Select Language

[gtranslate]
৮ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ বুধবার ২২শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

।। ভালবাসার গভীরে ।।

সায়ন্তনী দাস ধর :-রাত বারোটা। একটা লেখা নিয়ে বড্ড ব্যস্ত রোহিনী। রোহিনীর গল্পের নায়িকা ধর্ম সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে। একদিকে তার স্বামী, অন্যদিকে প্রেমিক। কার হাত সে ধরবে? রোহিনীর মন যা চায়, সেটা কি পাঠকবর্গের পছন্দ হবে? নাকি পাঠকবর্গের কথা বিন্দুমাত্র না ভেবে তার মনের মত সিদ্ধান্ত নায়িকা নেবে?

রোহিনী নিজেও অনিশ্চয়তার দোলাচলে! সাহিত্যিকদের বড় জ্বালা! কেবল মনের আনন্দে লিখে গেলেই তো হল না, বই বিক্রির কথাটাও তো ভাবতে হবে! এমন কঠিন মূহুর্তে ‘টুং’ শব্দে একটি বার্তা ঢুকল তার ফোনে। না দেখেও রোহিনী জানে, কার বার্তা! উঃ, কি যে মুশকিলে পড়েছে ও! বার্তাটির প্রতি উদাসীন থেকে লেখার মধ্যে মনোনিবেশ করতে চেষ্টা করল রোহিনী। কিন্তু তা কি সম্ভব?

পরপর বার্তা ঢুকতেই লাগল। রোহিনী জানে, যতক্ষণ তার সাড়া না পাবে, বার্তা বিরামহীন রইবে।
নাঃ, লেখায় মন বসছে না!
যুক্তি বলছে ‘উত্তর দেওয়ার দরকার নেই।’


মন তা মানলে তো! শেষপর্যন্ত মনেরই জয় হল।
“কি ব্যাপার? এত রাতে বারবার বিরক্ত করছ কেন? মন দিয়ে পড়াশোনা কর। সামনেই পরীক্ষা না?”
“পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছি, ম্যাডাম। তাই তো আপনার সাথে বার্তালাপ করে সতেজ হতে চাইছি। বেশি নয়, একটুখানি কথা বলব… প্লিজ …”
“বল, বেশিক্ষণ সময় দিতে পারব না।”
“নতুন লেখা শুরু করেছেন, ম্যাডাম?”
” হুম…”
“খুব ভাল লাগল শুনে।

আপনার শেষ বইটা বেরোনোর পর অনেকদিন কেটে গিয়েছে। পরের বইটার জন্য পাগলের মত অপেক্ষা করছি! এত সুন্দর কি করে লেখেন, ম্যাডাম?”
“তাই? আমার বই সত্যিই এত ভাললাগে?”


“শুধু আমার নয়, আমার সমস্ত বন্ধুদেরও ভীষণ প্রিয় আপনার লেখা! তবে… আমি আপনাকে যতটা পছন্দ করি… না… মানে আপনার লেখা… আপনি আমার বেস্ট রাইটার।”
“উঁ….”
“আমার ভীষণ ইচ্ছে, আপনার সাথে অন্ততঃ একবার যদি দেখা করতে পারতাম!”


“বইমেলায় এস, দেখা হয়ে যাবে।”
“না, ম্যাডাম, ওভাবে নয়। সে তো সকলেই দেখা করে। আমি আপনার সাথে অন্যভাবে একা দেখা করতে চাই।

আপনার জন্য আমি নিজের হাতে রান্না করতে চাই, হাসনাহেনা ও দোলনচাঁপা দিয়ে টেবিল সাজাতে চাই, মোমের আলোয় আপনার সমস্ত লেখা নিয়ে আলোচনা করতে চাই, ভাগ করে নিতে চাই আমার অনুভূতি, জানতে চাই আপনার মনের কথা …”
” তোমার সময় শেষ। অনেক কথা বলেছ। এবার মন দিয়ে পড়াশোনা কর। আমারও অনেক কাজ আছে।” গম্ভীর গলায় কথাগুলো লিখে দুম করে অন্তর্জাল কেটে বেরিয়ে আসে রোহিনী।

মধ্যবয়সী রোহিনীর হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়, মাথার মধ্যে দপ দপ করতে থাকে! নিজেকে সামলাতে বেশ খানিক সময় লাগে তার। সেও তো রক্ত মাংসের মানুষ! জীবনের অনেকটা পথ পেরিয়ে অভিজ্ঞ হলেও একেবারে আবেগবর্জিত তো হতে পারে না সে! রোহিনী অনেক দিন আগেই বুঝতে পেরেছিল, কলেজের বাচ্চা ছেলেটি মানে অনীক তার প্রেমে পড়েছে! মনে মনে হেসেছিল সে, উঠতি বয়সের পাগলামি! প্রিয় সাহিত্যিকের প্রতি মোহ!

কিন্তু সে নিজেও স্তাবকতার জাল ছিঁড়ে বেরোতে পারেনি, বলা ভাল ইচ্ছেই হয়নি। স্বয়ং ভগবান ভক্তের ভালবাসার কাছে হার মানেন, আর রোহিনী তো সামান্য মানুষ!


রোহিনীর প্রশ্রয়ে অনীক ধীরে ধীরে কবে থেকে যেন তার মনের অন্দরে সিঁদ কাটতে শুরু করেছিল, বুঝতেই পারেনি রোহিনী! রোজ ‘সুপ্রভাত’ ও ‘শুভরাত্রি’ দিয়ে শুরু করা আলাপ গভীর হতে শুরু করেছিল কবে থেকে যেন! কোন নতুন লেখা শেষ করার পর অনীকের সাথে আলোচনা করাটা অভ্যেসে পরিণত হচ্ছিল তার। অন্তর্জালের ওপার থেকেই ক্রমশঃ অনীক চিনে নিতে শিখছিল রোহিনীর ভাললাগা মন্দলাগা আর আনন্দ মনখারাপের সুর। অনীকের সাথে একদিন কথা না হলে রোহিনীও ভাসত মনখারাপের ঢেউয়ে।


রোহিনীর জীবনপথ বড়ই মসৃণ। পড়াশোনা শেষ করে উপযুক্ত পাত্রের সাথে গাঁটছড়া, সুখী নিশ্চিন্ত সংসার, একমাত্র মেয়ে রোমির উচ্চশিক্ষা চাকরি… সবই নির্বিঘ্নে ঘটেছে। কোনদিকে তাকাবার অবকাশই ছিল না ব্যস্ত রোহিনীর। রোহিনীর স্বামী নিখিল কাজপাগল মানুষ, চিরকাল সে স্ত্রীর কাঁধে সংসারের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত। রোহিনীও মেয়ে নিয়েই ব্যস্ত থাকত। মেয়ে চাকরিসূত্রে বাইরে চলে যাবার পরই সমস্যার সূত্রপাত। হঠাৎ পাওয়া একরাশ অবসর নিয়ে রোহিনী বিব্রত হয়ে উঠেছিল। নিখিল তাকে পরামর্শ দিয়েছিল ‘নিজস্ব জগত’ এর সন্ধান করতে। অনেক খুঁজে রোহিনী তার বালিকাবেলার শখকে ফিরে পেয়েছিল- তার লেখালিখি। ধীরে ধীরে লেখিকা হিসেবে পরিচিতিও হতে থাকে। রোহিনীর সাফল্যে নিখিল ও রোমিও ভেসেছিল খুশির জোয়ারে। পাঠকদের শুভকামনায় ভরে উঠত রোহিনীর অন্তর্জালের চিঠিবাক্স।

অনীক ছিল তাদেরই একজন। কিন্তু ধীরে ধীরে সে রোহিনীর মনে বিশেষ জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়।
বেশ বুঝতে পারছে রোহিনী, তার মনেও ঝড় উঠেছে। তার কঠোর নিয়ন্ত্রণের বাঁধ ভাঙতে চাইছে মন। মনের একটা অংশ তাকে ক্রমাগত সাবধান করছে, শেষ বয়সে এসে সে চরিত্র স্খলনের মত ভুল করছে!
মনের আরেকটি অংশ তাকে বোঝাচ্ছে, বন্ধুত্ব যেকোনো বয়সেই হতে পারে।


” শুধুই বন্ধুত্ব? একদিন কথা না বললে মনের ভাঁজে মনখারাপিয়া সুর, সারাদিন অনীকের কথা বারেবারে মনে পড়া, কিছু লিখলেই অনীকের মতামতের আশায় থাকা, ওর সাথে দেখা করার প্রবল আগ্রহ- এগুলো কি বন্ধুত্বের থেকে একধাপ এগিয়ে নয়?”
” প্রেম? কক্ষনো নয়! স্বামী সন্তান নিয়ে সুখের ঘরকন্না আমার। প্রেম আসার প্রয়োজন কোথায়? অনীক আমার কাছে একজন বিশেষ পাঠক, ওর মুগ্ধতা আমি উপভোগ করি। ব্যস্, এটুকুই!”
তর্কবিতর্কে মেতে ওঠে রোহিনীর দুই সত্তা। একসময় ক্লান্ত হয় রোহিনী। আর কিছু ভাবতে পারে না।


“ম্যাডাম, পরীক্ষা শেষ। ভীষণ হালকা লাগছে। আপনার কথা শুনে আমি কিন্তু মন দিয়ে পড়াশোনা করেছি। পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আপনার সাথে যোগাযোগ করিনি। এর আগে এত পড়াশোনা কখনও করিনি। এবার আমার কথা রাখার পালা আপনার।” বেশ কিছুদিন পর অনীকের বার্তা এল রোহিনীর কাছে।


“পরীক্ষার ফলও কিন্তু ভাল চাই আমার।” রোহিনী লেখে।
“নিশ্চয়ই, আপনার কথা অমান্য করার ক্ষমতা নেই আমার। আপনাকে অদেয় কিছুই নেই আমার। আপনার স্থান আমার কাছে কি… বোঝানোর সাধ্যই নেই আমার।”

এতদিন পর যোগাযোগ … কড়া করে কিছু লিখতে মন চায় না রোহিনীর। কিন্তু এ বার্তার উত্তর কি দেবে সে!
“ম্যাডাম, একবার, প্লিজ… একবার আপনার সাথে দেখা করতে চাই। কাল বিকেলে আমার বাড়িতে আপনার নেমন্তন্ন। ‘না’ বলবেন না… প্লিজ …”


” আচ্ছা, কিন্তু বেশিক্ষণ থাকতে পারব না…”
অনীকের বাড়িতে যাওয়ার জন্য নির্দিষ্ট সময়ে আয়নার সামনে তৈরি হতে বসে রোহিনী।
‘এত করে বাচ্চা ছেলেটা চাইছে, তাই একবার ওর বাড়িতে যাওয়া! মানুষ মানুষের বাড়িতে যায় না! বন্ধুত্ব যেকোনো বয়সেই হতে পারে।’ নিজের মনকে বুঝি প্রবোধ দিতে থাকে রোহিনী।
‘ইস, চোখের নীচে খানিক কালি জমেছে মনে হচ্ছে! মুখের চামড়াটাও যেন ঝুলে গিয়েছে! বয়স বাড়ছে! কেমন যেন বিচ্ছিরি দেখতে হয়ে গিয়েছি!’ নিজের মনেই বিড়বিড় করে রোহিনী।
‘কিসব আজেবাজে ভাবছি! যাচ্ছি এক পাগল ছেলের ছেলেমানুষিতে সাড়া দিতে। এত সাজছিই বা কেন?’ সম্বিত ফিরে পায় যেন রোহিনী।
টুকটাক প্রসাধন সেরে শাড়ি পছন্দ করতে বসে সে।

‘নীল রঙটা অনীকের পছন্দ হবে? নাকি এই হালকা বিস্কুট রঙেরটা?’ শেষপর্যন্ত দ্বিতীয় শাড়িটিই পছন্দ হয় তার।
অনীক এ শহরে একাই থাকে পড়াশোনার জন্য। কাঁপা কাঁপা হাতে অনীকের বাড়ির কলিংবেলটা বাজায় রোহিনী। তার গলা শুকিয়ে এসেছে, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, বুকের ভেতর দামামা! কেন যে এমন তরুণীসুলভ মনের অবস্থা! জোর ধমক দেয় নিজের মনকে সে!

দরজা খুলতেই সুঠাম চেহারার অনীক। কয়েক মূহুর্ত কেউই কোন কথা বলতে পারে না!
” আসুন আসুন ম্যাডাম …” নিজেকে সামলে বলে ওঠে অনীক।

“দেখ, তোমার কথা রাখতে চলেই এলাম…” সহজ হতে চেষ্টা করে রোহিনীও।
এসি চালিয়ে ঘর মনোরম করে রেখেছে অনীক, ফুলদানিতে রোহিনীর প্রিয় ফুল, বাজছে তার প্রিয় সুরও! নিখিল তো কখনও এমন করে সাজায়নি! না চাইতেও তুলনাটা এসেই গেল রোহিনীর মনে।

“আমার নিজের হাতে বানানো বিশেষ সরবত, খেয়ে দেখুন…”
” সত্যিই, প্রাণ জুড়িয়ে গেল!” সরবত মুখে দিয়ে না বলে পারল না রোহিনী।


ওরা এরপর মেতে উঠল কথায় কথায়। কত গল্প জমেছিল! লেখালিখি নিয়ে কারোর সাথে এত আলোচনা করে এই প্রথম এত খুশি হল রোহিনী! টেবিলে খাবারের আয়োজন দেখে রোহিনী থ!
“সবকিছু আমার নিজের রান্না। আজ আমার স্বপ্নপূরণের দিন!” গভীর চোখে তাকায় অনীক।
ঐ চোখের গভীরে ডুবে যেতে চায় রোহিনীর মন। তাকে ভারি যত্ন করে খাওয়ায় অনীক। মা চলে যাওয়ার কত যুগ পর এমন সুন্দর করে কেউ সাজিয়ে খাওয়াল তাকে! চোখদুটো কেমন জ্বালা করে ওঠে তার। তার হাতে আলতো ছোঁয় অনীক, ভালবাসার ছোঁয়া। রোহিনী মনে মনে ডুবতে থাকে সেই ভালবাসার স্রোতে।
গল্পে গল্পে কেটে যায় অনেকটা সময়।
“এবার আমায় ফিরতে হবে অনীক।”
ব্যথিত দৃষ্টিতে তাকায় অনীক। অনীকের আঙুল আলতো ছুঁয়ে দেয় রোহিনীর ঠোঁট। ভয় পায় রোহিনী, ভীষণ ভয়… নিজেকে হারিয়ে ফেলার ভয়, নিজেকে সামলাতে না পারার ভয়, অনীকের ঝকঝকে জীবনটা নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়! ঐ মায়াবী পরিবেশ থেকে নিজেকে টেনে হিঁচড়ে সে বাড়ির পথে পা রাখে।
বাড়িতে ফিরেছে রোহিনী। সাওয়ারের অঝোর জলের তলায় ভিজছে রোহিনী। তার করা ভুল এলোমেলো করে দেবে সংসার, রোমির জীবন… কি দরকার শান্ত জীবনে ঝড় আনার! অনীকের বয়স কম, সে ভাসতেই পারে আবেগে! রোহিনী তো দায়িত্বজ্ঞানহীন হতে পারে না! সে তো শুধু নারী নয়, একইসাথে সে মা… সে স্ত্রী।
ফোনটা নিয়ে অনীকের সাথে যোগাযোগের রাস্তাগুলো একে একে বন্ধ করতে থাকে রোহিনী। অনীক ভাল থাকুক, স্বাভাবিক জীবনে ফিরুক। সম্পর্কের স্মৃতিটুকু রোহিনী না হয় যত্ন করে মনের এককোণে লুকিয়ে রেখে দেবে! ঘুমের ঘোরে নিখিল জড়িয়ে ধরে রোহিনীকে। আলতো করে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় রোহিনী।

ekhansangbad
Author: ekhansangbad

Related News

Also Read