Select Language

[gtranslate]
২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ শুক্রবার ১৮ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

।। পরিপূরক ।।

পরিপূরক:-শম্পা শীল (দত্ত) বাড়ীর সামনে এসে চার চাকাটা থামতেই,গাড়ির থেকে নেমেই কাকন মা মা বলে চিৎকার করতে করতে ঘরে ঢুকলো_গৌরী দেবী ও যেন অপেক্ষা করছিল মা ডাকটা শোনার জন্য।কাকন ঘরে এসেই গৌরী কে জড়িয়ে ধরে আগে দু পাক ঘুরিয়ে নিল,তারপর এক গাল হাসি হেসে বললো”মা আমি আমার প্রথম কেস টা আজ জিতেছি,তুমি যদি ওখানে থাকতে,কি যে আনন্দ হতো”।

গৌরী কথাটা শুনেই কাকনের গাল টা টিপে দিয়ে বললো “আমি জানতাম আমার মেয়ে জিতবেই”।

আজ থেকে দশ বছর আগে কাকন কে এই বাড়িতে নিয়ে এসেছিল বনি_বনির তখন কুড়ি বছর আর কাকনের ষোলো বছর,সদ্য মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ করেছে।

কোচিং যেতে গিয়ে বনি আর কাকনের আলাপ তারপর প্রেম।কিন্তু কাকনের বাড়ীর লোক এতো কড়া শাসনে কাকন কে রেখেছিল যে দুজনের দেখা করা, কথা বলা টাও ছিল সমস্যা জনক_এভাবে কোনো রকম এক বছর কাটলেও একদিন বনি জোর করে কাকন কে মন্দিরে নিয়ে বিয়ে করে নিজের বাড়িতে তুলে নিয়ে চলে আসে।

বনি তখন সবে শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র।

গৌরী আর রাজেশ দুজনই এই ঘটনায় খানিক অপ্রস্তুত হয়ে গেছিলো কিন্তু দুজনের একমাত্র চোখের মণি বনির মুখের দিকে তাকিয়ে তাদের মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে এই ঘটনা টা মেনে নিতে হয়েছিল_কিন্তু দুজনের মধ্যেই একটা চাপা ভয় হতে লাগলো কাকনের বাড়ীর লোক যদি পুলিশ নিয়ে আসে সেক্ষেত্রে ওরা সকলেই ভীষণ বিপদে পড়ে যাবে,কেনো না পুলিশ আসা মনে আসপাশের লোকের নানা কথা,তাছাড়া নিজেরা বিপদে পরে যাবে কেননা বনি আর কাকন কেউই বিয়ের বয়সের জন্য সাবালক হয়নি।


কোনো রকম ভয়ে ভয়ে সেই রাত টা কাটলে ও পরের দিন বেলা হতেই কাকনের বাড়ীর থেকে ওর বাবা, কাকারা এসে হাজির হলো।কিন্তু সেদিন ষোলো বছরের কাকণ যেভাবে ওদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সব ব্যাপারটা নিজের হাতে সামলে নিয়েছিল গৌরীর মনে সেদিনই কাকন যেনো একটু জায়গা করে নিয়েছিল।


কাকনের বাবা কাকারা সেদিন তাদের মেয়ের কথায় এবাড়ি থেকে চলে গেলেও তারা পরিষ্কার করে জানিয়ে দিয়ে যায়_ “তাদের কাছে কাকন মৃত,তারা ভুলে যাবে তাদের একটা মেয়ে আছে”।
ওই কথা শোনার পর থেকে কাকন ও আর কোনোদিন বাপের বাড়িতে যাবার কথা মুখে ও আনেনি,শুধু তাই নয় মনের থেকে ও বিশেষ ইচ্ছা জাগেনি।মাঝে মধ্যে মায়ের কথা খুব মনে পড়ত তখন গৌরীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ত।সে সময় গৌরী ও যেনো বুঝতে পারতো এই ছোটো মেয়েটার কোথায় কষ্ট হচ্ছে!!কিছু দিনের মধ্যে বনির বাড়িটা তেই সে তার নিজের বাপের বাড়ী শশুর বাড়ী দুই ই খুঁজে নিল।


এখান থেকেই কাকন শুরু করলো তার নিজের জীবন,মাধ্যমিক পাশ করে পরবর্তী পড়াশুনার জন্য আবার স্কুলে ভর্তি হলো,নিজেদের নূতন সংসারের মধ্যেই বনি আর কাকন দুজনই দুজনের পড়াশুনা চালিয়ে যেতে লাগলো।চারজনের সুখের সংসার সারাদিনের ব্যস্ততা কাটিয়ে রাতের টেবিলে চারজনের হাসি মজা তে সারাদিনের ক্লান্তি কেটে যেত,সারা বাড়িটা যেনো গমগম করতো। এ ভাবেই কেটে গেলো তিনটে বছর।গৌরী আর রাজেশ ও যেনো কাকন কে কন্যা স্নেহে ভরিয়ে দিল।


বনি ইঞ্জিনি়ায়ারিং শেষ করে ভালো কোম্পানী তে চাকরি ও পেয়ে গেলো,কাকন ও স্কুলের পড়া শেষ করে ওকালতি পড়ার জন্য কলেজে ভর্তি হলো।বনির চাকরির ট্রেনিং এর ব্যাপারে কিছুদিনের জন্য ওকে ব্যাঙ্গালোরে যেতে হলো_বনি কে নিয়ে রাজেশ গেলো ব্যাঙ্গালোরে, বাড়িতে গৌরী রইলো কাকনের সাথে।
কিন্তু ভগবান হয়তো সব সময় সব ভালো সবার জন্য লিখে রাখেনা, ট্রেনিং শেষ হয়ে বাড়ি ফেরার আগের দিন বাবা আর ছেলে দুজনে বেরোলো বাড়ীর দুই গিন্নির জন্য কিছু কেনাকাটি করতে_কেনা শেষ করে বাড়ি ফেরার পথে রাস্তায় এক বড়ো দুর্ঘটনার কবলে পড়ে চারটে মানুষের জীবন ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেলো।

কলকাতায় বসে থাকা দুটো মানুষের জীবন টা যেনো এক নিমেষে রং বিহীন হয়ে গেলো। একে অপরকে সান্ত্বনা দেবার ও ভাষা রইলো না।

এই ঘটনার খবর পেয়ে তিনবছর পর কাকনের বাড়ীর লোকেরা এলো কাকনের শশুর বাড়িতে_তারা কাকন কে নানা ভাবে সান্ত্বনা দিল।কিন্তু কাকনের দিক থেকে তারা যেনো অনেক দূরের লোক হয়ে গেছে গত তিন বছরে।

ধীরে ধীরে মনের কষ্ট কে চেপে রেখে একে অপরের শক্তি হয়ে শাশুড়ী বউ নিজেদের কাছের লোকের কাজ সম্পন্ন করল।সব কাজ মিটে যাবার বেশ কিছু দিন পর কাকনের বাড়ীর লোক এসে কাকন কে নিজেদের কাছে নিয়ে যাবার কথা বললো_কথা টা শুনে গৌরী কিছু বলার আগে কাকন নিজেই বলে উঠলো আমার বাড়ি এটাই, এখান থেকে আমি কোথাও যাবনা।গত তিন বছর ধরে আমি এই বাড়িটাকেই আমার নিজের বাড়ি বলে জেনেছি। কাকনের বাড়ীর লোক গত তিন বছর আগের মত সেদিন ও কাকনের কথা তেই এ বাড়ি থেকে আবার ফিরে চলে গেলো,অনেক চেষ্টা করে ও কাকন কে তারা নিজেদের বাড়িতে নিয়ে যেতে পারলনা।
ওরা চলে যাবার পর গৌরী কাকন কে ওর বাপের বাড়িতে যাবার ব্যাপারে বোঝাতে গেলে কাকন মুখে কোনো কথা না বলে হাত দিয়ে গৌরী কে থামিয়ে দিল।

এরপর ধীরে ধীরে নিজেদের কষ্ট গুলো একে অপরের থেকে লুকিয়ে নিজেদের কে এগিয়ে নিয়ে যেতে চেষ্টা করলো,একে অপরের জন্য বাঁচতে চেষ্টা করলো।দুজনের বিছানা হলো একটা,কাকন নিজের ঘর ছেড়ে গৌরীর ঘরে এসে শুতে লাগলো,পাশাপাশি বসে দুজনের দুঃখ দুজন ভাগ করে নিতে লাগলো।দিনের বেলা দুজনে নিজেদের কাজে ব্যাস্ত থাকলেও বেলা শেষে দুজন শুধু দুজনের কথাই ভাবত।

সব হারিয়ে কাকন যেনো গৌরী কে আঁকড়ে ধরলো,সেরকম গৌরী ও যেনো নিজের স্বামী সন্তান কে হারিয়ে কাকন এর মধ্যে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে চেষ্টা করলো। ক্রমে ক্রমে কাকন ছেলের বউ থেকে গৌরীর মেয়ে হয়ে উঠলো।

এই ঘটনার পর কেটে গেছে সাতটা বছর,কাকন ওকালতি পাস করে এখন একজন উকিল।

কাকন আর গৌরী ও যেনো হয়ে উঠেছে একে অপরের পরিপূরক।নিজেদের অতীতের কষ্ট কে দুজনেই কাটিয়ে উঠে জীবনের অনেক টা পথ এগিয়ে গেছে।গৌরী মাঝে মাঝেই কাকন কে বলে “তুই আবার নূতন করে জীবনটা শুরু কর,আমি চাইনা তুই তোর সারাটা জীবন এভাবে কাটাস,আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তোর জীবন টা গুছিয়ে দেব”।কাকন শুনে হাসে আর বলে “ঠিক আছে আর একটা বনি যোগার করি,তারপর তাকে নিয়ে পালিয়ে এ বাড়িতে চলে আসবো”।

দুজনই মনেমনে হাসে,কিন্তু দুজনই দুজনের জন্য একে অপরকে কে ভালো রাখার জন্য নিজেদের কষ্ট গুলো লুকোতে শিখে গেছে,হয়তো এই ভাবেই বাকি জীবনটা তাদের নূতন মা মেয়ের সম্পর্কে একে অপরের পরিপূরক হয়ে কাটিয়ে দেবে।

সৌজন্যে প্রতিলিপি

ekhansangbad
Author: ekhansangbad

Related News

Also Read