Select Language

[gtranslate]
২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ শুক্রবার ১৮ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

।। পিসির দেওয়া শাড়ি ।।

দামিনী :- পরনের লাল শাড়িটার বয়স আজ ২০ বছর হলো ।
কিন্তু আজও শাড়িটার জৌলুস এতটুকুও হারায়নি । মনে পড়ে গেলো তখন আমি তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী । মাসটা ছিলো শ্রাবণ। বাড়িতে তখন উৎসব শুরু হয়ে গেছে । আমার পিসির বিয়ের উৎসব। পিসির লাল রঙ ছিলো খুব পছন্দের তাই শখ করেই এই লাল শাড়িটা কিনেছিলো বিয়েতে পড়বে বলে । পিসি বরাবরই একটু বিয়ে পাগল ছিলো , বিয়ে নিয়ে সে কি আমোদ তার । কিন্তু বিয়েটা আর হলোনা পিসির ।


বিয়ের তিনদিন আগে পাত্রপক্ষ ফোন করে জানিয়ে দিলো তারা এই মেয়ের সাথে তাদের ছেলের বিয়ে দেবেননা । বাড়ির সকলে খুব ভেঙে পড়েছিলো। আর পিসি , একটা রাগী বদমেজাজী মেয়ে থেকে শান্ত কাঠের পুতুলের মতো হয়ে গেলো সেদিনের পর থেকে । এটা তো হওয়ারই কথা । এই নিয়ে পিসির পাঁচ বার বিয়ে ভাঙলো । পিসির গায়ের রঙ ছিলো খুব কালো । তাই যতবার সম্বন্ধ এসেছে ততবারই ভেঙে গেছে ।
কিন্তু আগের চার বার শুধু সম্বন্ধ ভেঙেছিল । কিন্তু এবারে তো বিয়েটাই ভেঙে গেলো ।

চারবার বিয়ের আশায় ছাই পড়ার পর যখন পাঁচ নম্বর সম্বন্ধ এসেছিলো পিসি তখন গায়ের কালো রঙ ফরসা করার জন্য কতো ক্রিম ব্যবহার করেছে ,কত ঘরোয়া টিপস ব্যাবহার করেছে তার কোনো হিসাব নেই ,শুধু মাত্র সিঁথি ভর্তি সিঁদুর পরবে বলে । হ্যা , পিসির মুখের ,গায়ের কালো রঙ ফরসা হয়নি ঠিকই কিন্তু মুখে একটা জৌলুস এসেছিলো । সেই কারণেই হয়তো পাত্র পক্ষের পছন্দ হয়েছিলো এবং বিয়ের পাকা কথা অবধি ব্যাপারটা গড়িয়েছিলো ।

পিসি নিজে ছোটো বাচ্ছাদের টিউশন পড়াতো ,সেই টিউশন পড়ানোর টাকা জমিয়ে জমিয়ে অনেক শাড়ি কিনেছিলো , যেগুলোর মধ্যে এই লাল শাড়িটা একটা ।
বিয়ের তিনদিন বাকি আছে আর ,পিসি গেলো ছাত্রীর বাড়িতে আইবুড়ো ভাত খেতে । ফিরে এসে শুনলো পাত্রপক্ষ পাশের বাড়িতে ফোন করে জানিয়েছে বিয়েটা হবেনা ।

তাদের ছেলে নাকি অফিসের কলিগকে ভালোবাসে তাকেই বিয়ে করবে । পিসির মুখ থেকে হাসিটা মিলিয়ে গেলো
পাথরের মতো হয়ে গেলো পিসি । সেদিনের পর থেকে আর বিয়ের কথা পিসি ভাবেওনি। মাস কয়েক পরেই ছিলো সরস্বতী পুজো ,সেদিন সবাই শাড়ি পরেই স্কুলে যায় তাই আমিও বায়না ধরলাম শাড়ি পরেই স্কুলে যাবো ।

পিসি তার পছন্দের এই লাল শাড়িটা আমায় দিয়ে বললো এটা নে । আমিও তখন বাচ্ছা মানুষ বুঝতে পারিনি এই শাড়িটার সাথে পিসির কত ভালোলাগা, আবেগ ,কষ্ট ,অভিমান জড়িয়ে ছিলো ।তাই শাড়িটা নিয়ে নিয়েছিলাম ।

মা আমার বারণ করেছিলো শাড়িটা নিতে কিন্তু তখনই পিসি বললো না গো বৌদি মানাই তো খুব ফরসা ওকে এই শাড়িটা পরলে দারুন মানাবে । পিসি শাড়ির পাট খুলে শাড়িটা আমার কোমরে জড়াতে জড়াতে বললো আমি আমার ভাইঝিকে দিয়েছি শাড়িটা তুমি বারণ করার কে গো ? সেদিন থেকে আমার কাছেই লাল শাড়িটা রয়ে গেছে । পিসির থেকেই শিখেছিলাম পোশাকের যত্ন কিভাবে করতে হয় ।



সেদিন থেকে এই লাল শাড়ির একটুও অযত্ন হয়নি আমার কাছে । বিয়ের পর আর সরস্বতী পুজোয় পরা হয়না তাই প্রতি বছর লক্ষ্মী পুজোর দিন এই লাল শাড়িটা আমি পরি। আজ পিসি আমার কাছে নেই গত তিন বছর আগে রোড অ্যাক্সিডেন্টে স্পট ডেথ হয়ে গেছিলো ।

সেই বিয়ে ভাঙার পর থেকেই পিসি কেমন একটা হয়ে গেছিলো । বিয়ের প্রতি কোনো আগ্রহই আর ছিলো না পিসির । খুব ভেঙে পড়েছিলাম পিসির মৃত্যুতে । আমার দ্বিতীয় মা ছিলো আমার পিসি । আমায় পিসি অনেক কিছুই দিয়েছে ছোটো বেলায় , বিয়ের আগে ,বিয়ের পরে । কিন্তু এই লাল শাড়িটাই আমার কাছে পিসির দেওয়া সেরা উপহার । কষ্ট পেলেও পিসি আমায় জোর করেই প্রতি বছর শাড়িটা পরতে বলতো । আমায় এই লাল শাড়িতে দেখে নাকি পিসির চোখ মন জুড়িয়ে যেতো । আজ দেখতে দেখতে কুড়ি বছর পার হলেও এই শাড়ি আমার কাছে অমূল্য । শাড়িটা পরলেই মনে হয় পিসি আমার সঙ্গেই আছে সবসময় ।

শাড়ির জৌলুস দেখে মনে হয় ওটা জৌলুস নয় ওটা পিসির হাসি । এই লাল শাড়ি আর আমি দুইই খুব প্রিয় ছিলাম পিসির কাছে ।তাই মনে হয় পিসি তার প্রিয় লাল শাড়ির দায়িত্ব আমায় বরাবরের মতো দিয়ে চলে গেলো না ফেরার দেশে ।


আমারও অনেক শাড়ির মধ্যে পিসির দেওয়া কুড়ি বছর আগের এই লাল শাড়িটাই আজীবন আমার কাছে সেরা হয়ে থাকবে । আমি যতদিন বেঁচে থাকবো এই শাড়ির জৌলুসও কমবে না । কারণ এই শাড়িটাই আমার কাছে পিসির হাসি-খুশি আবেগ আর আশীর্বাদ ।

সৌজন্যে প্রতিলিপি

ekhansangbad
Author: ekhansangbad

Related News

Also Read