দেবিকা মিত্র:-সুস্মিতার বিয়ে হয়েছে এক বছর হলো। বাপের বাড়ি হাওড়ায় আর শ্বশুরবাড়ি কলকাতায়। কিন্তু ওর বর রণিত, স্কুল টিচার আর ওর স্কুলটা পটাশপুর নামে এক অজ পাড়া গাঁয়ে তাই বিয়ের পর সেখানে চলে যেতে হয় ।
অষ্টমঙ্গলা আর হানিমুন কাটিয়ে রণিত, সুস্মিতা ওরফ সুমিকে নিয়ে চলে আসে পটাশপুরে। ছুটিছাটায় ওরা দুজনে কলকাতায় যায় ।
এই পটাশপুরের বাড়িটা বেশ খোলামেলা। এই বাড়ির মালকিন খুব ভালো ।সুমিকে খুব ভালোবাসেন ।সুমি, ওনাকে কাকিমা বলে ডাকে। এই বাড়ির পিছনের দিকে একটা মাঠ আছে। সেখানে বাচ্চা বড় সবাই খেলা করে।সুমির এই বাড়িটা বেশ পছন্দ হয়েছে।
সুমির বাপের বাড়ি খুব রক্ষণশীল। বাড়ির প্রধান হলেন সত্তরের বিমলা দেবী ।উনি খুব রাগী আর ওনার কথাতেই ওনার সংসার চলে। বিমলা দেবী হলেন সুমির ঠামি ।উনি মেয়েদের খেলাধুলা পছন্দ করেন না। বাড়ির বাইরে কোথাও যাওয়া পছন্দ করেননা। ঘরের মধ্যে মেয়েদের থাকা পছন্দ করেন। মেয়েদের পড়াশোনা করাও খুব একটা পছন্দ করেন না।
ওনার মনে একটা ভয় কাজ করে। আসলে ওনার ছোট মেয়ে পড়াশোনায় খুব ভালো ছিল তাই ওকে পড়াশোনা করতে দেওয়া হয়। একদিন সেই মেয়ে বাড়ির কাউকে না জানিয়ে অন্য জাতের ছেলের সাথে পালিয়ে যায়। ওনার এত শাসন থাকা সত্বেও ওনার মেয়ে যে এমন কাজ করতে পারে সেটা উনি ঘূণাক্ষরেও টের পাননি আর কল্পনাও করতে পারেননি । এরপর থেকে উনি একদম পাল্টে যান।
সুমি আর রুমি দুই বোন তবে সুমির কাকার মেয়ে হলো রুমি ।যেহেতু ওদের যৌথ পরিবার সেহেতু ওরা একসাথে থাকে। সুমির এক ভাই আছে আর আছে চার দাদা। দাদারা সবাই জ্যেঠতুতো তবে ভাইটা নিজের। দাদারা বা ভাই পড়াশোনা করেছে আর এখনও তিনজন করে। রুমিও এবার মাধ্যমিক দেবে। রুমি আর সুমিকে ঠামি বাড়ির কাজকর্মের মধ্যে আটকে রাখেন যাতে ওরা বারমুখো হয়ে না ওঠে।।
সুমি খেলাধূলায় খুব ভালো ছিল। স্কুলের সব খেলায় সুমি নাম দিত আর তার থেকে প্রাইজও পেত কিন্তু বাড়িতে সেটা দেখাতে সাহস হতো না কারণ ঠামি যে রাগ করবেন। হয়তো রাগ করে স্কুলে আর যেতে দেবেন না। তাই সুমি বাড়িতে কিছু জানাত না। রুমি আর সুমি মেয়েদের স্কুলে পড়ে। রুমি জানে দিদিভাই খেলাতে প্রাইজ পেয়েছে কিন্তু বাড়িতে বলে না। দুজনের খুব ভাব।
সেবার সুমি কবাডি খেলায় স্কুলেকে প্রাইজ এনে দিয়েছিল। স্কুলের টিচাররা ওর প্রশংসায় পঞ্চমুখ কিন্তু বাড়ির কেউই এটা জানে না। একবার ঠামি জানতে পেরে গিয়েছিলেন যে সুমি ক্রিকেট খেলে হাতে চোট পেয়েছে। সেদিন উনি খুব রাগ করে সুমির স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেন। সুমি কান্নাকাটি করে ঠামির পা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করে যে আর কোনদিন খেলবে না তবেই উনি ওকে স্কুলে যাওয়ার পারমিশন দেন।
সুমির মনে খুব দুঃখ। খেলাটা মন দিয়ে খেলতে পারে না বলে। ওদের দুই বোনের কোনও স্বাধীনতা নেই এই বাড়িতে। ওরা পরাধীনের মতো এখানে থাকে তাই ওদের দুই বোনের মনে খুব কষ্ট।সুমির মা চান মেয়ে স্বাধীন ভাবে বাঁচুক কিন্তু এই বাড়িতে যে মেয়েদের কোনও স্বাধীনতা নেই।
সুমি যখন ওর মায়ের কাছে দুঃখ করে তখন উনি বলেন..,,
বিয়ের পর এসব করিস মা!! এখন দুঃখ পাসনা ।কি করব বল!! আমার যে হাত পা বাঁধা।
সুমি বলে…,
বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি যদি এমনই হয় তখন!!
সুমির মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন…,
সবই কপাল মা!!
মাধ্যমিক পাশ করে যাওয়ার পর থেকেই সুমির জন্য পাত্র দেখা শুরু হয়ে যায়। উচ্চ মাধ্যমিকের পর সুমির বিয়ে হয়ে যায় মাত্র আঠারো বছর বয়সে।সুমি এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেন মুক্তির স্বাদ পায় ।হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। কারণ সুমি জানে, ওর শ্বশুরবাড়ির সবাই খুব আধুনিক।
বিয়ের পর সুমি একরাশ আশা নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে আসে রণিতের হাত ধরে। কিন্তু এখানে বেশিদিন থাকতে হয় নি। এই বাড়ির সবাই খুব স্বাধীনচেতা বলেই সুমির মনে হয়। সুমি চলে যায় পটাশপুরে।
পটাশপুরের এই বাড়িটা সুমির খুব পছন্দ ।এমন খোলামেলা বাড়িতেই কিন্তু বদ্ধ জীবন যাপন করে এসেছে সুমি তবু খুব ভালো লাগে এই বাড়িটা। এখানে কেউ ওকে বাধা দেওয়ার নেই। মুক্ত মনে সবকিছু করতে পারে। রণিত খুব ভালো মনের মানুষ। ওর সব কিছুতেই রণিতের পূর্ণ সমর্থন আছে। তবু সুমি যেন এখন একটু আড়ষ্ট হয়ে গেছে।বিয়ে হয়ে গেছে তাই সবেতেই লজ্জা পায়।
রণিত, ওকে আবার পড়াশোনা করতে বলে। সুমি তাতে রাজি তবে ওর যে খেলতে বেশি ভালো লাগে। কবাডি খেলায় ও যে চ্যাম্পিয়ন। সুমি সাহস করে সেই কথাটা রণিতকে জানাতে পারেনি। ওর যে ক্রিকেট খেলা পছন্দ সেটাও মনের মধ্যে জমিয়ে রেখেছে। লজ্জায় বলতে পারেনি রণিতকে।
রণিত স্কুলে চলে যাওয়ার পর সুমি পড়াশোনা নিয়ে বসে। তবে এখনও কলেজে ভর্তি হতে পারেনি। রণিত বলেছে সামনের বছর কলেজে ভর্তি করে দেবে। সুমি জানলার সামনে বসে মাঠের খেলা দেখতে দেখতে পড়াশোনা করে। পড়াশোনা যে কতটুকু হয় তা কে জানে!! মনটা পরে থাকে মাঠে।
এই মাঠে বিকাল থেকে খেলা শুরু হয় আর ছুটির দিন সকাল থেকেই ফুটবল ক্রিকেট ইত্যাদি খেলা হয়। সুমিদের বেড রুমের জানলা দিয়ে সব দেখা যায়। সুমির অবসর সময় কাটে ওদের খেলা দেখে আর চিৎকার শুনে।
ওর জানলার সামনে কিছু বাচ্চা মেয়ে এক্কা দোক্কা খেলে। কখনও আবার কিছু বাচ্চা ছেলেও চলে আসে ওদের সাথে খেলতে। তখন ওরা কবাডি খেলে আবার কখনও কুমির ডাঙা, বুড়ি বসন্ত ইত্যাদি খেলা খেলে।এছাড়াও ডাংগুলি, কাঁচের গুলি নিয়েও ওরা খেলে।
সুমির ওদের খেলা দেখে মন ভরে যায় । ছোটবেলার কত কথা মনে পড়ে যায়। আসলে সুমি, বাপের বাড়িতে খেলতে না পারলেও মামার বাড়িতে গেলে খেলাধুলা করতে পারত। যদিও বা মামার বাড়ি খুব একটা যাওয়া হত না। বছরান্তে একবার কি দুবার। তবু ওখানে গিয়ে মন খুলে খেলাধুলা করতে পারত। কেউ বকা দেওয়ার বা বারণ করার ছিল না।
এই এক বছরে ওই বাচ্চাদের সাথে বেশ ভালো ভাব জমে গেছে সুমির । কেউ চোট্টামো করলে তাই নিয়ে যখন নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে তখন সুমি ওদের সমস্যার সমাধান করে দেয় জানলায় বসেই। ওরা সুমিকে দিদি বলে ডাকে।
সেদিন বড়রা মাঠে খেলছিল না কারণ মাঠ জুড়ে প্যান্ডেল হয়েছে। ওখানে নাকি জলসা হবে। কলকাতা মুম্বই থেকে সব গায়ক গায়িকারা আসবেন। সব শেষে নাকি যাত্রা হবে। সুমি আগে কোনদিনই যাত্রা দেখেনি। তাই ওর খুব আগ্রহ যাত্রা দেখার। মাঠে গিয়ে না দেখলেও চলবে কারণ জানলা দিয়ে সবই দেখা যায়।
যেহেতু বড়রা মাঠে খেলছে না তাই মাঠ কিছুটা ফাঁকা কিন্তু ছোটরা খেলছে। সেদিন বাচ্চারা সুপারী গাছের শুকনো পাতা নিয়ে খেলছিল। সুমি মামার বাড়িতে এই খেলাটা দেখেছে এবং মামাতো ভাইবোনেদের সাথে খেলেওছে ।অনেক দিন বাদে এটা দেখে ওর খুব ভালো লাগে।মনে পড়ে যায় ছোটবেলার কথা।
ও দেখে বাচ্চারা এক একজন করে ওই পাতার উপর বসছে আর বাকিরা সেই পাতা ধরে টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে আর হেসে গড়িয়ে পরছে। ওদের দেখে সুমিও হেসে অস্থির। ইচ্ছে করছে একছুটে ওদের কাছে যেতে কিন্তু লজ্জায় সেটা পারেনি।
সেই পাতাটা ছিঁড়ে যেতেই ওরা আবার অন্য খেলায় মেতে ওঠে। ওরা সেদিন একটা ছোট বাঁশের টুকরোকে ব্যাট আর ইঁট দিয়ে উইকেট বানিয়েছে কিন্তু বল পায় নি তাই অনেক কাগজ একসাথে করে একটা বলের আকারে তৈরি করে নেয়। সুমি সেটা দেখে খুব খারাপ লাগে তাই ওদের হাতে টাকা দিয়ে বলে…..,
যা! তোরা দুটো বল কিনে নিয়ে আয়। আজ তোদের সাথে আমিও খেলব। তবে আম্পায়ার হয়ে। বাচ্চারা খুব খুশি ।চিৎকার করে ওঠে। তাতে সুমি যেন আরও এনার্জি পায়। লজ্জা ভুলে পিছনের দরজা দিয়ে মাঠে চলে আসে সুমি ।
বাচ্চাদের দুটো দলে ভাগ করে দেয়। একদল আগে একজন একজন করে বল করবে আর বাকিরা ফিল্ডিং কাটবে আর অন্য দলের একজন একজন করে ব্যাট করবে। টস করে কারা আগে ব্যাট করবে সেটাও সুমি ঠিক করে দেয়। আজ যেন সুমি সেই ছোট্ট বেলায় ফিরে গেছে। সেই মামার বাড়িতে যেমন খেলতো মামাতো ভাইবোনেদের সাথে, যেমন স্কুলে খেলত বন্ধুদের সাথে ঠিক তেমনই ।মনটা হারিয়ে যায় সেইসব দিনে ।
খেলা খুব জমে উঠেছে। হঠাৎ করেই সুমি যেন বাচ্চা হয়ে যায়। ওদের থেকে ব্যাটটা মানে বাঁশের টুকরোটা নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে এবং বলে… ,
বল দে!!
প্রথম বলেই সুমি অনেক দূরে পাঠিয়ে দেয় বলটা। সুমির মনে হয় ওর ইচ্ছা গুলো ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছে। অনেক দূরে চলে যাচ্ছে। বাচ্চারা চিৎকার করে ওঠে, দিদির খেলা দেখে নাকি বলটা হারিয়ে যাওয়ার জন্য সুমি বুঝতে পারে না।সুমি অনেক দূরে বলটা চলে যাওয়া দেখছে। এক সময় বলটা অদৃশ্য হয়ে যায়। সুমির বুক ঠেলে কান্না বেরিয়ে আসে। এটা আনন্দাশ্রু। হঠাৎ করেই রণিতের কথায় সম্বিৎ ফিরে আসে। রণিত বলে….,
দারুণ!অসাধারণ!! তুমি পারবে ।
সুমি লজ্জা পেয়ে বাঁশের টুকরোটা ফেলে দিয়ে বাড়িতে চলে আসে।
সুমির মনটা খুব ভালো হয়ে যায়।
এরপর থেকে সুমি সুযোগ পেলেই ওদের খেলা শেখায়। ওদের সাথে কবাডি খেলে, বুড়ি বসন্ত খেলে আবার ক্রিকেটও খেলে। রণিত, ওদের জন্য একটা কাঠের ব্যাট আর কয়েকটা বল কিনে দিয়েছে।সুমির ইচ্ছাগুলো এখনও মরে যায় নি। এখনও ফিরে যেতে ইচ্ছে করে সেই খেলার মাঠে। মুক্ত আঙ্গিনায়, যেখানে ওর স্বপ্ন গুলো ঘুরে বেড়ায়।
রণিত যে ওর ইচ্ছার দাম দিতে জানে। রণিত চায়, সুমি যা চায় তাই করুক। সুমিকে ক্রিকেটে ভর্তি দিতে চায় তবে এখানে যে এখনও মেয়েদের ক্রিকেট খেলাকে সুনজরে দেখে না আর মেয়েদের ক্রিকেট শেখানোর কোনও ব্যবস্থা নেই। তবু চেষ্টা করে যদি কলকাতায় নিয়ে গিয়ে ওকে দিয়ে খেলানো যায়।
সুমি সত্যিই খুব ভাগ্যবতী রণিতের মতো একটা বন্ধু পেয়ে।সুমি, ইচ্ছা ডানায় ভর করে পেরিয়ে যেতে চায় অনেক অনেক দূরে। ঠিক মুক্ত বিহঙ্গের মতো।
সৌজন্যে – প্রতিলিপি