Select Language

[gtranslate]
২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ শুক্রবার ১৮ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

।। শ্রাদ্ধ আসলে কি বস্তু ? ।।

দিলীপ ঘোষ

ছোট থেকে অনেকেকেই বলতে শুনেছি , “ আমি শ্রাদ্ধ মানি না । আমি তর্পণ করি না । ওগুলো সব রেগ্রেসিভ কুসংস্কার । আমি মরার পরে দেহ দান করব “ ইত্যাদি । শহুরে হিন্দু বাঙ্গালির কাছে এটা প্রায় একটা অত্যাবশ্যক কহতব্য হয়ে উঠেছে ! কিন্তু কোনোদিন কি আমরা খোঁজ নিয়ে দেখেছি যে শ্রাদ্ধ আসলে কি বস্তু ? মনে তো হয় না !

আসলে আমাদের ভালোবাসাটাও যেমন অন্যের মুখে ঘি খেয়ে উদ্ভূত , ঘৃণা টাও ঠিক তেমনি ! সেই কবে ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গ কর্তা আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছিলেন – “ তোমরা অনুন্নত , তোমরা বর্বর , তোমরা কুসংস্কারাছন্ন “ … …… আমরা নিজেদের এখনও সেইরকমই ভাবি ! আজও আমরা “সু”সংস্কার আর “কু”সংস্কারের মধ্যে তফাৎ করতে চাইলাম না ! যে সংস্কার দেশ ও দশের ক্ষতি করে তাই “কু” । যে সংস্কার তা করে না সেটা ”কু” হতে পারে না !

শ্রাদ্ধকাণ্ডে চেয়ে দেখুন , কি অপূর্ব ভাব ব্যাঞ্জনা ! শ্রদ্ধা জানানোর ক্রিয়াই শ্রাদ্ধ । মৃত ব্যাক্তি অর্থাৎ যার নামে শ্রাদ্ধ তার উদ্দেশ্যে ক্রিয়া তো আছেই , তা ছাড়াও আছে সমস্ত মৃত জীবের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন । শ্রাদ্ধের তিনটি পিণ্ডের একটি দেওয়া হচ্ছে এক অপূর্ব কবিতা পাঠ করে – “ যারা যারা আমার কুলে জন্মে মৃত্যুবরণ করে অগ্নিতে দাহ হয়েছেন , যে যে ব্যাক্তি অগ্নি লাভ করেন নি অর্থাৎ দাহ হন নি , তাদের সবাই তৃপ্তি লাভ করুক । যার মাতা নাই , যার পিতা নাই , যার বন্ধুও নাই সেই নির্বান্ধব ব্যাক্তিও আমার এই পিণ্ডে তৃপ্তি লাভ করুন । “

তর্পণ কালে কি অপূর্ব ভাব দেখুন । তর্পণকারী জলে দাঁড়িয়ে সমস্ত বিশ্বচরাচর অখিল ব্রহ্মাণ্ডের প্রতি তার নিদেবন জানাচ্ছেন –

“ ব্রহ্মা যেন তৃপ্ত হন , বিষ্ণু যেন তৃপ্ত হন , রুদ্র যেন তৃপ্ত হন । প্রজাপতি , দেবতাগন , যক্ষ , নাগ , গন্ধর্ব , অপ্সরা , সুর এবং অসুর , যারা নিষ্ঠুর অত্যাচারী ব্যাক্তি , যারা পাপিষ্ঠ এবং যারা পুণ্যবান ধার্মিক , আকাশের জীব কুল , পক্ষীকুল , সর্প সমূহ , সমস্ত উদ্ভিদ তরু লতা , যারা খেতে পায় নি এবং যে সমস্ত জীব জলের অভ্যন্তরে থাকে , তাঁরা সবাই যেন আমার এই নিবেদনে তৃপ্তি লাভ করেন ! “
সনক সনাতান আদি চার কুমার , কপিল মুনি , মরীচি , অত্রি , অঙ্গীরা , ক্রতু , পুলস্ত্য পুলহ , প্রচেতা , বশিষ্ঠ , ভৃগু , নারদ ইত্যাদি ঋষিকুল যেন আমার এই নিবেদনে তৃপ্ত হয়েন ।
যে সমস্ত পূর্বপুরুষগন রাগী প্রকৃতির তাঁরা যেন তৃপ্তি লাভ করেন । যে সমস্ত পূর্বপুরুষগন শান্ত সৌম্য প্রকৃতির তাঁরাও যেন তৃপ্তি লাভ করেন । যম , ধর্মরাজ , চিত্রগুপ্ত এবং অন্তত প্রবাহমান সময়ের প্রতীক এই কাল যেন তৃপ্ত হন ।
শান্তনু পুত্র পিতামহ ভীষ্ম অপুত্রক ছিলেন বলে তাঁর জন্য আমি এই নিবেদন করছি , তিনি যেন তৃপ্তি লাভ করেন ।
আমার পিতামহ , প্রপিতামহ , মাতামহ , প্রমাতামহ , বৃদ্ধপ্রমাতামহ ইত্যাদি ছয় পুরুষ অবধি যেন তৃপ্তি লাভ করেন । যারা আমার জীবনে আমার পিতার ন্যায় তাঁরা যেন তৃপ্ত হন । আমার মামা , পিসি , মাসি , ভাই , বোন , শ্বশুর শাশুড়ি যে যেখানে অতৃপ্ত রয়েছেন তাঁরা সবাই যেন তৃপ্ত হন !

ব্রহ্মলোক থেকে শুরু করে সাত লোকে যেখানে যে জীব অতৃপ্ত অবস্থায় আছেন সবাই যেন তৃপ্ত হন । সমস্ত দেবর্ষি , মানব এবং সপ্ত দ্বীপের অধিবাসি বৃন্দ যেন তৃপ্ত হন । এই তিন ভুবনের তৃণ থেকে কীটানুকীট অবধি প্রতিটি প্রাণী যেন তৃপ্তি লাভ করে ।
যে সমস্ত ব্যাক্তির সন্তানসন্ততি নেই বলে ক্রিয়া করার লোক নেই , তাঁরাও যেন আমার এই নিবেদনে তৃপ্ত হয়ে পরম গতি অর্থাৎ পরম জ্ঞান লাভ করেন । যে সমস্ত ব্যাক্তির গোত্র পরিচয় হারিয়ে গেছে তাঁরাও যেন আমার দ্বারা তৃপ্ত হয়ে পরম গতি লাভ করে । “

পাবেন এইরকম অপূর্ব ভাব পৃথিবীর আর কোথাও ? যেখানে শুধু মৃত ব্যাক্তি নন , মৃতকে উপলক্ষ করে সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডের হয়ে প্রার্থনা জানানো হচ্ছে ? শুধু নিজ ধর্ম , নিজ দেশ , নিজ কাল , নিজ প্রজাতির উদ্দেশে নয় ……… সমস্ত জীবের তৃপ্তি কামনা করা হচ্ছে ! শুধু ধার্মিক পুণ্যবান নয় , অধার্মিক পাপিষ্ঠ দের উদ্দেশ্যেও প্রার্থনা জানানো হচ্ছে ! ভাবা যায় ?! ধর্ষণের নায়ক ধনঞ্জয় কিংবা আজমল কাসব মানবতার শত্রু হয়েও , হিন্দুর প্রতি-মানবতার তালিকা থেকে বাদ যাচ্ছে না ! কারন হিন্দু জানে যে পাপিষ্ঠও একটি জীব ! সে বুঝুক কিংবা সে নাই বুঝুক , সেও “অমৃতস্য পুত্রা” ! রাজা তাকে মৃত্যুদণ্ড দেবে রাজ শাসনের ধর্ম পালন করতে । আমরা তাদের শুভ কামনা করব আমাদের স্বধর্ম পালন করতে ! এইভাবেই ধর্মের চাকা চলবে ।
এই ভাব ভারতীয় সভ্যতার নিজেস্ব সম্পদ ! অপর কোনও দেশে কোনও কালে humanism আর universalism এমন উচ্চ পরাকাষ্ঠা স্পর্শ করতে পারে নি !

আর আমরা সেই সুবর্ণ ভাণ্ডারকে কুসংস্কার বলে পায়ে ঠেলে দিচ্ছি ! বাপ ঠাকুরদার উত্তরাধিকার সুত্রে পাওয়া মানবতাকে হারিয়ে আবার নতুন করে নব্য পাশ্চাত্য শিক্ষার মানবতার পাঠ নিতে যাচ্ছি উচ্ছিষ্টসন্ধানি কুকুরের মতন ! এইভাবে আধুনিক সাজবো আমরা ? এটা আধুনিকীকরণ নাকি পাশ্চাত্যপদলেহন ?! লজ্জা হয় না আমাদের ?!

ekhansangbad
Author: ekhansangbad

Related News

Also Read