Select Language

[gtranslate]
২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ শুক্রবার ১৮ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

।। মা এলো রে ।।

স্নিগ্ধা পারিয়াল :-প্রসব যন্ত্রণায় ছটফট করছে পাপাই , এখনো একমাস বাকি ছিল সন্তানের জন্মের, কিন্তু কিছুদিন ধরে পাপাইয়ের প্রেগনেন্সিতে সমস্যা হওয়ায় ডাক্তার জানিয়ে দিয়েছেন সময়ের আগেই ডেলিভারি করাতে হবে; এমনিতেই পাপাইয়ের কনসিভ করতে সমস্যা হচ্ছিল। কিন্তু পার্থর মনের ইচ্ছাকে পূরণ করার জন্য পাপাই সবার বিরুদ্ধে গিয়ে বাচ্চা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ।

অমিয় বাবুর পরিবার এই শহরের বনেদি পরিবারের মধ্যে অন্যতম , উনার তিন ভাই তাদের স্ত্রী সন্তান এবং নিজের স্ত্রী বীনা দেবী এবং একমাত্র পুত্র পার্থ ও নাতিদের নিয়ে অমিয় বাবুর সুখের সাম্রাজ্য বলতে গেলে , সবাই একসাথে এক বাড়িতেই থাকে । এই যৌথ পরিবারে প্রতিবছর ঘটা করে দুর্গা পুজো হয় , শহর জুড়ে সবার নিমন্ত্রণ থাকে এ বাড়িতে ।

অমিয় বাবু থেকে শুরু করে সবার একটাই আক্ষেপ , তাদের পরিবারে কোন কন্যা সন্তান নেই! অমিয় বাবুর যেমন একমাত্র সন্তান পার্থ তেমনি উনার দুই ভাইয়েরও পুত্র সন্তান: এমনকি তাদের পরবর্তী প্রজন্মে পুত্র সন্তান জন্ম গ্রহণ করেছে । সারা বাড়ি জুড়ে কোন মেয়ে নেই , প্রতি বছর ভাইফোঁটা ও রাখী-তে অমিয় বাবুর যেমন মন খারাপ থাকে তেমনি উনার ছেলে পার্থ এবং ভাইদের ছেলেরাও দুঃখ পায় ; তাদেরকেও রাখী ভাই ফোঁটা দেবার কেউ নেই । দূর সম্পর্কে যারা আছেন সেখানে গিয়ে সবসময় ফোঁটা নেওয়া সম্ভব হয় না । প্রতি বছর মা দুর্গার কাছে শুধু একটাই প্রার্থনা করে নতুন প্রজন্ম যেন কোন কন্যা সন্তান হয় !

বাবার মতো পার্থর খুব ইচ্ছে তার এক মেয়ে হোক কিন্তু নিজের স্ত্রীকে অত্যাধিক ভালোবাসে বলে সে কখনোই তার এই মনের ইচ্ছা প্রকাশ করেনি । কিন্তু পাপাই বোঝে পার্থ মেয়ে দেখলে কিভাবে আবেশে জড়িয়ে পড়ে , পাপাই পার্থর ছেলে ঋষির এখন পাঁচ বছর , তার জন্মের সময় পাপাইয়ের অনেক সমস্যা হয়েছিল যার জন্য ডাক্তার জানিয়েছিলেন সে যেন আর দ্বিতীয় সন্তান না নেয় ।

পাপাই নিজের স্বামীকে একটা কন্যা সন্তান দেওয়ার বাসনা মনে পুষিয়ে রাখে , ঋষির যখন চার বছর তখন সে পার্থকে না জানিয়ে ডাক্তারের সাথে কথা বলে এখন যেহেতু ঋষি একটু বড় তাই সে দ্বিতীয়বার কনসিভ করতে চায়। ডাক্তার বুঝিয়েছিল এতে অনেকটা রিক্স হয়ে যাবে, কিন্তু পাপাই মা দুর্গার উপর আস্থা রেখে এগিয়ে গেল। পার্থ খুব রেগে গেলেও পাপাই নিজেই বুঝিয়ে দেয় সে দ্বিতীয়বার মা হতে চায় । এবার কন্যা সন্তান হবে এমন কোন স্পষ্টতা পাপাই জানতে চায়নি , তবু তার দৃঢ় বিশ্বাস এই বাড়ির প্রতিটি মানুষের মনের বাসনা মা দুর্গা অবশ্যই পূরণ করবে ।

দেখতে দেখতে দিন ঘনিয়ে এলো, পাপাইয়ের ডেলিভারির সময় অক্টোবর মাসের শেষের দিকে অথবা নভেম্বরের প্রথম দিকে ছিল , তাই এ বছরও দুর্গা পূজার রমরমা ভাব আগস্ট মাস থেকে শুরু করে দেয় অমিয় বাবুর পরিবার , এতদিন পাপাই সুস্থ থাকলেও নিজের সাত মাস থেকেই যেন নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে যায়। কখন কি হয় তাই আপাতত সেপ্টেম্বর মাসেই অমিয় বাবুর পরিবার সিদ্ধান্ত নেয় এ বছর মা দুর্গার পুজো তারা করবেন না , সবদিক ঠিক থাকলে বসন্তকালে বাসন্তী পূজা করে নেবেন।
আজ তিন চারদিন ধরেই পাপাইয়ের অবস্থা খারাপ হতে থাকে, গতকাল ডাক্তার জানিয়ে দিয়েছেন হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই তারা ডেলিভারি করে নেবেন, তবে ব্যাপারটা এত তাড়াতাড়ি হবে সেটা পার্থ ভাবতে পারেনি । গতকাল রাতেই পাপাই বেশি অসুস্থ হয়ে যায় , পার্থ দিশেহারা হয়ে তাকে নার্সিংহোমে নিয়ে আসে; পুরো পরিবার রাত থেকেই পড়ে আছে নার্সিংহোমে! একটা সময় ডাক্তার জানিয়ে দেয় বাচ্চা এবং মায়ের মধ্যে যে কোন একজনকে তারা বাঁচাতে পারবেন, পার্থ ও পুরো পরিবার সরাসরি জানিয়ে দেয় পাপাই কে যেন সুস্থ করে দেয় ।

বীনা দেবী দুপুরে বাড়ি ফিরে গেলেন , নিজস্ব বাড়ির দুর্গার মন্দিরে বসে পাপাইয়ের জন্য প্রার্থনা করতে লাগলেন। আজ মহা অষ্টমী , তবে এই প্রথম এই বাড়িতে পুজো হচ্ছে না। বীনা দেবীর মনটাও ভারাক্রান্ত, এর মধ্যে একমাত্র আদরের ছেলের বউ নার্সিংহোমে কষ্ট পাচ্ছে: বিষয়টা বিনা দেবীকে আরও চিন্তায় ফেলে দিল। উনার সাথে পাপাইয়ের মা গীতা দেবী ও ছিলেন । পাপাই ওনার খুব আদরের মেয়ে, মেয়ের দ্বিতীয়বার মা হবার সিদ্ধান্তকে তিনি প্রথম থেকেই অসন্মতি জানিয়েছিলেন, তিনি জানেন মেয়ে তার স্বামীর কে খুব ভালোবাসে। তবে স্বামীর মনের ইচ্ছা পূরণ করার জন্য পাপাই যে এধরনের সিদ্ধান্ত নেবে সেটা তিনি বুঝতে পারেননি ।

সন্ধ্যার পর পার্থ তার মাকে ফোন করে জানিয়ে দেয় পাপাইয়ের ডেলিভারি এখন করাবে, তাই তিনি এবং গীতা দেবী পড়িমড়ি ছুটে এলেন নার্সিংহোমে। রাত আটটার সময় পাপাইকে অপারেশন টেবিলে নিয়ে যাওয়া হয় , পার্থ বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনবরত পায়চারি করতে থাকে। নিজের স্ত্রীকে সে চোখে হারায় ,পাপাই দ্বিতীয়বার বাচ্চা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় পার্থর একেবারেই সায় ছিল না তাতে ; এমনকি পাপাইয়ের সাথে বেশ মনোমালিন্য চলে কয়েক মাস। কিন্তু ডাক্তার যখন জানিয়ে দেয় এই সময় পাপাই কে হাসিখুশি থাকতে হবে তখন পার্থ সব অভিমান ভুলে স্ত্রীর পাশে ছায়ার মত রইল ।

দীর্ঘ তিন ঘন্টা পর ভেতর থেকে কান্নার আওয়াজ আসতেই সবাই স্থির হয়ে গেল, বাচ্চার কন্ঠ শুনেই পার্থ যেন অবশ হয়ে গেল ;

‘ আমার পাপু সুস্থ তো ?’ মনে মনে বিড়বিড় করে সে অপারেশনের রুমের দিকে উঁকি দিতে লাগলো , বাকিরা অধীর আগ্রহে তাকিয়ে রইল সেদিকে । একটু পর ডাক্তার বেরিয়ে আসতেই পার্থ আতঙ্কিত হয়ে উনার দিকে তাকালো, উনি হাসিমুখে জানিয়ে দিলেন সন্তান এবং মা দুজনই সুস্থ : সবাই যেন স্বস্থির নিশ্বাস ফেললো কথাটা শুনে ।

একটু পর নার্স এসে সদ্যজাত সন্তানের ঠাকুমা এবং দিদনকে ডেকে নিয়ে গেল , ভিতর থেকে বীনা দেবী হাতে করে ছোট্ট শিশুটিকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন , সবাই হাসিমুখে তাকিয়ে রইল সেদিকে। কিন্তু উনি যখন ছেলের উদ্দেশ্যে জোরে বলে উঠলেন,

” পার্থ আমাদের ঘরে মা এলো রে !”

সবাই যেন স্তব্ধ হয়ে গেল, সবাই কৌতুহলী হয়ে বীনা দেবীর দিকে তাকিয়ে আছে বুঝতে পেরেই গীতা দেবী জানিয়ে দিলেন পাপাইয়ের মেয়ে হয়েছে।



পার্থ ছল ছল চোখে এগিয়ে এলো ছোট্ট পরীর দিকে, ফুটফুটে মেয়েটিকে দেখেই পার্থর মন জুড়ে শান্তি বয়ে গেল । অমিয়বাবু এবং দেবাশীষ বাবু সহ পরিবারের সবাই এগিয়ে এলো , প্রাণভরে দেখে নিচ্ছে তাদের বাড়ির সদ্য অতিথি পরী’কে । ঋষিও হাত বাড়িয়ে আদর করতে চাইলো তার ছোট্ট বোনকে, অমীয়বাবু মা দুর্গার উদ্দেশ্যে হাত দুটো করজোরে প্রণাম জানিয়ে বললেন,

” মাগো তুমি যে এভাবে আমাদের ঘরে আসবে আমরা ভাবতে পারিনি!”

উনার চোখে ভেসে উঠলো মা দুর্গার ছোট্ট রূপ।

পুরো নার্সিংহোমে মিষ্টি বিতরণ হয়ে গেল , আজ মহা ষষ্ঠী , মায়ের অকালবোধনে অমিয় বাবুর পরিবারে সাক্ষাৎ মা চলে এলো , এবার পুজো হয়নি বলে মা স্বয়ং বাড়িতে সদস্য হয়ে চলে এসেছে এমনটাই ধারণা করে নিল বাড়ির প্রবীণগণ। আত্মীয়-স্বজন সবাইকে ফোনে জানিয়ে দিলেন এই সুখবর , দুর্গাপূজা না হলেও মা দুর্গাকে সাক্ষাৎ পেয়ে সবাই আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল।

পার্থ ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো পাপাইয়ের কাছে, সে এখনো শুয়ে আছে; কয়েকটা দিন বিশ্রামে থাকতেই হবে ! পাপাই নিজের ললাটে পার্থর ঠোঁটের স্পর্শ বুঝতে পেরে চোখ মেলে তাকালো , মুচকি হেসে অস্ফুটে বলল,

“তুমি তোমার রাজকুমারী পেয়েছো?”

” আমি আমার রানী এবং রাজকন্যা দুজনকেই পেয়েছি!” – পার্থ কথাটি বলেই আলতো করে পাপাই কে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরলো!

মা দুর্গার বোধন হয়ে গেছে , এমন শুভদিনে এত বছর পর তাদের পরিবারে কোন মেয়ে এসেছে ব্যাপারটা সত্যি পরম সুখকর। মায়ের কথা পার্থর মনে পড়ে গেল , তিনি কতটুকু উল্লাসে বলেছিলেন , মা এলো রে

সৌজন্যে – প্রতিলিপি

ekhansangbad
Author: ekhansangbad

Related News

Also Read