Select Language

[gtranslate]
৮ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ বুধবার ২২শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

।। প্রত্যাবর্তন ।।

পলাশ হালদার:-প্রায় সাত বছর পর অনির্বাণ গ্রামে ফিরছে। ছেলেকে আনার জন্য প্রদীপ বাবু দুপুর থেকেই ক্যানিং স্টেশনে অপেক্ষা করছেন। ঘড়িতে তখন তিনটে কুড়ি, ট্রেন এসে পৌছালো স্টেশনে। চাতক পাখির মতো ছেলের আগমনের দিকে তাকিয়ে আছেন প্রদীপ বাবু। দু’চোখে কত স্বপ্ন ছিল- তাঁর ছেলে একদিন বড়ো হবে, ডাক্তার হয়ে ফিরে এসে গ্রামের গরীব দুঃস্থদের সেবা করবে…। সেই স্বপ্ন আজ পূরণ হতে চলেছে। অনির্বাণ ডাক্তার হয়ে ভুবনডাঙ্গায় ফিরছে। কত মানুষ কতরকম কথা বলেছে! সেসব শুনে পিতৃহৃদয় ব্যাকুল হয়েছে। তাঁর মন ভেঙেছে, অন্তর ক্ষতবিক্ষত হয়েছে তবুও আশা ছাড়েননি। কেউ কেউ বলেছে – ও ছেলে আর গ্রামে ফিরবে না। কলকাতায় থেকে যাবে, না হলে বিদেশে চলে যাবে। পিছনের কথা নাকি সবাই মনে রাখে না। বাবা মায়ের স্বপ্নগুলো নাকি সন্তানের উচ্চাশার কাছে বিক্রি হয়ে যায়। কিন্তু প্রদীপ বাবু গভীর উৎকণ্ঠা নিয়ে শুধু প্রতীক্ষা করে গেছেন কবে তাঁর অনির্বাণ গ্রামে ফিরবে..। তিনি প্রমাণ করে দেবেন তাঁর ছেলেকে মানুষ হবার শিক্ষা দিয়েছেন, লোভের কাছে হার মানতে শেখাননি।

স্টেশন থেকে ট্যাক্সি ভাড়া ক’রে বাবাকে নিয়ে অনির্বাণ রওনা দিল ভুবনডাঙ্গার উদ্দেশ্যে। স্টেশন থেকে প্রায় এক ঘন্টার এই পথটা কত বদলে গেছে! আগে ক্যানিং স্টেশন থেকে প্রায় দশ মিনিট হেঁটে আসতে হতো মাতলা নদীর কূলে। তারপর নদীতে জোয়ার হলে কিছুটা বাঁচোয়া, নৌকা করে পার হতে হতো। কিন্তু ভাঁটা হলে দুর্ভোগের শেষ ছিল না। নদীর সেই জল কাদার চরে হেঁটে হেঁটে পার হতে হতো প্রায় এক ঘন্টা। সেই দুর্বিসহ অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়লে আজও আতঙ্ক জাগে। ছোটবেলায় এই নদী পার হতে গিয়ে অনির্বাণ কত কেঁদেছে তার কোনো হিসেব নেই। এখন সেই মাতলা নদীর উপর মাতলা সেতু নির্মিত হয়েছে। মানুষের কষ্ট লাঘব হয়েছে। সেই মাতলা সেতুর ওপর দিয়েই ছুটে চলবে অনির্বাণদের ট্যাক্সি। সেতুতে ট্যাক্সিটা ওঠার মুখেই হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন প্রদীপ বাবু- ” ও ড্রাইভার গাড়ি থামাও, থামাও..”

তাঁর চিৎকারে ঘাবড়ে গেলেন ট্যাক্সি ড্রাইভার। তাড়াতাড়ি রাস্তার একপাশে গাড়িটাকে দাঁড় করালেন। প্রদীপ বাবু অতি দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে ছুটে গেলেন রাস্তার পাশে লাঠি ধরে দাঁড়িয়ে ধুঁকতে থাকা এক বৃদ্ধের কাছে।

জিজ্ঞাসা করলেন – “আরে সামাদ ভাই! এখানে একা একা কী করতে এসেছো?”
– প্রদীপ’দা! কদ্দিন পর তোমার দেখা পেলুম গো, ভালো আছো?
– আমি তো ভালো আছি কিন্তু তুমি….
– নিকারিঘাটায় মেয়ের বাড়ি গেছিলুম, ফিরতিছি। তাতে(রৌদ্র) হাঁটতি খুব কষ্ট হচ্ছে গো। তাই ক্ষণিক দাঁড়িয়ে গেলুম।

– এতটা রাস্তা তুমি হেঁটে যাবে!
– কী আর করব? বিরিজটা হবার পর থেকে খেয়া বন্ধ হয়ে গেচে। আমাদের নৌকোর রোজগারপাতিও সব বন্ধ। কোনোরকমে সংসারটা চলতেছে গো। দু’পয়সা খরচ করার আগে কত ভাবতি হয়।
নৌকা … খেয়া… কথাগুলো শুনে অনির্বাণ ট্যাক্সি থেকে নেমে এগিয়ে গেল সেই বৃদ্ধটির কাছে। ভালোভাবে তাকালো তার মুখের দিকে। একটু অসুবিধা হলেও শেষ পর্যন্ত চিনতে পারলো মানুষটিকে। ইনি তো সেই সামাদ মাঝি। ছোটবেলায় এনার নৌকায় কতবার মাতলা নদী পার হয়েছে…অন্তত কুড়ি বছর পর মানুষটাকে দেখছে। শরীর ঝুঁকে গিয়েছে, চামড়া ঝুলে পড়েছে। বার্ধক্য, শরীর ও মন সর্বত্র থাবা বসিয়েছে। অনির্বাণ এক লহমায় ফিরে গেল অতীতে। তার মনে পড়ছে কত কথা….। স্মৃতির ঝাঁপি বন্ধ করে সে সামাদ মিঞার হাত দুটো ধরে বললো -“সামাদ চাচা, গাড়িতে উঠুন, আপনার বাড়ির কাছে নামিয়ে দেবো।”

প্রদীপবাবু যেন এই কথাটাই বলতে চাইছিলেন। তাঁর ছেলে কীভাবে যে তাঁর মনের কথাটা বুঝে নিল সেটা ভেবে বেশ বিস্মিত হলেন। কিন্তু সামাদ মিঞা তো অনির্বাণকে দেখে অবাক! জিজ্ঞাসা করলেন- “তুমি কে বাবা? চিনতি পারলুমনি তো…”

প্রদীপবাবু হাসতে হাসতে বেশ গর্বের সঙ্গে বললেন-“সামাদ ভাই চিনতে পারলে না তো? আমার অনির্বাণ, ও ডাক্তারি পাশ করে আজ ফিরছে। এখন থেকে ভুবনডাঙ্গায় থাকবে। এখানকার মানুষদের দেখার জন্য ভালো ডাক্তারের বড়ো অভাব গো…”

প্রদীপ বাবুর কথা শুনে ছল ছল করে উঠলো সামাদ মিঞার চোখ দুটো। আবেগতাড়িত কণ্ঠে বললেন -“তুমি এত বড় হয়ে গেছো বাবা, কী ক’রে চিনি বলো? কিন্তু আমার কি গাড়িতে ওঠা ঠিক হবে?”

– কী বলছেন চাচা! আমার গাড়িতে যদি একটু বসার সুযোগ না দিতে পারি, তাহলে আমার চেম্বারে তোমাদেরকে ঢুকতে দেবো কীভাবে?

ছেলের কথায় প্রদীপ বাবুর বুকের ছাতিটা একটু চওড়া হয়ে গেল। চিকচিক করে উঠলো চোখের কোণ। সামাদ মিঞার চোখের জল আর বাঁধ মানলো না। বললেন -“তুমি প্রদীপ’দার যোগ্য ব্যাটা বটে। তোমার বাপ ওইভাবে সারা জেবন মানষির উপকার করে গেছেন। তাই উপরওয়ালা মনে হয় মুখ তুইলে তাইকেছেন। তাঁর শেষ বয়সে তোমাকে আবার তাঁর কাছে তাঁর মতন ক’রে গড়ে পাইঠেছেন।

প্রদীপবাবু ও অনির্বাণ বৃদ্ধ সমাদ মিঞাকে ধরে ট্যাক্সিতে তুললেন। ড্রাইভার ট্যাক্সি ছেড়ে দিল। মাতলা সেতুর উপর দিয়ে ছুটে চলেছে তাদের গাড়িটা। যে নদীর বুকে এক সময় সামাদ মিঞা অসংখ্য যাত্রীকে নৌকো করে পারাপার করে দিতেন, সেই তিনি আজ নৌকা ছাড়া যেন অচিনপুরের এক অসহায় যাত্রী। জীবনে এই প্রথম ট্যাক্সিতে উঠেছেন।

মাতলা সেতুর ডান দিক থেকে বয়ে আসা দখিনা হাওয়া ট্যাক্সির জানালা দিয়ে ঢুকে তার এলোমেলো সাদা চুলগুলোকে আরও অবিন্যস্ত করে তুলছে। হাত দিয়ে বারবার সেগুলোকে ঠিক করে নিলেও তার এলোমেলো জীবনটাকে আর কিছুতেই সাজিয়ে তুলতে পারবেন না। মাঝি ছাড়া নৌকা যেমন অসহায়, তেমনই নৌকা ছাড়া মাঝির জীবনেরও কোনো মূল্য নেই।
ডকঘাট পার হয়ে রশিদের মোড় আসতে প্রদীপবাবু বললেন -“ড্রাইভার, এখানে ওনাকে নামিয়ে দিন।”

গাড়ি থেকে নেমে সামাদ মিঞা কৃতজ্ঞ চিত্তে নমস্কার করলেন প্রদীপ বাবুকে। তারপর অনির্বাণের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন -“ভালো থেকো বাবা। তোমাকে দেখে নতুন করে বাঁচতি ইচ্ছে করতেছে। তোমার জন্যি গ্রামের গরীব মানষিরা এবার একটু বাঁচতি পারবে।

– কী যে বলেন চাচা! জীবনে যতটুকু শিখতে পেরেছি তা সবই আপনাদের আশীর্বাদে। আপনাদের প্রয়োজনে লাগতে পারলে ধন্য হবো। আপনার হয়তো মনে নেই চাচা কিন্তু আমি ভুলিনি‌ ছোটবেলায় একবার ডকঘাটে এসে দেখলাম ভাঁটা নেমে গেছে। সেবার বাবা একটু অসুস্থ ছিলেন। হেঁটে নিজে নদী পার হতে পারলেও আমাকে নিয়ে পার করার ক্ষমতা ছিল না। আপনি আমাকে কাঁধে করে শুধু এই নদী পার ক’রে দেননি, স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলেন।

– সেকি বাবা! সেদিনের কথা তুমি আজও মনে রেখেছো! আমি তো কবেই ভুলে গিছি। আসলে কী জানো, তোমার বাবা এমন একজন মানুষ যার জন্য কিছু করতি পারলি আমরা ধন্য হয়ে যেতুম। কিন্তু ভাবিনি সেদিনের সেই ছোট্ট ঘটনাটা তুমি আজও ভুলতি পারোনি!

– কী ক’রে ভুলবো চাচা? শিকড়ের টান কি এত সহজে ভোলা যায়? ভুলতে পারিনি বলেই তো আবার ভুবনডাঙ্গায় তোমাদের কাছে ফিরে এলাম।
একরাশ তৃপ্তি নিয়ে সামাদ মিঞা লাঠি ঠুকতে ঠকতে এগিয়ে গেলেন তার ভাঙ্গা ঘরের দিকে। তীব্র রোদ আর প্রচণ্ড গরমের হাত থেকে বেশ কিছুটা সময় বড় শান্তিতে পেরিয়ে এলেন।

অনির্বাণদের ট্যাক্সি ততক্ষণে প্রবেশ করেছে বাসন্তী হাইওয়েতে। প্রদীপ বাবু নিশ্চিন্ত হলেন যে তাঁর শিক্ষা ব্যর্থ হয়নি। তাঁর অনির্বাণ শুধু ডাক্তার হয়ে ফিরে আসেনি, যথার্থ মানুষ হয়ে ফিরে এসেছে। মানুষ না হ’লে কি মানুষের পাশে দাঁড়ানো যায়, মানুষের সেবা করা যায়? এটাই তো তাঁর একমাত্র স্বপ্ন ছিল। স্বপ্ন পূরণের তৃপ্তি ‌ ঝিলিক দিচ্ছে তাঁর চোখে মুখে।

সৌজন্যে প্রতিলিপি

ekhansangbad
Author: ekhansangbad

Related News

Also Read