নুসরাত জাহান লিজা :- মায়ের দেয়া হারটা চুরি করে এনে ব্যাগে ঢুকানোর সময় কেমন যেন একটা অসাড়তা এসে ভিড়ল নীরার মনে। তবে পরক্ষণেই সেটাকে প্রাণপণে সরিয়ে দিতে চাইল। এগুলো তো ওর বিয়ের জন্যই বানিয়েছেন মা, এটাকে কি চুরি বলে! এখন ওর পছন্দে যদি তার ভরসা না থাকে তবে বাসা ছেড়ে পালানো ছাড়া আর উপায় কী!
তবুও অসাড় অনুভূতি গেল না পুরোপুরি, অপরাধবোধের একটা সূক্ষ্ম কাঁটা ওর হৃদপিণ্ডে যেন গেঁথেই রইল। তখনই ওর মোবাইলে রাতুলের টেক্সট মেসেজটা এলো,
“আমি ঠিক রাত সাড়ে বারোটায় তোমাদের বাসার সামনের গলিতে থাকব। সময়মতো চলে এসো।”
তাতেই যেন ওর মধ্যে আবারও স্বাভাবিকতা ফিরে এলো। বড় ব্যাগটার চেইন লাগিয়ে ওর খাটের এক কোণায় রাখল, যেখানে মায়ের চোখে হুট করে পড়ার সম্ভাবনা নেই। ঘড়িতে এখন দশটা সতেরো। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক সময় আছে। নয়টার দিকে খাওয়া হয়েছে। মা এই সময় টেলিভিশন দেখেন কিছুক্ষণ।
সহসাই যেন মায়ের উপরে অভিমান হলো। কিছুদিন আগেও তো ওদের মা মেয়ের ছোট্ট সংসারটা কত মসৃণ ছিল! ওর দূরসম্পর্কের এক মামা একটা বিয়ের সম্বন্ধ আনেন, মা যেন অস্থির হয়ে উঠলেন বিয়ে দেবার জন্য। অগত্যা রাতুলের কথা বলতে হলো। কিন্তু কিছুতেই তিনি রাজি হলেন না। ওদিকে রাতুলের বাড়িতেও এখনও ওর বড় ভাই বিয়ে করেনি, এখনই ছোট ছেলেকে বিয়ে দিতে নারাজ তার বাবা-মা।
রাতুল পালিয়ে বিয়ে করার প্রস্তাব দিতেই তাই লুফে নিয়েছে নীরা। ওর অল্প কিছু জমানো টাকা ছিল, ছোটবেলা থেকেই হিসেব করে চলতে শিখেছিল সে। ওই অল্প টাকায় আর ক’দিন চলবে, বাধ্য হয়ে মায়ের আলমারি থেকে ওর জন্য রাখা গয়নাগুলো থেকে হারটা সরিয়েছে। সব নিতে মন সায় দেয়নি। তার সারা জীবনের সঞ্চয়!
“ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন ওভাবে? এদিকে আয়।”
মায়ের ডাকে সম্বিৎ ফেরে নীরার, পায়ে পায়ে তার পাশে এসে বসে।
“চুলে তেল দিয়ে দেই, তেল নিয়ে আয়।”
“ইচ্ছে করছে না মা।”
“তাহলে আমাকে দিয়ে দে৷ মাথাটা বড্ড ঝিমঝিম করছে।”
“সে কী! আগে বলোনি কেন?”
“আরে তেমন কিছু না। তাছাড়া কয়দিন পরে তো একাই থাকতে হবে। অভ্যাস করছি।”
“মানে…” চমকে উঠে কম্পিত গলায় প্রশ্ন করে নীরা।
“মানে আবার কী, বিয়ে হলেই তো তুই চলে যাবি। তারপর তো…”
মায়ের একটা দীর্ঘশ্বাস শুনল যেন নীরা! হন্তদন্ত হয়ে বলতে শুরু করেছিল, “এসব বলবে না, মা। আমি বিয়েই করব না…” বলতে বলতে শেষের দিকে গলাটা মিইয়ে গেল।
“এটা বললে হয়, সবার একদিন যেতে হয়…”
নীরা উত্তর খুঁজে পায় না। অপরাধবোধ যেন ফিরে আসছিল। ওদিকে রাতুল…
সে ভুল করছে না তো, দ্বিধান্বিত হয় নীরা! উঠে গিয়ে তেলের কৌটা নিয়ে এসে ভীষণ যত্ন করে মায়ের মাথায় বিলি কেটে তেল দিয়ে দিচ্ছে। আজই হয়তো শেষবার!
মা এটা সেটা কত কী বলছেন! এর সবকিছুই যেন ওর কর্ণকুহরে প্রবেশ করতে ব্যর্থ। মা প্রতিদিন এগারোটায় শুয়ে পড়েন, আজ যেন তিনি স্মৃতিকাতরতায় আচ্ছন্ন। কথা ফুরাচ্ছে না, মা কি কিছু টের পেয়েছেন!
বারোটার দিকে তিনি আবদার করলেন, “আজ আমার কাছে ঘুমাবি?”
না করতে গিয়েও রাজি হলো, মায়ের ওষুধের মধ্যে একটা ঘুমের ওষুধও আছে, যেটা অর্ধেক করে তিনি প্রতিদিন খান ডাক্তারের পরামর্শে। খানিক বাদেই ঘুমিয়ে পড়বেন এটা তো জানা কথাই।
মা ঘুমিয়ে পড়েছেন বলেই মনে হচ্ছে। নীরা কতক্ষণ মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল ঠাহর করতে পারে না! হাতের মোবাইল ফোনটা কেঁপে উঠতেই, রাতুলের মেসেজ পেল,
“তাড়াতাড়ি বের হও। পনেরো মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে আছি। পরে কেউ দেখলে তো সন্দেহ করবে।”
মাকে একবার জড়িয়ে ধরার ইচ্ছেটা অধরাই থেকে গেল। তাকে জাগিয়ে দিতে চায় না। মা’য়ের বিশ্বাস ভেঙে তার সামনে সে কিছুতেই দাঁড়াতে পারবে না। তাই আর ফেরাও হবে না বোধহয়!
সকালে ঘুম ভেঙে ওকে না দেখলে মা কী করবেন! কাঁদবেন? রাগে চিৎকার করে অভিশা’প দেবেন? জানে না নীরা!
নিজের ঘর থেকে ব্যাগটা তুলে নিয়ে পুরো ঘরটায় একবার চোখ বুলিয়ে অতি ধীরপায়ে হাঁটছিল। এখানে ওর কত স্মৃতি! সব যেন সিনেমার মতো মনের পর্দায় ভেসে উঠছে।
ওর সেবার জ্বর হলো, মা সারারাত ঘুমালেন না! সে কিছুটা দুরন্ত ছিল শৈশবে, ছোটখাটো কা’টাকা’টি, চামড়া উঠে যাওয়া, পড়ে হাত ভেঙে যাওয়া কত কাণ্ডই না ঘটিয়েছে! সবসময় মা ওকে পরম যত্নে আগলে নিয়েছেন। কতটা উৎকণ্ঠায় থেকেছেন। একা হাতেই ওকে বড় করেছেন। কত রাতে ঘুম ভেঙে নীরা দেখেছে, তিনি নিঃশব্দে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছেন!
আজ ওর সঙ্গ তার প্রয়োজন নেই? আছে তো! সে মনে করিয়ে না দিলে তো মা’র ওষুধ খাবার কথাও মনে থাকে না এখন! এই একলা বাসায় কোনো এক রাতে যদি প্রেসার বেড়ে যায়!
এপর্যন্ত ভাবতেই প্রবল একটা ধাক্কা খেল! মনের উপরে শান পড়ে যেন মরিচা সরল! দরজার হাতল থেকে হাত ছিটকে সরে এলো আপনাআপনি। সুপ্ত থাকা বোধটুকু যেন জেগে উঠল!
রাতুল ফোন করছে, “আমি এভাবে বিয়ে করব না, রাতুল। তুমি ফিরে যাও।”
“এসব কী বলছ এখন? শোভনরা গাড়ি নিয়ে বড় রাস্তায় অপেক্ষা করছে। আগামীকাল বিয়ের জন্য স্বাক্ষী পর্যন্ত জোগাড় করা হয়েছে।”
“আমি ছাড়া আমার মা’য়ের আর কেউ নেই, রাতুল। আমরা চেষ্টা করব সবাইকে রাজি করানোর। আমি জানি তুমি বুঝবে। আমাদের হয়তো তাদের বোঝানোয় ঘাটতি ছিল। আমরা এবার আরও চেষ্টা করব।”
“যদি রাজি না হয়!” রাতুলের গলায় উৎকণ্ঠার ছাপ স্পষ্ট।
“তারা তো আমাদের ভালোই চান। মা নিশ্চয়ই বুঝবেন। অপেক্ষা করব আমরা, মা’র রাজি হবার, তোমার ভাইয়ের বিয়ের।”
ফোন কেটে সে দৌড়ে মায়ের ঘরে এলো, তার পাশে শুয়ে তাকে আঁকড়ে ধরে নিঃশব্দে কেঁদে ফেলল নীরা! নিজেকে কেমন স্বার্থপর মনে হলো!
***
জহুরা ঘুমের ভাণ করে নিঃসাড় পড়ে রইলেন। কেবল মেয়েকে আরেকটু কাছে টেনে নিলেন। যখন তিনি দেখলেন মেয়ে তার আলমারি থেকে গয়না সরাচ্ছে, তার পৃথিবীটা দুলে উঠেছিল! কিন্তু মেয়েকে বুঝতে দিলেন না!
মস্ত বড় একটা বাজি ধরেছিলেন যেন ভাগ্যের উপরে! নিজের দেওয়া শিক্ষার উপরে তার অগাধ বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত অটুট রইল। ঠিক করলেন কালই ছেলেটাকে আরেকবার কথা বলার জন্য ডাকবেন!
বিক্ষিপ্ত মন ছিল বলে জানালার পর্দা টেনে দেওয়া হয়নি। আধখানা চাঁদের আবছা আলো যেন ঘরে এসে লুটোপুটি খাচ্ছে! তার মনেও কি নয়!
নতুন চাঁদের মতো হাসি খেলে গেল তার ঠোঁটের কোণে, সে হাসি ছড়িয়ে পড়ল তার চোখে, মুখে, হৃদয়ে, মননে!
সৌজন্যে প্রতিলিপি