Select Language

[gtranslate]
২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ শুক্রবার ১৮ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

।। প্রথম আলো ।।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় :- একজন পরমহংস শ্যামপুকুরে এসে রয়েছেন, তাকে দেখার আকাঙ্খায় বহু লোক ছুটে আসে। সকলকে আটকানো যায় না। একেবারে অপরিচিতদের দরজা থেকে ফিরিয়ে দেওয়া গেলেও ভক্তদের পরিচিত ব্যক্তিরা সঙ্গে আসে, তাদের মুখের ওপর বলা যায় না কিছু।

একদিন কালী ঘোষ তার এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে এল। বন্ধুটি নিখুঁত বিলাতি পোশাক পরা, মাথায় টুপি, চোখে রিমলেস চশমা। পাহারাদার নিরঞ্জন ওদের আটকে দিল। কালী ঘোষ বলল, তার বন্ধুটি পশ্চিমদেশে থাকে, মাত্র কয়েক দিনের জন্য এসেছে। একবার রামকৃষ্ণকে দর্শন করে যাবে। নিরঞ্জন তবু রাজি নয়। তর্ক শুরু করে দিল কালী ঘোষ। সাহেবি কেতায় বন্ধুটি গম্ভীর মুখে তাকিয়ে রইল অন্যদিকে, যেন এসব তর্কে তার কিছু আসে যায় না। কেউ তাকে কোথাও আটকাতে পারে না।

শেষ পর্যন্ত নিরঞ্জনকে নরম হতেই হল।

ভেতরে এসে কালীর বন্ধুটি চোখ থেকে খুলে ফেলল চশমা। মাথা থেকে টুপি সরাতেই বেরিয়ে পড়ল গুচ্ছ গুচ্ছ কোঁকড়া চুল, আর্তবিলাপের স্বরে সে বলে উঠল, প্রভু, অপরাধ নেবেন না, আপনাকে শুধু একবার চোখের দেখা দেখতে এসেছি !

স্বর শুনেই চিনতে পারলেন। এ তো অভিনেত্রী বিনোদিনী দাসী।



সেই চৈতন্য লীলা দেখার পর থিয়েটার দেখার নেশা লেগে গিয়েছিল রামকৃষ্ণের। ‘প্ৰহ্লাদ চরিত্র’, ‘বিম্বমঙ্গল’ পালা দেখেছেন, অসুস্থ হয়ে পড়ার আগে পর্যন্ত বেশ কয়েক বার গেছেন, গ্ৰীনিরুমে বিনোদিনী ও অন্যান্য নটী-নটীদের আশীৰ্বাদ করেছেন।

রামকৃষ্ণের অসুস্থতার খবর পেয়ে বিনোদিনী ছটফট করছিল। সেই প্রথম দর্শনের দিন থেকেই বিনোদিনী এঁকে মহাপুরুষ বলে জেনেছে। রামকৃষ্ণের করুণাঘন চোখদুটি দেখার জন্য সে ছটফট করে। আজকাল প্রায়ই মনে হয়, তার অভিনেত্রী-জীবন শেষ হয়ে আসছে।

বিনোদিনী ছদ্মবেশ ধরে আসার ব্যাপারটা দেখে রামকৃষ্ণ রাগ করার বদলে খুব মজা পেলেন, খল খল করে হাসতে লাগলেন তিনি। এ মেয়ে সাহেব সেজে অন্যদের চোখে ধুলো দিয়েছে। এ কী কম কথা ! একে বলে টান !

রামকৃষ্ণ হাসছেন, আর তাঁর রোগ-জর্জর শীর্ণ শরীর দেখে অনবরত কাঁদছে বিনোদিনী। সে বারবণিতা, এমন একজন সাধক পুরুষকে স্পর্শ করার অধিকার তার নেই, দূর থেকে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্ৰণাম জানাতে হয়। কিন্তু একবার কি সে ওই শ্ৰীচরণে মাথা ছোঁয়াতে পারবে না ?

রামকৃষ্ণ পা বাড়ালেন, বিনোদিনীর চোখের জলে সেই পা ভিজে গেল।

বিনোদিনী ফিরল একলা। গিরিশবাবুকেও না জানিয়ে সে এসেছে, জানতে পারলে গিরিশচন্দ্র রাগ করবেন। বিনোদিনী সে রাগ সহ্য করতেও রাজি আছে, তাকে আসতেই হতো।

ঘোড়ার গাড়িতে বসে একটা ছোট আয়না বার করে মুখ দেখতে লাগল বিনোদিনী। তার কান্না এখনও থামছে না। মুখে রঙ মেখে সে সেজে এসেছে, থুতনির কাছটা ঘষতে লাগল বারবার। রঙ ওঠার পর সেখানে বেরিয়ে পড়ল একটা সাদা দাগ। কুষ্ঠ বা স্বেতী ? কোন পাপে তার এমন হল ? গুরুর কৃপায় এ দাগ মুছে যাবে না ? না যদি যায়, এ দাগ ক্রমশ ছড়ায়, তা হলে আর মঞ্চে নামবে না সে, এ কালামুখ দর্শকদের দেখাবে না। দর্শকদের হৃদয়ের রাণী ছিল সে, সেই ভাবেই বিদায় নিয়ে চলে যাবে।

ekhansangbad
Author: ekhansangbad

Related News

Also Read