Select Language

[gtranslate]
২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ রবিবার ৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

চিরকুমার নন, দুই স্ত্রী নিয়ে সুখেই থাকেন কার্তিক !

চেন্নাই থেকে তিরূপতির পথে প্রায় ৭০ কিঃমিঃ দূরে তিরূত্তাণি তে একটি ছোট্ট পাহাড়ের উপরে অবস্থিত এই মন্দিরটিতে কুমার দুই স্ত্রী নিয়েই বিরাজ করছেন। কালো পাথরের বিগ্রহ। সোনা রূপার কবচ পরানো। প্রায় দু ফুট মাপের উৎসব মূর্তি রয়েছে।

একদা ব্রহ্মার বরে বলীয়ান হয়ে দেবতাদের স্বর্গছাড়া করেছিল তারকাসুর। ব্রহ্মা তাকে বর দিয়েছিলেন — একমাত্র শিবের ঔরসজাত পুত্র ছাড়া আর কেউ তাঁকে বধ করতে পারবে না।

অসুরের ফন্দি ছিল ভালই ! কেন না, শিব তখন সংসারত্যাগী ঘোরতর সন্ন্যাসী। সদ্য মৃত্যু হয়েছে তাঁর প্রথম স্ত্রী সতীর। শোকগ্ৰস্ত শিব, ফলে আর কারও দিকেই তাকাচ্ছেন না। এমন সময়েই হিমালয়ের ঘরে জন্ম নিলেন পার্বতী। দীর্ঘ টানাপোড়েন এর পথ পেরিয়ে তাঁর সঙ্গে বিয়েও হল শিবের। কিন্তু, সন্তান হল না। ক্রমাগত রমণসুখেই লিপ্ত থাকলেন হরগৌরী। বিপদ দেখে দেবতারা পাঠালেন অগ্নিদেবকে। তিনি শিবকে অনুরোধ করবেন পুত্রের জন্মদানের জন্য। অগ্নি যখন পৌঁছলেন, তখন শিব-পার্বতী কৈলাসের এক গুহায় নিভৃত সুখসন্ধানে রত। অগ্নি আচমকা গুহায় প্রবেশ করায় স্থলিত হল শিবের বীর্য। তাদের তেজের কারণে এক প্রকান্ড অগ্নি গোলক এর সৃষ্টি হয়। তিনি তা নিক্ষেপ করলেন অগ্নিতেই। কিন্তু শিব-পার্বতীর তেজ থেকে উৎপন্ন সেই গোলক অগ্নি আয়ত্ত করতে পারেন না। মা গঙ্গার শরণাপন্ন হন তিনি। যখন মা গঙ্গাও সেটা সামলাতে পারছিলেন না, তখন তিনি সেই গোলক এক জঙ্গলে ঘেরা শরবনে ফেলে দেন। এবং জন্ম নিল এক সন্তান। তাঁর ছটি মুখ। স্নান করতে এসে ছয় কৃত্তিকা দেখলেন সেই শিশুটিকে। বাড়ি নিয়ে গেলেন তাঁরা। পালন করতে থাকলেন নিজের ছেলের মতোই। কৃত্তিকার পালিত সন্তান বলেই নামও হল কার্তিক। কার্তিকের ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হওয়ার সেই শুরু। জানতেও পারলেন না তিনি, কারা তাঁর বাবা-মা ! আসল বাবা-মার ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হয়েই বড় হলেন তিনি। অতুলনীয় হলেন শস্ত্রে এবং শাস্ত্রে।

কিন্তু ঠিক সময়মতো কার্তিককে এবার কাজে লাগালেন দেবতারা। একটু বড় হতেই তাঁকে জানালেন তাঁর বংশপরিচয়। এবং পাঠালেন তারকাসুরের সঙ্গে যুদ্ধে। নিয়মমতো তারকাসুর বধও হলেন কার্তিকের হাতে। কৃতজ্ঞতাস্বরূপ ইন্দ্র তাঁর মেয়ে দেবসেনার সঙ্গে বিয়ে দিলেন শিবপুত্রের। এখানেই দ্বিতীয় ধাপে ভালবাসার পথ থেকে সরে এলেন কার্তিক। প্রেম কী, তা বোঝার আগেই শুরু হল তাঁর দাম্পত্য। সেই জন্যই তাঁকে আমরা বলি দেবসেনাপতি ! অর্থাৎ দেবসেনার পতি।

বিয়ের পর স্ত্রী দেবসেনার সঙ্গে কৈলাসেই রয়েছেন কার্তিক। মা, বাবা আর ভাই গণেশের সঙ্গে সুখে দিন কাটছে তাঁর। কিন্তু, সেই সুখের দিনে গ্ৰহণ এল। একদিন গণেশের সঙ্গে তাঁর শুরু হল প্রতিদ্বন্দ্বিতা — কে আগে সারা পৃথিবী প্রদক্ষিণ করতে পারবে ! ময়ূরে চড়ে সারা পৃথিবী ঘুরে এসে কার্তিক দেখলেন, বিজয়ীর সন্মান পেয়েছেন গণেশ। তিনি বাবা-মাকেই পৃথিবীজ্ঞানে তাঁদের প্রদক্ষিন করে কাজ সেরেছেন। সবাই প্রশংসা করছেন তাঁর বুদ্ধিমত্তার !

অভিমানে তখন কৈলাস ত্যাগ করলেন কার্তিক স্ত্রী দেবসেনাকে নিয়ে চলে এলেন দক্ষিনভারতে। বসতি করলেন পাহাড়ে, উপজাতি তাঁকে বরণ করে নিল সাদরে। ময়ূরবাহন বা মুরুগন বলে জানাল শ্রদ্ধাও ! কিন্তু, ভালবাসা পাওয়ার আকাঙ্খা কার্তিকের মন থেকে দূর হল না। তখনও যদিও তিনি জানতেন না, প্রেম এসে ধরা দিতে চলেছে তাঁর বাহুবন্ধনে। দক্ষিণ ভারতের এই পাহাড়েই সার্থক হবে তাঁর প্রেমের কামনা।

কার্তিক তাই কিছুটা মনমরা হয়েই থাকেন, ঘুরে বেড়ান ইতিউতি। এমন সময়ে একদিন তিনি দেখলেন, এক পাহাড়ি ক্ষেতে শস্য পাহাড়া দিচ্ছে একটি কালো পরমাসুন্দরী মেয়ে ! যতই কালো হোক, কার্তিক তুমুল ভাবে তার প্রেমে পড়লেন। এক বৃদ্ধের ছদ্মবেশে গিয়ে নাম জানতে চাইলেন, জানতে চাইলেন পরিচয়। শুনলেন, সে সেখানকার রাজার মেয়ে, তার নাম বল্লী।

এবার কার্তিক চাইলেন বল্লীকে বিয়ে করতে। সে কথা বলতেই বল্লী রেগে আগুন হলেন। তিনি সদ্য যুবতী, তার কেন এক বৃদ্ধকে মনে ধরবে। বিপদ দেখে কার্তিক তখন স্মরণ করলেন গণেশকে। গণেশও ভাইয়ের মনের কথা ভেবে এক মত্ত হস্তীর রূপ ধরে আটকে দাড়ালেন বল্লীর রাস্তা। বল্লীর আর উপায় নেই ! মত্ত হাতির ভয়ে তিনি জড়িয়ে ধরলেন সেই বৃদ্ধকে। ভয়ে তাঁর দু’চোখ বোজা ! তিনি আদায় করে নিলেন প্রতিশ্রুতি — হাতিটাকে তাড়াতে পারলে বল্লী তাঁকে বিয়ে করবেন। নয় তো দুজনেই মরবেন ! রাজী হতে তাই বাধ্য হলেন বল্লী।

যখন তিনি চোখ খুললেন, দেখলেন সেই বৃদ্ধের জায়গায় দাড়িয়ে রয়েছে এক সুপুরুষ যুবক। এরপর আর বিয়েতে আপত্তি থাকার কথা নয়। বিয়ে হলও ধুমধাম করে। এবং, বল্লীর সঙ্গে দাম্পত্য আর প্রেম পূর্ণ ভাবে উপভোগ করার জন্য দক্ষিণ ভারতের ছয়টি স্থানে ছয়টি শস্ত্রাগার নির্মাণ করলেন কার্তিক ! যেখানে, তৃপ্ত হবে তাঁর অস্ত্রচর্চা আর প্রেমচর্চা — দুই ! সেই ছয়টি শস্ত্রাগার আজ ভারতের সবচেয়ে পবিত্র কার্তিক মন্দিরে পরিণত হয়েছে। ভারতে কার্তিকের ছয়টি তীর্থস্থান হল — পালানি, স্বামীমালাই, তিরূত্তাণি, তিরূচেণ্দূর, তিরুপরম্কুণ্ড্রম এবং পাজামুথুরচলাই।

কার্তিক একইরূপে তিনি পরম সাত্ত্বিক ব্রহ্মচারী রূপে দন্ডধারণ করে কঠিন তপস্যায় রত আবার অন্য রূপে তিনিই পরম রাজসিক রূপে বল্লী ও দেবসেনার হৃদয়বল্লভ। ইন্দ্রপুত্রী গৌরবর্ণা দেবসেনা এবং প্রাকৃতবংশীয় শ্যামলবরণা বল্লী উভয়েই তাঁর সমান প্ৰিয়। দেবলোক থেকে নরলোকে তাঁর সমান বিচরণ। দুই লোকের দুহিতার ই তিঁনি প্রাণপ্ৰিয়।

অনেকে বলতেই পারেন, এ ছিল দক্ষিণ ভারতের কথা। বাংলায় কার্তিক চিরকুমার। তা-ই যদি হবে, তবে সন্তান, বিশেষ করে পুত্রসন্তান উৎপাদনের জন্য কেন কার্তিক ফেলা হবে নবদম্পতির বাড়ির সামনে ?

কার্তিকের বিয়ের কথা ভুললেও যুদ্ধের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথা কিন্তু বাঙালি ভোলেনি। যুদ্ধ আর সন্তান উৎপাদন — দুইয়ের অনুষঙ্গেই কার্তিককে স্মরণ করে বাঙালি !

আত্মবিস্মৃত বলে বাঙালির একটা বদনাম আছে তো ! সেই আত্মবিস্মৃতিই কার্তিককে চিরকুমার হিসেবে রেখে দেয় ! হ্যাংলা বলে বদনাম দেয়, ছড়া কেটে বলে — একবার আসেন মায়ের সঙ্গে, একবার আসেন একলা !
এটা শুধু কার্তিককে নিয়ে কেন ? মা দুর্গার বাকি তিন ছেলে-মেয়েও তো মায়ের সঙ্গে একবার আসেন, আরেকবার আসেন নিজের মতো !

এই ঠাকুরটি হ্যাংলা অন্য কারণে। আসলে ছোট থেকেই তিনি ভালবাসার কাঙ্গাল ! এক স্ত্রী থাকার পরেও সেই ভালবাসা খুঁজতে যে কারণে ছদ্মবেশ ধরতে হয় তাঁকে। আদায় করে নিতে হয় কাঙ্খিত রমণীর প্রেম। অথচ বুঝতে চায় না তাঁর দীর্ঘদিন ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকার কথা।

শ্রীশ্রী কার্তিক দেবের প্রনাম মন্ত্র —

ॐ কার্তিকের মহাভাগ দৈত্যদর্পনিসূদন।
প্রণোতোহং মহাবাহো নমস্তে শিখিবাহন॥
রুদ্রপুত্র নমস্ত্তভ্যং শক্তিহস্ত বরপ্রদ॥
ষান্মাতুর মহাভাগ তারকান্তকর প্রভো।
মহাতপস্বী ভগবান্ পিতুর্মাতুঃ প্রিয় সদা॥
দেবানাং যজ্ঞরক্ষার্থং জাতস্ত্বং গিরিশিখরে।
শৈলাত্মজায়াং ভবতে তুভ্যং নিত্যং নমো নমঃ॥

অনুবাদ —
হে মহাভাগ, দৈত্যদলনকারী কার্তিকদেব তোমায় প্রণাম করি। হে মহাবাহু, ময়ূর বাহন, তোমাকে নমস্কার। হে রুদ্রের (শিব) পুত্র, শক্তি নামক অস্ত্র তোমার হাতে। তুমি বর প্রদান কর। ছয়। কৃত্তিকা তোমার ধাত্রীমাতা। জনক-জননী প্রিয় হে মহাভাগ, হে ভগবান, তারকাসুর বিনাশক, হে মহাতপস্বী প্রভু তোমাকে প্রণাম। দেবতাদের যজ্ঞ রক্ষার জন্য পর্তবতের চূড়ায় তুমি জন্মগ্রহণ করেছ। হে পর্বতী দেবীর পুত্র তোমাকে সতত প্রণাম করি।

ekhansangbad
Author: ekhansangbad

Related News

Also Read