Select Language

[gtranslate]
৮ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ বুধবার ২২শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

।। তোমায় ছুঁতে চাওয়ার মুহূর্তটা ।।

পুষ্পিতা ভৌমিক :- আজ সকাল থেকেই রায়চৌধুরী বাড়িতে সাজসাজ রব। বাড়ির একমাত্র আদরের মেয়ে অলির আজ সাধভক্ষণ অনুষ্ঠান। আত্মীয়স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশী মিলে ভর্তি বাড়িটা গমগম করছে। অলিকেও ভীষণ সুন্দর দেখতে লাগছে আজ।হাতে শাখাবাঁধানো, পলা, নোয়া সিঁথিতে জ্বলজ্বলে সিঁদুর আর পায়ে রাঙা আলতার ছোয়ায় মোহময়ী স্বামী গরবীনির মত লাগছে ওকে। ওদিকে ওভেনে পায়েস বসানো হয়েছে অলিকে দেওয়া হবে বলে। রান্নাঘরের পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে হালকা একটা মিষ্টি সুবাস নাকে আসে গুঞ্জার মানে রায়চৌধুরী পরিবারের বড়বৌ। সুবাস যা ছাড়ছে তাতে মনে হচ্ছে পায়েসটা হয়ে এসছে। আরেকটু বেশিক্ষণ গ্যাসে বসানো থাকলে পুড়ে যাবে এই আশঙ্কায় রান্নাঘরে ঢোকে গুঞ্জা। যে যাই বলুক না কেন ওকে নিয়ে মন থেকে ও সত্যিই চায়না আদরের ননদিনীর জন্য রাঁধা পায়েসটা পুড়ে যাক। তাছাড়া এই বাড়িতে যখন প্রীতমের সাথে বিয়ে হয়ে এসেছিল অলিই ছিল গুঞ্জার সমস্ত সুখদুঃখের সাথী। সে একসাথে সিনেমা দেখতে যাওয়াই হোক বা পুজোর বাজারে গিয়ে ফুচকা খাওয়া। পায়েসটা কাঁচের বাটিতে ঢেলে উপর থেকে পেস্তা, কাজুবাদাম কুচি ছড়িয়ে দেবে বলে ওভেন অফ করে গুঞ্জা।


এইসময় হঠাৎ হাহা করে ছুটে আসেন ওর শাশুড়ি মানে অলি আর প্রীতমের মা রায় চৌধুরী বাড়ির গিন্নিমা রেবতী দেবী। চেঁচিয়ে উঠে বলেন,”কী সব্বনেশে কাণ্ড করছিলে তুমি গুঞ্জা! আর কবে জ্ঞানগম্য হবে তোমার পাঁচ বছর হল বংশের কোন প্রদীপ আনতে পারলেনা। নিজে বাঁজা বলে আমার মেয়ের জীবনটাও নষ্ট করে দিতে চাইছ এত হিংসা তোমার মনে? তোমার হাতের ছোয়া পায়েস খেলে ওর অমঙ্গল হবে জাননা তুমি। ভাগ্যিস আমি দেখতে পেলাম নইলে কি অলুক্ষণে কাণ্ডটাই না হত!”, এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে দুহাত জোড় করে কপালে ঠেকান রেবতী দেবী।


আর কোনো কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ নিজের ঘরে চলে যায় গুঞ্জা। ও ভালোমতই জানে যে সন্তান ধারণে অক্ষমতার দায় ওর নয়।বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই গুঞ্জা প্রীতমের সন্তান ধারণে অক্ষমতার কথা জানতে পেরেছিল। কিন্তু প্রীতম সেটা স্বীকার করতে অপারগ ছিল তাই সমস্ত দোষ গিয়ে পড়েছে গুঞ্জার উপরে। প্রীতম কারোর কথায় কোনও প্রতিবাদ করতনা ঘরে এসে গুঞ্জার দিকে অসহায়ের মত চেয়ে থাকত। শেষপর্যন্ত সমাজ সংসার সবকিছু ভেবে আর এই বাড়ি ছেড়ে যেতে পারেনি ও। চোখটা জলে ভরে আসে গুঞ্জার। শঙ্খ আর উলুধ্বনির মধ্যে অলির সাধ অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো ঘটা করে। যদিও অলি অনেকবার ডাকতে এসেছিল কিন্তু গুঞ্জা শুধু ম্লান হেসে বলেছিল, ‘পাগলি আমি ওখানে উপস্থিত না থাকলেও তোর উপর আমার আশীর্বাদ সবসময় থাকবে। দেখবি তোর কোল আলো করে একটা সুস্থ বাচ্চা আসবে তা সে ছেলেই হোক বা মেয়ে।”


এই ঘটনার মাস তিনেক পর প্রসব যন্ত্রনা ওঠে অলির। তড়িঘড়ি ওকে নিয়ে যায় রায়চৌধুরী বাড়ির লোকজন।এদিকে গুঞ্জা তখন ঠাকুরঘরে সবকিছু যাতে ঠিকমত হয় সেইজন্য প্রার্থনা করছে এমন সময় ওর স্বামী প্রীতম ফোন করে জানায়,”অলির অবস্থা খুব খারাপ।প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। ইমিডিয়েট ও নেগেটিভ গ্রুপের রক্ত দিতে লাগবে কিন্তু কোথাও পাওয়া যাচ্ছেনা।” চকিতে নিজের কথা সবার প্রথমে মনে আসে গুঞ্জার। ওর নিজেরও তো একই গ্রুপের রক্ত।বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে গুঞ্জা। লক্ষণ অলক্ষণ সবকিছু নিয়ে নাহয় পরে ভাবা যাবে আগে তো চেষ্টা করে দেখা যাক যদি ওর রক্ত দিয়ে কাজ চালানো যায়।ওর তৎপরতায় সেদিন শেষমেশ রক্ষা পায় অলি। ওর কোলে আসে একটা ছোট্ট ফুটফুটে কন্যা সন্তান। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন রায়চৌধুরী পরিবারের সকল সদস্যরা।


একসপ্তাহ পরে পুচকিটাকে কোলে করে বাড়ি ফেরে অলি আর ওর স্বামী বিতান। রেবতী দেবী ছুটে আসেন নাতনির মুখে দিয়ে বরণ করে ঘরে তুলবেন বলে। এবার মায়ের হাতটা চেপে ধরে অলি কাটা কাটা ভাবে বলে,”মা আজ তোমার অবাধ্য হচ্ছি কিছু মনে করোনা কারণ আমি আর চুপ করে থাকতে পারলাম না তাহলে বিবেকের কাছে অপরাধী হয়ে থাকব আজীবন। তাই আমাকে ক্ষমা করো মা। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে কথাগুলো বলতে তাই আজ যদি না বলি তাহলে আর কোনদিনই বলতে পারবোনা।তুমি আজ যে নাতনির মুখে মধু খাওয়াতে এসছো সে ওই যাকে প্রতিটা দিন যাকে বাঁজা বলে অপমান করো, কিছু হলেই দোষ চাপিয়ে দাও সে না থাকলে পৃথিবীর আলো দেখত না। হয়তো আমিও মারা যেতাম রক্তের অভাবে। একসাথে দুটো প্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছে গুঞ্জা বৌদি। মা হতে গেলে সবসময় পেটে সন্তান ধারণ করতে হবে তাতো নয়।যশোদাও তো কৃষ্ণকে নিজের পেটে ধরেননি তাহলে কেনো সাধারণ মানুষের বেলায় এমন অবিচার? যে প্রাণ সৃষ্টি করে সেই তো মা। আমি আরো বলি শোনো সন্তান ধারণে অক্ষম তোমার ছেলে মানে আমার দাদা। মেরুদণ্ড সোজা রেখে মেডিক্যাল রিপোর্টগুলো কোনোদিন তোমাদের দেখাতে পারেনি আজপর্যন্ত। আমি একদিন কলেজে শাড়ি পড়ে যাবো বলে বৌদির ঘরে শাড়ি আনতে গেছিলাম। এটা ওটা বাছতে গিয়ে রিপোর্ট গুলো মাটিতে পড়ে যায় তখন থেকেই আমি জানতাম সত্যিটা কি। শুধুমাত্র বৌদির অনুরোধে সাংসারিক অশান্তি এড়িয়ে যাবার ভয়ে এতদিন চুপ ছিলাম।কিরে দাদা চুপ কেন পৌরুষত্বের দোহাই দিয়ে এখনও চুপ করে থাকবি নাকি আজ সব সত্যি বলবি? তুই যদি না বলিস তাহলে আমি নিজে গিয়ে আলমারি থেকে রিপোর্টগুলো বের করে নিয়ে আসবো।”

প্রীতম মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে, বাকি কারোর মুখে আর কোনো কথা সরেনা।রেবতীদেবী বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান। একটু দূরে দাঁড়িয়ে গুঞ্জার চোখ তখন জলে ভেসে যাচ্ছে। ওকে নিজের কাছে ডাকে অলি বলে,”আজ থেকে তুমিই ওর মা বৌদিভাই; তুমি না থাকলে ও তো পৃথিবীর আলো দেখতনা। তাই আমি আর বিতান দুজন মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি ও তোমার হাতে তোমার মনের মত করে মানুষ হবে। আমরা তোমার সঙ্গ দেব।”



ছোট্ট পুঁচকিটাকে কোলে নিয়ে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দেয় গুঞ্জা, এক অদ্ভুত শিহরণ খেলে যায় ওর সারা শরীরে। কচিকচি আঙ্গুলে জড়িয়ে ধরে গুঞ্জাকে ওই ছোট্ট একরত্তি শিশুটা যেন বলে,”মা আমাকে ছেড়ে কোথাও যেওনা।”জীবনে প্রথমবার ও অনুভব করে মাতৃত্বের সুখ, সত্যিই বোধয় এই স্পর্শটুকুর জন্য মেয়েরা এত অপেক্ষা আর কষ্ট সহ্য করে মা হওয়া ওঠে।।।

ekhansangbad
Author: ekhansangbad

Related News

Also Read