শুভজিৎ চট্টোপাধ্যায়
– আমার লাল ব্রা টা দেখেছিস?
– না তো। সবসময় সব হারিয়ে ফেলিস কোথায়?
– আরে মনেই থাকে না।
– নেশাটা একটু কম করলে তো পারিস।
– তুই আর জ্ঞান মাড়াস না প্লিজ। এই একটা কারণে ছেড়ে এসেছিলাম অনিমেষকে।
– ও এটাই শুধু কারণ ছিল?
– না রে। আহ হা। তুই বড্ড সেনসিটিভ। আয় আদর করি।
– ছাড় তো।
– আরে কি হলো?
– তুই আমায় কি ভাবিস?
– কি আবার ভাববো?
– তুই কেন এসেছিস আমার সাথে থাকতে?
– আমরা ভালবাসি তাই।
– না । আর কেউ তোর এত মেজাজ নেবে না তাই
– ফালতু বকিস না তো। এমনি মেজাজ গরম হয়ে আছে।
– সে আর নতুন কি?
– চুপ করে তো। বড্ড বকছিস। সারাদিন করিস টা কী? থাকিস তো সারাদিন ঘরে। ফেসবুকে ছেনালি না মাড়িয়ে জিনিসগুলো গুছিয়ে রাখতে পারিস তো।
– মানে? তুই জানিস আমি কন্টেন্ট রাইটিং করি
– রাখ তোর ওই কনটেন্ট রাইটিং। তাও যদি বুঝতাম নিজের খরচটুকু চালাতে পারতি। আমার পয়সায় খাবি আবার বড়ো বড়ো বাতেলা। এই কাজে বেরোনোর সময় মেজাজটা খিঁচড়ে দিস কেন কে জানে!
স্বর্ণালী বেরিয়ে যাওয়ার পর হু হু করে কেঁদে ওঠে সমর। সমর ছোটবেলা থেকে নরম মনের। ও ঝগড়া করতে পারেনা। বাজে কথা বলতে পারেনা। ও পারে কবিতা লিখতে, গান গাইতে, টেবিল ক্লথে সুন্দর নক্সা করতে, ঘর গুছিয়ে রাখতে, রান্না করতে। আদতে পাঞ্জাবী হলেও সমররা তিন পুরুষের বাঙালি। ওর কথা,লেখা দেখে কেউ বলবেই না যে ও বাঙালি নয়। ও রবি ঠাকুরকে হৃদয়ে ধারণ করেছে।
ছোটবেলা থেকে তথাকথিত হুল্লোড়বাজ পাঞ্জাবী পরিবারের সন্তানদের মত ও নয়। যত বড়ো হয়েছে ও এবং ওর বাড়ির লোকেরা বুঝেছে ও সমাজের নিয়মেরও কিছুটা বিরুদ্ধে। লোকের খোঁটা শুনে ,হাসির পাত্র হয়ে কাটিয়ে দিয়েছে জীবনের পঁচিশটা বসন্ত।
তারপর হঠাৎ ওর জীবনে আসে স্বর্ণালী। একটা তাজা হাওয়ার মত ওর সব খারাপ লাগা, কষ্ট, দুঃখ সব যেন উড়িয়ে নিয়ে গেলো। সমর প্রথমবার বুঝলো ভালবাসা কী? প্রথমবার কেউ ওকে বুঝলো,ভালবাসলো, আদর করলো।
সেই দিনগুলো যেন প্রচন্ড গরমে এলঝলক কালবৈশাখী,শীতের মিঠে রোদের কমলালেবু বা শরতের কাশফুল।
ভালোবাসায়,আদরে,সোহাগে দুটো উপোসি মন একে অপরের উপর ভরসা রাখা শুরু করলো। মনের সাথে সাথে শরীর এলো কাছে। স্বর্ণালীর সংসার আছে। স্বামী আছে। যতই লুকিয়ে রাখুক একদিন লোক জানলোই।
সেদিন এলো অকাল শ্রাবণ। অপমান আর লোকনিন্দার পরতে পরতে হারিয়ে যেতে লাগলো সমর। ঘরের দরজা হলো বন্ধ। একলা ঘরে ওর নিজের বোনা টেবিল ক্লথে আর সাদা রঙের ছাদে স্বর্ণালীর সাথে দেখা স্বপ্নগুলো জড়িয়ে জাপটিয়ে একাকার হয়ে গেল। শুধু শুক্লপক্ষের জ্যোৎস্না ঘুলঘুলি থেকে এসে ওকে আশা দেয় যে পূর্ণিমা আসবে, অন্ধকার কেটে যাবে। ফুলদানির ফুলগুলো বাসী হতে হতে শুকিয়ে কঙ্কালসার। ঠিক যেন সমরের মন।
সেদিন পূর্ণিমা রাত। পুরো বাড়ি ঘুমে। হঠাৎ দরজাটা খুলে গেলো। ঠাম্মির প্রশ্রয় সেদিন বের করে এনেছিল সমরকে।
কিন্তু কোথায় যাবে অত রাতে?
– হ্যালো
– স্বর্ণালী , আমি সমর, আমি বেরোতে পেরেছি।
– সমর কোথায় ,কোথায় তুই?
– আমি কোথায় যাবো,কি করবো জানিনা স্বর্ণালী। বাঁচা তুই আমায়।
সেই রাতেই স্বর্ণালীও ঘর ছেড়েছিল। ওরা দুজন ঘর বাঁধে। অনিমেষের সাথে স্বর্ণালীর ডিভোর্সটা তারপর শুধু নিয়মপালন ছিল।
সেই থেকে ওরা একসাথে। দুটো বছর কেটে গেলো। স্বর্ণালী ওর কেরিয়ারে আজ প্রতিষ্ঠিত। সমর চাকরি করে না। ও পারে না। ও লেখে। ওর লেখার বেশ কিছু গুণমুগধ ভক্ত আছে। হালে কন্টেন্ট রাইটিং শুরু করেছে। সামান্য কিছু পয়সাও এসেছে।
ওদের সংসারের প্রথম তিনমাস সমাজের প্রচন্ড চাপ যেমন ছিল তেমন ছিল ওদের ভালবাসা। আদরে আদরে ভরিয়ে দিত দুজন দুজনকে প্রতিটা রাত। প্রতিটা পূর্ণিমা রাতে জানালা খুলে চাঁদের আলোয় সঙ্গমে লিপ্ত হতো দুজনে। জীবন জুড়ে শুধুই ভালবাসা আর শিহরণ।
তারপর আস্তে আস্তে শিহরণের জায়গা নিল অভ্যাস আর তারপর একঘেয়েমি। আজ আর সবসময় স্বর্ণালীর ছোঁয়া ভাল লাগে না। ওর গায়ে মাঝে মধ্যে পুরুষালি গন্ধ ও পায় সমর। স্বর্ণালীও যে খুব উৎসাহী আজকাল তা নয়। শরীরের দূরত্বের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মনের দূরত্ব। আর আজ তো স্বর্ণালী এতবড় কথাটাও শুনিয়ে দিল।
এই ভালবাসার জন্য কি সব ছেড়েছিল দুজনে? সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে , পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে দুটো মেয়ে স্বর্ণালী ঘোষ আর সমরজিৎ কৌর ঘর বেঁধেছিল এই দিন দেখার জন্য?
স্বর্ণালী বলেছিল অনিমেষ নাকি এরকমই করতো। এটা নাকি পুরুষের স্বভাব।
ফ্যান থেকে সমরের দেহ ঝুলছে। সুইসাইড নোটে লেখা,
স্বর্ণালী ,
তুইও পুরুষ হলি?
সৌজন্যে প্রতিলিপি