Select Language

[gtranslate]
২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ রবিবার ৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

।। বন্ধুত্বের ঋণ শোধ ।।

দেবিকা মিত্র

হৈমন্তী, এই চ্যাটার্জি বাড়িতে বিয়ে এসে অবধি একদম শান্তি পাচ্ছে না। শাশুড়ি শ্বশুর এমনকি বড় জা ভাশুর সবাই খুব ভালো এবং ওকে সবাই খুব ভালোবাসেন তবু হৈমন্তীর মনে শান্তি নেই।

বাড়িতে ঢুকেই যেন মনে হচ্ছে, ওকে কেউ আড়াল থেকে দেখছে। মনে হচ্ছে কেউ যেন সরে গেল। সকালে বিকালে সন্ধ্যায় এমন দেখে কিন্তু রাতে যেন বড্ড আতঙ্ক লাগে।

যেদিন প্রথম এসেছে মানে যেদিন ওদের কালরাত্রি ছিল সেদিন হৈমন্তী ওর দিদি শাশুড়ি মানে ওর নিজের শাশুড়িমায়ের, মায়ের কাছে শুয়ে ছিল।আগের দিন যেহেতু রাত জেগেছিল বাসরে তাই সেদিন রাতে শোয়ার পরই ঘুমিয়ে পড়ে এবং সেই ভোরবেলাতেই দিদি শাশুড়ির ডাকে ঘুম ভাঙে।

বৌভাতের দিন রাতে যখন নিজের ঘরে মানে সপ্তর্ষির সাথে ওদের ঘরে ঢোকে তখন যেন কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। ঘর বিছানা এত ফুল দিয়ে সাজানো তবু ঘর থেকে যেন কেমন একটা পোড়া গন্ধ বের হচ্ছিল। তাতেই যেন ওর দম বন্ধ হয়ে আসছিল। সপ্তর্ষিকে দেখে মনে হচ্ছিল না যে, ওর নাকে পোড়া গন্ধটা লাগছে । কিছুতেই বুঝতে পারছিল না কেন এমন হচ্ছে!!

সপ্তর্ষি যখন ওকে কাছে টেনে নেয় তখন হৈমন্তীর যেন কেমন দম বন্ধ হয়ে আসছিল। মনে হচ্ছিল গন্ধটা আরও তীব্র হয়ে ওর নাকে লাগছে। এক ঝটকায় সপ্তর্ষির কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে চেষ্টা করে কিন্তু সপ্তর্ষি যেন কেমন ভাবে ওকে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ধরেছে ।কিছুতেই নিজেকে ওর বন্ধন থেকে মুক্ত করতে পারে না।

নিজের লালসা মিটিয়ে নিয়ে সপ্তর্ষি, পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ে। প্রথম দিনই হৈমন্তীর কেমন যেন লাগছিল সপ্তর্ষিকে। বড্ড অসহায় লাগছিল হৈমন্তীর। ওর মনে হচ্ছিল, সপ্তর্ষির যেন নিজের কোনও কথা বলার নেই বা হৈমন্তীর কোনও কথা যেন শোনার ইচ্ছাও নেই। নিজের কামনা চরিতার্থ করাই যেন ওর কাজ।

হৈমন্তী, বিছানায় শুয়ে যন্ত্রণায় ঝটপট করছে আর সপ্তর্ষি, নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। বিছানায় শুয়েও হৈমন্তী শান্তি পাচ্ছে না। বিছানা ছেড়ে নীচে নেমে বাথরুমে যেতে গিয়ে যন্ত্রণায় কোঁকিয়ে ওঠে। তবু সপ্তর্ষির ঘুম ভাঙে না।

হৈমন্তী অনেক কষ্টে বাথরুমে গিয়ে অঝরে কেঁদে ফেলে। মুখে চোখে জল দিয়ে আয়নার দিকে তাকাতেই একটা পোড়া মুখ দেখতে পায়। আঁ আঁ করে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।

পরের দিন সকালে হৈমন্তী দেখে, ও বিছানায় শুয়ে আছে। ওর ধারে কাছে কেউ নেই। একটু একটু করে সব মনে পড়ে যায় ।ভয়ে গলা শুকিয়ে আসে। গা হাত পায়ে খুব ব্যথা। তবু বিছানায় উঠে বসে। এমন সময় ওর বড় জা, রূপসা ওদের ঘরের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢোকে, হাতে চায়ের কাপ নিয়ে।রূপসারও এই মাস দুয়েক আগে বিয়ে হয়েছে। ওনার বর মানে হৈমন্তীর ভাশুর বিদেশে থাকেন। তাও অনেক বছর হলো। রূপসারও ওনার সাথে থাকেন। বিয়ে উপলক্ষে এসেছে আবার চলেও যাবেন।

রূপসা এসেই বলে….,

ঘুম হলো!! ইচ্ছা করেই ডাকিনি। প্রথম রাত তো!! জানি খুব ধকল গেছে!! বলে মুখ টিপে হেসে ওঠে।

হৈমন্তী কথার উত্তর দিতে পারে না। গলা ঠেলে কান্না বেরিয়ে আসে। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে….,

এ বাবা!! তুমি চা নিয়ে এলে কেন!! আমাকে তো আরও আগে ডাকতে পারতে!!

রূপসা বলে…,

এই তো ডাকতে এলাম। ছোড়দা মানে তোমার বর বলল তোমাকে একটু পরে ডাকতে তাই চা করে একেবারে দুজনের জন্য নিয়ে এলাম। একসাথে চা খেতে খেতে কাল রাতের গল্প শুনব বলে।

হৈমন্তী, লজ্জায় মুখ নীচু করে নেয়। মনে মনে চিন্তা করে, কালকের ঘটনাটা কি দিদিভাইকে বলবো!! পরে চিন্তা করে, না থাক। নিজেদের ব্যক্তিগত কথা অন্যজনকে না বলাই ভালো তবে কাল রাতে এই ঘর থেকে যে একটা গন্ধ বের হচ্ছিল সেটা সবে বলতে যাবে এমন সময় সপ্তর্ষি এসে বলে….,

কি হলো, তোমাদের গল্প হলো!! যাও নীচে যাও! মা তোমাদের ডাকছে।

বৌভাতের পরের দিন সকালটা ভালো কাটলেও রাত যতো বাড়তে থাকে হৈমন্তীর ততো ভয় করতে থাকে।অন্য ঘরে থাকলে তেমন ভয় পায় না আর পোড়া গন্ধটাও পায় না।

মনে পড়ে যায় আগের দিনের কথা।সারাদিন নিজের ঘরে ঢুকলে গাটা ছমছম করে কিন্তু পোড়া গন্ধটা পায় না কিন্তু রাত বাড়লেই গন্ধটা পায় হৈমন্তী। বিকালের পর থেকে নিজের ঘরে আর ঢোকেনি আর গতকালের কথাও কাউকে বলেনি।

যথারীতি রাতের খাওয়া দাওয়া করে নেয় সবাই। সপ্তর্ষি ঘরে চলে গেছে। হৈমন্তী কিছুতেই ওই ঘরে ঢুকতে পারছে না। একটা অজানা ভয় ওকে ওই ঘরে যেতে দিচ্ছে না। রূপসাই জোর করে ওকে ওই ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে যায়। ঘরে ঢুকেই সেই গন্ধটা পায় হৈমন্তী। বুকটা ধরাস করে ওঠে।

আজও সপ্তর্ষি, ওকে জোর করে বিছানায় নিয়ে এসে নিজের লালসা মিটিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। হৈমন্তী আজ বাধা দিতে গেলে সপ্তর্ষি জোর খাটায়। হৈমন্তীর কোনও বাধাকে পাত্তা দেয় না।

সপ্তর্ষি যতো ওর কাছে আসে সেই গন্ধটা আরও বেশি উগ্র হয় আর হৈমন্তীর ততো কষ্ট হয়। আজ হৈমন্তী, সপ্তর্ষিকে বলে….,

তুমি কি একটা গন্ধ পাচ্ছো? কেমন একটা দম বন্ধ করা গন্ধ!

সপ্তর্ষি, হা হা করে পিশাচের মতো হেসে ওঠে। ওর হাসি হৈমন্তীর কানের ভিতরে গিয়ে বুকে ধাক্কা লাগে। সপ্তর্ষি নিজের কাজ শেষ করে ঘুমিয়ে পড়ে আর হৈমন্তী নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকে এবং এক সময়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

হঠাৎ মনে হলো ওর গায়ে একটা গরম নিঃশ্বাস পড়ছে। চোখ খুলে দেখে সেই পোড়া মুখটা ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। আজ আর হৈমন্তীর চিৎকার করার ক্ষমতা থাকে না । চোখ বন্ধ করে কাঠ হয়ে শুয়ে থাকে।

কোন এক অজানা শক্তি ওকে সাহস জোগায়।হৈমন্তী চোখ খুলে দেখতে ও শুনতে পায় সেই পোড়া মুখ কথা বলছে। বলছে….,

তুমি পালাও। ও তোমাকেও মেরে ফেলবে। আমি তোমার শুভাকাঙ্ক্ষি । বন্ধুও বলতে পারো। আমার মতো যাতে তোমার ক্ষতি না হয় সেটাই চাই। তোমাকে, আমার মতই অবস্থা করবে। ধীরে ধীরে তোমার সব গ্রাস করবে তারপর তোমাকে মেরে ফেলে সমস্ত প্রমাণ লোপাট করে দেবে। আমাকে যেমন করেছে। আজও কেউ জানে না আমার কি হয়েছিল!! তুমি এখান থেকে চলে গিয়ে ওকে শাস্তি দাও। ও শাস্তি পেলে তবেই আমার অতৃপ্ত আত্মা মুক্তি পাবে, শান্তি পাবে। আমি তোমার বন্ধু। আমাকে ভয় পেও না। ও, তোমার ক্ষতি করতে পারবে না আর তোমাকে শেষ করতেও পারবে না। আমি তোমাকে মারতে দেব না।

পরে আবার বলে…,

বন্ধু, তুমি আমার একটা কাজ করে দেবে!!

হৈমন্তীর যেন সাহস বেড়ে গেছে। ও বলে, কি কাজ?

তখন সেই অশরীরী বন্ধু, হৈমন্তীকে বিছানা থেকে নামিয়ে আনে।বন্ধুর নির্দেশে ধীর পায়ে হৈমন্তী পৌঁছে যায় ওর ঘরের সেই দেওয়াল আলমারিটার কাছে। সেই অশরীরী বন্ধু ওকে দিয়ে সেই আলমারিটা খোলায়। আলমারির একদম উপরের তাকে যেসব জিনিস আছে তার মধ্যে একটা কাঁচের ফ্লাওয়ার ভাস আছে। সেটা নামিয়ে তার মধ্যে থেকে একটা চিঠি বের করে আর একটা হীরের আংটি বের করে হৈমন্তী

হৈমন্তী, সেটা খুলে দেখে তাতে লেখা আছে…..,

সপ্তর্ষি, আমাকে ঠেকিয়ে বিয়ে করেছে।আমাদের ভালোবাসার বিয়ে। বিয়ের আগেও অনেকের সাথে ওর সম্পর্ক ছিল। সব জেনেও ওকে ভালোবাসি বলেই আমার বাপের বাড়ির অমতে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করি। আমার বিয়ের জন্য বানানো সমস্ত গয়না নিয়ে সপ্তর্ষির সাথে পালিয়ে যাই । ওর অনেক জনের সঙ্গে সম্পর্ক আছে। ওর চরিত্র খারাপ। অনেকের সাথে শারীরিক সম্পর্ক আছে। আমি জানতে পেরে গিয়েছি তাই আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে। জানিনা কতদিন আর আছি। আমার সব গয়না বিক্রি করে দিয়ে ফুর্তি করেছে। আমি আমার ঠাকুমার দেওয়া একটা হীরের আংটি লুকিয়ে রেখেছি এই ফুলদানিতে ।সেটা সপ্তর্ষি জানে না। আমি যদি না থাকি, ওটা যে পাবে সে যেন আমার বোনকে দিয়ে দেয়।
ঠাকুমার শেষ স্মৃতি হিসেবে বোনের কাছে থাকবে।

ইতি – রুমেলা ব্যানার্জি

হৈমন্তী সেই ফুলদানি থেকে সেই আংটিটা বের করে নেয়। হঠাৎ করেই সপ্তর্ষির ঘুম ভেঙে যায় এবং হৈমন্তীর হাতে সেই আংটিটা দেখে আর লোভ সামলাতে পারেনি। ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর উপর এবং এলোপাথারি মারতে থাকে কিন্তু একটা মারও হৈমন্তীর গায়ে পড়ে না।হৈমন্তীর গলা টিপে ধরতে গেলে সপ্তর্ষি আচমকা মেঝেতে পড়ে যায়। হঠাৎ করেই রুমেলা বলে চিৎকার করে ওঠে সপ্তর্ষি আর জ্ঞান হারিয়ে ফেলে ।

হৈমন্তী যেন সম্বিৎ ফিরে পায়। সব ঘটনা মনে পড়ে যায় হৈমন্তীর। বুঝতে পারে এই রুমেলা কে? এই অদৃশ্য বন্ধুই আজ হৈমন্তীকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছে। ওর সাহস বাড়িয়ে দিয়েছে।

রুমেলার থেকেই হৈমন্তী জানতে পারে সপ্তর্ষি কিভাবে ওকে মেরেছে।
সপ্তর্ষি, রূমেলাকে প্রথমে শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলে মুখে অ্যাসিড ঢেলে মুখটা বিকৃত করে দেয় এবং রাতের অন্ধকারে ওকে নদীর জলে ভাসিয়ে দেয়। মুখটা এমনভাবে পুড়ে ছিল যে একদম চেনা যাচ্ছিল না। ওর বাড়ির লোকেরা বা পাড়া প্রতিবেশীরা জানত না রুমেলা মারা গেছে। সবাই জানতেন মানে সপ্তর্ষি আর ওর পরিবারের লোকেরা, সবাইকে বলেন যে, রুমেলা অন্য লোকের সাথে পালিয়ে গেছে। একটা নকল চিঠি ওনাদের দেখান। তাতে রুমেলা অন্য কারোর সাথে পালিয়ে যাচ্ছে সে কথাই লেখা থাকে।

এইসব ঘটনা জানার পর, পরের দিন, হৈমন্তী খুব ভোরে উঠে সোজা চলে যায় বাড়ির কাছের পুলিশ স্টেশনে এবং সেখানে গিয়ে সব কথা জানিয়ে লিখিত অভিযোগ করে প্রমাণ সহ। । সেদিনই সপ্তর্ষির বাড়ির সবাইকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। একমাত্র রূপসা এবং বড় ভাশুর বাদে কারণ এই ঘটনার সময় ওনারা ওখানে ছিলেন না আর এই ঘটনার কথাও জানতেন না মানে ওনাদের জানানো হয় নি।

ওনারা যখন সব জানতে পারেন তখন আশ্চর্য হয়ে যান। ধিক্কার দিতে থাকেন এবং ওনাদের শাস্তি প্রার্থনা করেন।তবু নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করতে হয় বিনা অপরাধে।

পরে পুলিশের কাছে সপ্তর্ষি সব কথা স্বীকার করেছে কারণ রূমেলা যে ওকে আর বাঁচতে দিতে চায় না। ও শাস্তি পেলেই যে রূমেলা মুক্তি পাবে। তাই জেলেও ওকে ভয় দেখাতে আরম্ভ করে এবং এক সময়ে সপ্তর্ষি নিজের দোষ স্বীকার করতে বাধ্য হয়।

রুমেলার কথা মতো হৈমন্তী মর্গ থেকে রুমেলার বডি বের করার ব্যবস্থা করে। রুমেলা বলে দিয়েছিল ওর দেহ চেনবার উপায়। ওর দুই পায়ে ছয়টা করে কড়ে আঙুল আছে। এটাই ওকে চেনার উপায়। পরে রুমেলার দাদার এসে ওকে সনাক্ত করেন এবং ওকে দাহ করেন।

রুমেলা পরম বন্ধুর মতো হৈমন্তীকে বাঁচিয়েছিল আর হৈমন্তী সেই অতৃপ্ত আত্মার মুক্তি দিয়ে বন্ধুত্বের ঋণ শোধ করল।

হৈমন্তীর, সপ্তর্ষির কাছ থেকে ডিভোর্স পেতে অসুবিধায় পরতে হয় নি।

এবার নতুন করে নতুন বন্ধু নিয়ে নতুন জীবনের পথে এগিয়ে যাওয়াই হৈমন্তীর উদ্দেশ্য।

ekhansangbad
Author: ekhansangbad

Related News

Also Read