Select Language

[gtranslate]
৮ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ বুধবার ২২শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

।। দেবী অপরাজিতা ।।

সুনীতা সাহা গাঙ্গুলী :- ঠাকুরদালানের সবাই রয়েছে অথচ মেয়েটিকে দেখা যাচ্ছে না। তিন্নি কোথায় গেলি? এদিকে আয় তাড়াতাড়ি।
মা আপনার আদরের নাতনিকে দেখেছেন?
দিদিভাই?ওতো আমাকে বলেই গেল যে ঠাম্মি আমি ওপরে যাচ্ছি।
কিন্তু মা ওতো ধাগা বেঁধে যায়নি।
ওমা সে কি!আমি তো তা খেয়াল করিনি বৌমা। দাঁড়াও আমি অনিকে পাঠাচ্ছি। ডেকে আনুক দিদিভাই কে।

মা কাকাই এখানে আসতে বলল।কি বলছ তাড়াতাড়ি বল।জানোই তো দশমী পূজোর পর পুরোহিত মশাই সবাইকে হাতে অপরাজিতা ডাল দিয়ে তৈরী ধাগা পড়িয়ে দেন।কাকাই ,দাদু, ঠাম্মি, জেঠু, পিসি, মামাদের সবার পড়া হয়ে গেছে শুধু তুমিই একমাত্র বাকি আছো।পুরোহিত দাদুর কাছে গিয়ে বসো,উনি পড়িয়ে দেবেন।

জানি তো। তবে আমি এবারে ওই ধাগা – টাগা পড়বো না। কাল আমার বন্ধুর বাড়িতে পার্টি আছে,আমার ঐ ড্রেসের সাথে ভালো লাগবে না।
পড়বি না মানে?
না, মা আমি কিছুতেই পড়বো না।
দেখো তিন্নি, বাড়িতে অনেক লোকজন আছে ,আমাকে চিৎকার করতে বাধ্য করো না।

বৌমা আমি দিদিভাইকে বুঝিয়ে বলছি। তুমি ওকে আর বকাবকি করো না। এমনিতেই আজ ওর বড্ড মনটা খারাপ। বিকেলে প্রতিমা বিসর্জন। তারপরেই মামা-মামী চলে যাবে। আবার সকাল হতেই কাকাই। তারপরই জেঠুও…।ও আবার বড় একা হয়ে যাবে। এ কদিন যা হইচই গেল, বাড়ি ভর্তি লোক। এদিকে পুজোর জোগাড় ,ওদিকে ভোগ রান্না আর একদিকে প্রসাদ খাওয়ানোর আয়োজন। এত বড় উৎসব শেষ হয়ে গেলে মনটা তো খারাপ হওয়ারই কথা। তাই না বৌমা!শোন তিন্নি ভালোভাবে বলছি, বেয়াদপি করিস না, এই ধাগা টা পড় তেই হয়।মঙ্গলের জন্য। এটাই নিয়ম। শুধু পড়তে হয়, নিয়ম আছে, বলতে থাকো।কি নিয়ম আছে বললে তবেই আমি পড়বো।

কোথায় গেলে তিন্নি সোনা, এসো এবার তোমাকে হাতে বেঁধে দিই।পুরোহিত দাদুর আওয়াজ শুনে তিন্নি লক্ষ্মী মেয়ের মতো এসে বসলো।আর বলল, পুরোহিত দাদু তোমাকে আজ বলতেই হবে কেন এই কাঠি দেওয়া লাল ধাগা টা পড়তেই হয়?

পুরোহিত মশাই খুব খুশি হয়ে বললেন, এ তো বেশ কথা। তবে তোমাকে যে ধৈর্য নিয়ে বসে শুনতে হবে। এর পিছনে একটি সুন্দর গল্প আছে।

তিন্নি ছুট্টে গিয়ে বাড়ির সকলকে ডাকতে গেল।তোমরা সবাই শিগগিরি ঠাকুর দালানে চলো। পুরহিতদাদু খুব ইন্টারেস্টিং একটা গল্প বলবে।

দাদু এইতো সবাই এসে গেছে তুমি এবার গল্প বলা শুরু করো।

আজ বিজয়া দশমী। আকাশে বাতাসে বিষাদের রেশ।আজ দেবী উমা মা কৈলাসে ফিরে যাবেন।এই যে একটু আগে ঘট নাড়ানো হল। তার মানে দেবীর বিসর্জন হল। আর ঘট নারানোর পর দেবীর বিগ্রহে আর প্রাণ থাকে না।কিন্তু তারপরও দেবীর পূজো করা হয়।অপরাজিতার পূজা।দুর্গা পূজার বিসর্জনের পরই দেবী অপরাজিতার বোধন হয়।দশভূজা আরেক নাম হলো অপরাজিতা।তখন দেবীকে অপরাজিতা রূপে পূজো করা হয়।

এই অপরাজিতা
দেবী হলেন চতুর্ভূজা,ত্রিনয়না।তার মাথায় থাকে চন্দ্রকলা।চার হাতে থাকে শঙ্খ, চক্র,বরমালা এবং অভয় মুদ্রা। তাই এই দশমী পূজোতে সাদা আর নীল রঙের অপরাজিতা লাগে। শাস্ত্র অনুযায়ী পুজোর স্থলেই এই অপরাজিতার পূজা করা হয়।অষ্টাদল পদ্ম এঁকে সেখানে সাদা অপরাজিতার গাছকে স্থাপন করা হয় দেবীরূপে।আর নীল অপরাজিতার মালা পড়ানো হয় দেবীকে।তারপর পুজো করা হয় দেবীকে। তবে এই পূজোর সময়সীমা বেশিক্ষণের জন্য হয় না।
আচ্ছা পুরোহিত দাদু, তুমি কি পদ্ম এঁকে এই গাছ প্রতিষ্ঠা করেই পূজা করেছ?
হ্যাঁ,দিদিভাই।যাও তুমি ঠাকুরের ঐ জায়গা টা ভালো করে দেখে এসো,তারপর বাকী গল্প টা বলছি।

এবার তোমরা শোনো কেন এই পুজো করা হয়?

অপরাজিতার অর্থ হলো,দেবী কখনো পরাজিত হন না।স্বয়ং রামচন্দ্র দেবী অপরাজিতা পূজোর প্রথম প্রচলন করেছিলেন বলে জানা যায়। শত্রুকে দমন করার জন্য দেবীর আরাধনা করেন ভক্তেরা। তাই দেবী দুর্গার বিসর্জনের ঠিক পরেই শুরু হয় তাঁর পূজো।শাস্ত্র থেকে আরও জানা যায় যে, আগে রাজারা অপরাজিতার পূজো করার পরেই যুদ্ধযাত্রায় রওনা দিতেন। এই যাত্রা মানে ‘বিজয়লক্ষী’ বরণ। অর্থাৎ যুদ্ধে জিতে বিজয়ী হওয়া।

আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো-মা দুর্গার বিসর্জনের পরও যে দেবী বিজয়ের প্রতীক হিসেবে থেকে যান সেটাই প্রমাণ করতেই অপরাজিতা দেবীর পূজা করা হয়। আর দেবী দুর্গা যাতে সব সময়ের জন্য আমাদের মধ্যে থাকেন তারই প্রার্থনার জন্যই এই পূজোর প্রচলন রয়েছে।তবে সাধারণ লোক এই পূজোর কথা বিশেষ জানে না।আমরা মানে পুরোহিতরাই এই পূজোর নিয়ম বিধি অনুযায়ী পূজো সম্পন্ন করে থাকি।তারপর পুজোর শেষে এই অপরাজিতার ডালের ধাগা সকলের ডান হাতে পড়িয়ে দিয়ে থাকি,মঙ্গল কামনার উদ্দেশ্যে।যেন প্রত্যেকে বাঁধা- বিঘ্ন কাটিয়ে সারা বছর জীবন যুদ্ধে অপরাজেয় থাকতে পারে। সারা বছরই সকলেই যেন সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে।

আবার শাস্ত্রে দেবী অপরাজিতার জন্য প্রার্থনা রয়েছে।এখানে দেবীর উদ্দেশ্যে বলা হয়,”হে দেবী অপরাজিতা!তুমি আমাকে সব সময় বিজয়ী করে দাও।আমার মঙ্গল এবং বিজয় লাভের জন্যই তোমাকে ডান হাতে ধারণ করেছি।হে দেবী, তুমি শত্রু দমন করে আমাকে সমৃদ্ধি এবং বিজয় দান করো।শ্রীরামচন্দ্র যেভাবে রাবণকে পরাজিত করে বিজয়ী হয়েছিলেন, আমাকেও তুমি তেমনি বিজয় দান করো।”



এই হলো অপরাজিতা দেবীর গল্প কথা।
যারা জানে তারা এভাবে দেবীর কাছে প্রার্থনা করে। তোমরাও জেনে নিলে, এরপর থেকে তোমরাও এভাবে দেবীর কাছে প্রার্থনা করতে পারবে।

পুরোহিত দাদুর কথা শেষ হতে না হতেই তিন্নি বলে উঠলো,ঠাম্মি,পরের বছর থেকে সবার আগেই আমি এই ধাগা পরে নেবো।
বাড়ির সকলে বলতে লাগলো তিন্নি র দৌলতে আজ আমরা অপরাজিতা দেবীর গল্প কথা জানতে পারলাম।

ekhansangbad
Author: ekhansangbad

Related News

Also Read