কৃষ্ণা দাস কর্মকার :- “বাবাই আমাকে একটু বাইরে ঘোরাতে নিয়ে যাবি? কতদিন হলো এই চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি আছি বলতো?আজকাল তো পেনশনটাও আমাকে সই করিয়ে তুই নিজেই তুলিস।বড্ড ইচ্ছে করে রে।” পয়ষট্টি বৎসরের বিধবা সুমনা দেবী একমাত্র ছেলে রাজীবের কাছে আবদার করে।
বিরক্ত রাজীব বলে:- “মা তোমার অদ্ভুত বায়না শুনে অবাক লাগে। বেশ তো সময় মতো খাচ্ছ দাচ্ছ ঘুমাচ্ছ,রোগ হলে ডাক্তারকাকু এসে দেখে যাচ্ছে।কাজ বলতে তো খুন্তি নাড়া মায়াদি তো সব যোগাড় করে দিয়ে যায়। আর আমরা দুজন অফিসে বেরিয়ে গেলে বান্টিকে দেখভাল করো তাও তো ও স্কুল থেকে ফেরার পর। তা তোমার কোথায় ঘুরতে যাওয়ার শখ হচ্ছে শুনি?”
সুমনা দেবী বলেন:- ” না রে সেরকম কোনো জায়গা নয়,খোলা আকাশের নীচে মুক্ত বাতাসে কিছুক্ষন থাকতে চাই।”
রাজীব রেগে যায় বলে :- ” মা এসব ছেলেমানুষী বন্ধ করো। এতো সুখে আছো তবু তোমার পোষাচ্ছে না?জান কতো মানুষ আছে যারা বৃদ্ধ মা বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসছে। তুমি তো আরামে আছো।”
আর কিছুবলেন না সুমনা দেবী।একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস পড়ে।মনে মনে ভাবেন একটা সময় কর্তা বারবার বলা সত্ত্বেও ছেলের পড়ার ক্ষতি হবে ভেবে কোথাও ঘুরতে যাননি। আজ সেই ছেলে একটু বাইরের প্রকৃতি দেখাতে চাচ্ছেনা।অথচ ছেলে বৌমা আর নাতি প্রতি সপ্তাহেই ঘুরতে যায়।
হয়তো বুড়ো হলে এভাবে মুল্যহীন হয়ে পড়তে হয়।
আজ সকাল থেকে খুব আনন্দ হচ্ছে সুমনা দেবীর আজ তার ছোটো বোন শোভনা আসবে সারাদিন দিদির সাথে কাটাবে। শোভনা একবছর হলো প্রধান শিক্ষিকা পদ থেকে রিটায়ার্ড করেছে। এক ছেলে এক মেয়ে সুপ্রতিষ্ঠিত। দুজনেই দেশের বাইরে সেটেলড্। কিন্তু শোভনা কারো কাছে থাকেনা দুবছর হলো স্বামী মারা গেছে চার পাঁচজন কাজের লোক নিয়ে তার সংসার। প্রচন্ড সাহসী,প্রতিবাদী ও বুদ্ধিমান। রাজীব বা তার বৌ শোভনা আসার জন্য ছুটি নিতে পারবেনা বলে জানিয়েছে। অগত্যা মায়ার হাতে কিছু টাকা দিয়ে ছোটোবোনের পছন্দের খাবার করিয়ে নিয়েছে সুমনাদেবী।দুবোন সারাদিন খুব গল্প আনন্দ করে। সুমনা বোনের কাছে তার বন্দী জীবনের দুঃখের কথা বলে। শোভনা বলে :- “দুঃখ করিসনা দিদি আমি তোকে নিয়ে যাবো।
অনেকদিন তো অন্যের জন্য বাঁচলি এবার নিজের জন্য একটু বাঁচতে শেখ। এখন কাউকে কিছু বলবিনা সব ব্যবস্থা করি তারপর যাবার আগে জানাবি।”
কথা রেখেছে শোভনা দিল্লি,বৃন্দাবন, হরিদ্বার মুসৌরি যাবার সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। গোপনে গোছগাছ করে ফেলেছেন। পরিকল্পনা মতো যাবার দিন সকালে রেডি হয়ে ছেলে বৌমাকে জানায় সুমনা। রাজীব বাকরুদ্ধ হয়ে যায়।বলে:- “কি বলছো মা? তুমি চলে গেলে কি করে চলবে আমাদের? কি করে ম্যানেজ হবে? না তোমার যাওয়া হবেনা।”
সুমনা বলে:- “তা একটু কষ্ট তোদের হবে। তবে আমি অনেক দিন আদর্শ বৌ , আদর্শ মা, আদর্শ শাশুড়ি আদর্শ ঠাকুমা হয়ে কাটালাম এবার একটু নিজেকে ভালো বাসতে চাই, নিজের অস্তিত্ত্বটাকে জাগাতে চাই।তাই আমার সিদ্ধান্ত পাল্টাবেনা।”
রাগত স্বরে রাজীব বলে :- “এ ঘর থেকে একবার বেরোলে আর এঘরে ঠাঁই পাবে না।”
সুমনা দেবী বলেন:- “তুই বোধহয় ভুলে যাচ্ছিস বাবাই বাড়িটা আমার নামে আছে।আর আমার পেনশন আছে।তাছাড়া ওখান থেকে ফিরে আমি কিছুদিন শোভনার কাছে থেকে বিশ্রাম করবো। তারপর তোরা যদি চাস তো আসবো নাহলে দুইবোনেই বাকী জীবনটা একসাথে কাটিয়ে দেবো।”
বাইরে গাড়ির হর্ণ শুনে ট্রলিব্যাগটা টেনে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো সুমনাদেবী। হতভম্ব রাজীব অবাক হয়ে মায়ের গতিপথের দিকে তাকিয়ে রইলো।
সৌজন্যে – প্রতিলিপি