সম্বুদ্ধ মুখোপাধ্যায় :- ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার খেওড়া গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল একই জেলার বিদ্যাকুট গ্রামে। পিতা বিপিনবিহারী ভট্টাচার্য গিরি সম্প্রদায়ের অধীনে সন্ন্যাস নেন ও নাম হয় মুক্তানন্দ গিরি। হয়তো জন্মসূত্রেই আনন্দময়ী মায়ের মধ্যেও আধ্যাত্মিক চেতনা জাগ্রত হয়, কারণ ছোটবেলা থেকেই তার মধ্যে দৈবশক্তির লক্ষণ দেখা দেয়। তখন থেকেই হরিনামকীর্তন শুনে তিনি আত্মহারা হয়ে যেতেন।
আন্দময়ীর প্রকৃত নাম নির্মলা সুন্দরী; ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে বিক্রমপুরের রমণীমোহন চক্রবর্তীর সঙ্গে তার বিবাহ হয়। প্রথম দিকে তাঁকে উন্মাদ বা হিস্টিরিয়া ব্যাধিগ্রস্ত বলে সাব্যস্ত করা হয়। কিন্তু প্রাণগোপাল মুখোপাধ্যায় তাঁকে মহাভাবের সাধিকারূপে আবিষ্কার করেন, যিনি পরবর্তীকালে সন্ন্যাস নেন ও ভোলানাথ গিরি মহারাজ হিসেবে পরিচিত হোন। আনন্দময়ীর স্বামী রমণীমোহন ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকার নবাবের কর্মচারী নিযুক্ত হলে নির্মলা তার সঙ্গে শাহবাগে চলে আসেন এবং সিদ্ধেশ্বরীতে কালীমন্দির (১৯২৬) প্রতিষ্ঠা করে ধর্মকর্মে আত্মনিয়োগ শুরু করেন। এই মন্দিরেই একদিন দিব্যভাবে মাতোয়ারা নির্মলা আনন্দময়ী মূর্তিতে প্রকাশিত হন এবং তখন থেকেই তাঁর নাম হয় আনন্দময়ী মা। ঢাকার রমনায় তার আশ্রম গড়ে ওঠে। তাঁর আধ্যাত্মিক ভাবধারায় অনেক গুণিজন আকৃষ্ট হন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দুজন হলেন মহামহোপাধ্যায় গোপীনাথ কবিরাজ এবং ডাক্তার ত্রিগুণা সেন। ১৯৩৮ এ নেতাজী সুভাষ বসু কংগ্রেস সভাপতি থাকাকালীন তার সাথে দেখা করেন। সাধক বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর শিষ্য কিরণচাঁদ দরবেশের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক ছিল। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এস. চিন্তামণি, জওহরলাল নেহেরুর স্ত্রী কমলা নেহেরুর সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক ছিল ও মা কমলা নেহেরুকে একজোড়া সোনার বালা উপহার দেন। পরে ইন্দিরা গান্ধীও তাঁর অনুগামী হন। ‘৮২তে মায়ের দেহত্যাগের খবর পেয়ে ইন্দিরা স্বয়ং সেখানে হাজির হন।
শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্য, রামকৃষ্ণ মিশন এর তৃতীয় প্রেসিডেন্ট, স্বামী অখন্ডানন্দজি (শশাঙ্ক মহারাজ) তাঁর অনুগামী ছিলেন ও তাঁর কন্যাকে মা পরম স্নেহ করতেন। নৃত্যশিল্পী উদয়শঙ্করও নৃত্য সম্পর্কে আনন্দময়ীর বিশ্লেষণ শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন। আনন্দময়ীর মতে জগৎটাই নৃত্যময়; জীবের মধ্যে যে প্রাণের স্কন্দন, এমনকি বীজ থেকে যখন অঙ্কুরোদগম হয় তখন সেখানেও এক ধরনের তরঙ্গময় নৃত্যের সৃষ্টি হয়। এই তরঙ্গরূপ নৃত্য যে মূল থেকে উদ্ভূত হয়, একসময় স্তিমিত হয়ে আবার সেই মূলেই মিলিয়ে যায়। এই রূপকের মধ্য দিয়ে তিনি মূলত জীবাত্মা ও পরমাত্মার সম্পর্ককেই নির্দেশ করেছেন।
১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে আনন্দময়ী স্বামীর সঙ্গে উত্তর ভারতের দেরাদুনে চলে যান এবং সেখানে তার লীলাক্ষেত্র ক্রমশ সম্প্রসারিত হয়। তিনি মানুষকে আধ্যাত্মিক ভাবে উদ্বুদ্ধ করার জন্য উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থান পরিভ্রমণ করেন। তার একটি বিশেষ কীর্তি হলো প্রাচীন ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ তীর্থস্থান নৈমিষারণ্যের পুনর্জাগরণ ঘটানো। সেখানে গিয়ে তিনি নতুন করে মন্দির স্থাপন এবং যজ্ঞ, কীর্তন, নাচ-গান ইত্যাদির মাধ্যমে ভগবৎসাধনার ক্ষেত্র তৈরি করেন। এভাবে মানুষকে সুন্দর জীবনযাপনে অভ্যস্ত করার উদ্দেশ্যে তিনি ভারতের বিভিন্ন স্থানে পুরাতন তীর্থসমূহের সংস্কার সাধন এবং নতুন নতুন তীর্থস্থান প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশের রমনা ও খেওড়াসহ ভারতের বারাণসী, হরিদ্বারের কঙখল প্রভৃতি স্থানে তার নামে আশ্রম, বিদ্যাপীঠ, কন্যাপীঠ, হাসপাতাল ইত্যাদি গড়ে উঠেছে। তার নামে এরূপ মোট ২৫টি আশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ‘সংসারটা ভগবানের; যে যে অবস্থায় আছে, সেই অবস্থায় থেকে কর্তব্যকর্ম করে যাওয়া মানুষের কর্তব্য।’ এটাই আনন্দময়ীর মুখ্য বাণী।
১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ আগস্ট, আজকের দিনে তিনি দেহত্যাগ করেন। তাঁকে উত্তর ভারতের হরিদ্বারে কনখল আশ্রমে গঙ্গার তীরে সমাধিস্থ হয়।