখন দেখলাম তখন…তখন এই পরিবার, সম্পর্ক,ভালোলাগা, ভালোবাসা,আনন্দ,এ সব কিছু আমি যেন নতুন করে জানলাম বুঝলাম… আমার এভাবে খুব বাঁচতে ইচ্ছে করছে নন্দা… তোমাদের মত করে… তোমার স্বামী,বাপানের বাবা হয়ে… আমাকে নেবে নন্দা?.. আমাকে তোমাদের সঙ্গে নেবে নন্দা?…বলো না..আ….”
স্বামীর মুখে হাত চাপা দিয়ে তার বুকের মধ্যে মিশে গিয়ে কেঁদে হেসে আকুল হল নন্দা….
দীপকও দুহাতে আঁকড়ে ধরলো নন্দাকে… পরম বিশ্বাসে মুখ রাখলো তার কাঁধে…
অনেকক্ষণ মা’কে ডেকে সাড়া না পেয়ে বাপানও বসার ঘরে এসে হাজির….
বাবা মা কে এভাবে দেখতে অভ্যস্ত নয় সে… একটু হকচকিয়ে গিয়ে ছুটে এসে ছোটো ছোটো দুটো হাতে দুজনের যতটা পারলো ধরে বলে উঠলো
~”আমাকেও নাও… আমিও আদর খাবো”
চমকে উঠে দীপক নন্দা দুজনেই ছেলেকে কোলে টেনে নিল পরম আদরে…
সেদিন ছেলে ঘুমিয়ে গেলে দুজনে বহুদিন পর ছোট্টো ব্যালকনিটায় পাশাপাশি…..মাতাল হাওয়ায় ভাসছিল দীপকের গলা….

“এত কথা আছে এত গান আছে এত প্রাণ আছে মোর… এত সুখ আছে এত সাধ আছে প্রাণ হয়ে আছে ভোর…”



সৌজন্যে – প্রতিলিপি

ekhansangbad
Author: ekhansangbad

Related News

Also Read