Select Language

[gtranslate]
২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ শুক্রবার ১৮ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

।। টান ।।

মিতা ঘোষ :- অনুরূপা ও সুনন্দ একই টিচারের কাছে গান শিখত। সেই সুবাদে তাদের মায়েদের মধ্যে একটা সুমধুর বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাই তারা ছোট থেকেই একে অপরের বাড়িতে অবাধে যাতায়াত করত। দুজনে একইসঙ্গে খেলাধুলা করত, খুনসুটি করত, এইভাবে তারা পরস্পরের সঙ্গে বড় হয়ে ওঠে।

খুবই কম বয়সে অনুরূপার বাবা মারা যান। অনুরুপার মা মীরা দেবী একটি প্রাইমারি স্কুলে চাকরি করতেন। তাই ভালো না চললেও মোটামুটি চলে যেত মা মেয়ের সংসার। সুনন্দের বাবা-মা, ভাই, বোন প্রত্যেকেই অনুরূপাকে প্রচন্ড ভালবাসতেন। সুনন্দ পড়াশোনা শেষ করে ব্যাংকে চাকরি পাওয়ার পর, ওর বাবা-মা অনুরূপাকে গৃহ লক্ষী করে বাড়িতে নিয়ে আসেন। সুনন্দ ও সুনন্দের ভাই, বাবা ভালো চাকরি করায় অনুরূপার সংসারটা সবাইকে নিয়ে বেশ মসৃণ ভাবে হেসে খেলে চলতে লাগলো। এত প্রাচুর্য ও স্বাচ্ছন্দের জৌলুষ ছাপিয়ে যেতে পারেনি অনুরূপার সরল সিধে সদ্য প্রস্ফুটিত সুন্দর রঙিন মনকে।

সুনন্দ অফিস থেকে বাড়ি ফিরলেই অনুরূপা তার ঠোঁটের কোণে সুমধুর দুষ্টু হাসির রেখা টেনে ওর জন্য জল খাবার নিয়ে যেত। তখন সুনন্দ অনুর সেই হাস্যময়ী, প্রাণ চঞ্চল মিষ্টি মুখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো। অনুরূপা স্বলজ্জভাবে বলতো “কি হলো?? এভাবে কি দেখছো??” ” দেখছি তোমার সরলতাকে! কত সহজে তুমি একার হাতে সংসারের সবার চাহিদা হাসিমুখে পূর্ণ করছো।। সত্যি আমি ভাগ্য করে তোমার মত স্ত্রী পেয়েছি।”এইসব মনোমুগ্ধকর কথা শুনে অনু রামধনুর সাতটি রং ও মনের তুলি দিয়ে নিজের ভাবনায় সুন্দর একটি ভালোবাসার নীড় গড়ে তুলল। সেই অপরূপ সুন্দর নীড়ে তারা দুজন একে অপরের পরিপূরক হয়ে সুখের অমৃত সাগরে ভাসতে লাগলো।

সুনন্দ ও অনুরুপার আজ ভীষণ খুশির দিন কারণ অনুরূপার কোল আলো করে আসবে তাদের ভালোবাসার সন্তান। তাই তারা সকাল সকাল রেডি হয়ে, বাড়ির বড়দের আশীর্বাদ নিয়ে নার্সিংহোমে গিয়ে ভর্তি হল। ওটি রুমে যাওয়ার আগে সুনন্দ অনুরূপার কপালে একটি গভীর ভালোবাসার চুম্বনের আলপনা এঁকে দিয়ে অশ্রু সজল চোখে বলল “অনু, আমি তোমার জন্য বাইরে অপেক্ষা করে থাকব । ভালোভাবে ফিরে এসো।” অনুরুপা ঠোঁটের কোণে সুমধুর দুষ্টু হাসির রেখা টেনে বলল, “আসবো গো আসবো!! আমি তোমাকে ছাড়া থাকতেই পারবো না ।” অনুরুপাকে ওটিতে নিয়ে যাওয়ার পর সুনন্দ টেনশানে অস্থির হয়ে উঠলো। তার মনের মধ্যে একটা অজানা ভয়ের সঞ্চার হতে ই সে শিউড়ে উঠলো। হঠাৎ কেন যেন তার মনে কু চিন্তার উদয় হলো । তাই তার হৃদয়, যন্ত্রণায় ভেঙে-চুরে দুমড়ে -মুছড়ে মিশে যেতে লাগলো। সে অস্থির চিত্তে পায়চারি করতে লাগলো

ওটির দরজা খুলে ডাক্তার বাবু বের হতেই সুনন্দ দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল “আমার অনু কেমন আছে??”
তিনি মাথা নিচু করে বললেন “আই এম সরি।” সুনন্দ চিৎকার করে বলল “না….!! না…..!! এটা হতেই পারে না!! অনু কখনোই আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারে না!!”ডাক্তার বাবু বললেন”মিস্টার রায়, আপনি একটু শান্ত হন”। এরমধ্যে নার্স একটি ফুটফুটে শিশুকে এনে সুনন্দকে বললেন “এই দেখুন আপনার মেয়ে”। কিন্তু সুনন্দ তার দিকে একবারও ফিরে না তাকিয়ে গভীর শোকে পাগলের মত বাইরে বেরিয়ে এলো। অনুরুপার মা মীরা দেবী ধীরে ধীরে শিশুটিকে কোলে তুলে নিয়ে মনে মনে বললেন,” জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই তোর লড়াই শুরু হয়ে গেল রে সোনা । আজ যে তুই কি হারালি সেটা তুই নিজেও বুঝতে পারলি না।” তারপর গভীর স্নেহে নাতনিকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে লাগলেন।


সুনন্দ অনুরুপার অন্তিম ক্রিয়া সম্পন্ন করে বাড়িতে ঢুকতেই তার হৃদয় হাহাকার করে উঠলো।বারবার চোখের সামনে অনুর মুখটা ভেসে উঠতেই তার মন ভেঙেচুরে, দুমড়ে মুছড়ে খান খান হয়ে যেতে লাগলো। অনু ছাড়া ঘরের শূন্যতায়, একাকীত্বতায় তার দম বন্ধ হয়ে আসলো। সে ঘর থেকে পালিয়ে বাঁচার জন্য দৌড়ে বাইরে আসতেই দেখলেন, শাশুড়ি মা তার নাতনিকে কোলে নিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।। সঙ্গে সঙ্গে সুনন্দ চোখ বন্ধ করে, চিৎকার করে বলল “ওই রাক্ষসী কে আমার সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে যান। আমি ওর মুখদর্শনও করতে চাই না। আজ ওর জন্যই আমার অনু আমাকে ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেছে।” মিরা দেবী এ কথা শুনে হৃদয়বিদারক যন্ত্রণায় সকলের চোখের আড়াল করতে নাতনিকে নিয়ে অন্য ঘরে চলে গেলেন। সুনন্দের মা বললেন “এটা তুই ঠিক করছিস না খোকা। ওই সদ্যোজাত শিশুটির কি অপরাধ!! একবারও ওর কথাটা ভেবে দেখেছিস? আজ ও কি হারালো?? তোর শাশুড়ি মা তার একমাত্র সন্তানকে চিরদিনের জন্য হারিয়েছেন, তার মানসিক অবস্থার কথাটা একবারও ভেবে দেখেছিস??

বিয়ের পর থেকে সে কোনদিনও অনুকে ছেড়ে থাকে নি। তাই একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা তার বুকের মধ্যে কুরে কুরে খেতে লাগলো। সেই জন্য নিজের অজান্তেই এলোমেলো পায়ে সে উন্মুক্ত ছাদে গিয়ে বসলো। যেখানে প্রায় প্রত্যেক জ্যোসনা রাত্রে অনু ওর হাতে হাত রেখে, কাঁধে মাথা রেখে সুখ দুঃখের গল্প করত। প্রকৃতির নিয়মে আজও জ্যোসনায় ধৌত হচ্ছে ধরণী। কিন্তু তার পাশে আজ অনু নেই, ভাবতেই তার দু’চোখ বেয়ে না বলা যন্ত্রণা গুলি অশ্রু বিন্দু হয়ে মুক্তার মত টপটপ করে ঝরে পড়তে লাগলো। ঠিক তখনই একটি হিম শীতল ঠান্ডা হাওয়া বয়ে গেল তার হাত, কাঁধও মুখের উপর দিয়ে। সে চমকে উঠে চোখ তুলে তাকাতেই দেখল “দুটি অশ্রু সজল সকরুন চোখ অপলক দৃষ্টিতে নিরবে তাকিয়ে আছে তার দিকে।” সে দৃষ্টি যেন তার বক্ষ ভেদ করে হৃদয় স্পর্শ করে বলছে “সুনন্দ আমি সবসময় তোমার সঙ্গেই আছি। আমাদের সন্তানকে তুমি অবহেলা করো না। ওকে মানুষের মত মানুষ কর।” সুনন্দ যেন নিজেকে নিজে বিশ্বাস করতে পারছে না। তাই চোখটাকে একটু রোগড়ে নিয়ে তারপর চারিদিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখে কেউ কোথাও নেই। সুনন্দ বুঝতে পারে অনুরূপার শোকে সে পাষাণ হৃদয়ের মতো কত বড় ভুল করে ফেলেছে। ওর আর অনুর ভালোবাসার শেষ স্মৃতি “সদ্যোজাত শিশুকন্যাকে” দূরে ঠেলে দিয়ে । যার জন্য অনু মরেও শান্তি পায়নি। সেদিন থেকে সুনন্দ কোনদিন ও মেয়ে সুকন্যা কে চোখের আড়াল করে নি।

এত অল্প বয়সে স্ত্রীবিয়োগ হওয়ায় বাড়ির সবাই, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব বারবার করে সুনন্দকে আবার বিবাহ করার জন্য পিড়াপিড়ি করতে লাগলেন। কিন্তু অনুরূপার মা মিরা দেবি সুনন্দকে বললেন “বাবা অনুরূপা আমার একমাত্র সন্তান ছিল। সে আমাকে ছেড়ে বহু দূরে না ফেরার দেশে চলে গেছে আর কখনো ফিরবে না। তুমিও যদি দ্বিতীয়বার বিবাহ করো, তাহলে পৃথিবীতে এই বিধবা মায়ের আপন বলে আর কেউ থাকবে না”। শাশুড়ি মায়ের করুন হৃদয় স্পর্শী কথাটা, সুনন্দের গহীন মনের মনিকোঠার দরজায় গিয়ে শত সহস্র করাঘাত করতে লাগলো। ফলে তার মনের অন্তরালে জমে থাকা সন্তান স্নেহ উদ্বেলিত হয়ে উঠলো। তাই সুনন্দ আর দ্বিতীয়বার বিবাহ করলেন না। সুনন্দের এই ত্যাগকে মীরা দেবী সব সময় শ্রদ্ধা করতেন আর মনে মনে ভাবতেন “পৃথিবীতে কিছু কিছু মানুষ আছেন যারা অন্যের ভালোর জন্য নিজেদেরকে উৎসর্গ করেন, তুমি তাদের মধ্যেই একজন । আমার জন্য তোমার এই ত্যাগ আমি কখনো ভুলবোনা বাবা।”
ছোট ভাইয়ের স্ত্রী প্রিয়াংকা ভীষণ ভালো মনের মেয়ে। সে সুকন্যাকে নিজের সন্তানের মত মানুষ করতে লাগলো। সুকন্যা হাসলে প্রিয়াঙ্কার হৃদয় মাতৃ হৃদয়ের মতই আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠতো। আবার কাঁদলে তার হৃদয় দুঃখে জর্জরিত হয়ে যেত। দিন দিন সুকন্যা বাড়ির সকলের চোখের মনি হয়ে উঠলো। প্রিয়াঙ্কার ছেলে ও দিদি অন্ত প্রাণ। সুকন্যা কে দেখতে যেমন সুন্দর ছিল তেমনি ছিল তার মিষ্টি ব্যবহার। দুই ভাই বোন মহানন্দে হেসে খেলে বড় হয়ে উঠলো।

সুকন্যা বরাবরই পড়াশোনায় বেশ ভালো ছিল। তাই পড়াশোনা শেষ করেই একটা কলেজের প্রফেসারী পেয়ে গেল। তারপর বাড়ির বড়রা সম্বন্ধ করে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার রাজ রায় চৌধুরীর সঙ্গে সুকন্যার বিবাহ দিলেন। ওর বিয়ের পরে বাড়ির সকলে যেন প্রাণহীন হয়ে পড়ল। ওর কাকিমা ও দিদা বিয়ের কিছুদিন পরেই বলতে শুরু করল “এবার একটা সন্তান নে”। তাকে নিয়েই আমরা তোর শূন্যতাকে পূর্ণ করতে চাই। অবশেষে উপেক্ষিত সেই আনন্দের দিনটি এলো। কিন্তু সুনন্দ শত চেষ্টা করেও যেন আনন্দ করতে পারছে না। কারণ মেয়ের ডেট যতই এগিয়ে আসছে তার মানসিক যন্ত্রণা ও ভয় ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সুকন্যাকে ওটি রুমে নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সুনন্দের সেই দুর্বিষহ মর্মান্তিক দিনটির কথা মনে পড়ে গেল।। সে যেন এক দুঃস্বপ্ন!! যা ২৫ বছর ধরে সুনন্দকে দিবা রাত্রি তাড়া করে চলেছে। তাই এক অজানা ঝড়ের আশঙ্কায় সুনন্দের হৃদয় ছটফট করতে লাগলো। সে অস্থিরভাবে ওটির সামনে পায়চারি করতে থাকে। কিন্তু সুকন্যার দিদা মীরা দেবী নিশ্চল পাথরের মূর্তির মত এক কোণে চুপটি করে বসে রইলেন ,শুধু তার হৃদ স্পন্দন সশব্দে দ্রুতগতিতে চলতে লাগলো। অসম্ভব মানসিক যন্ত্রণায় তার দম বন্ধ হয়ে এলো। তবুও তিনি বাইরে কিছুই প্রকাশ করলেন না জামাইয়ের কথা চিন্তা করে। সুনন্দের জামাই রাজ টেনসনে ওটির সামনে চুপটি করে দাঁড়িয়ে প্রাণ পনে ঈশ্বরকে ডাকতে লাগল।

ওটির দরজা খুলতেই উৎকণ্ঠা নিয়ে সবাই একই সঙ্গে বলে উঠলো “সুকন্যা কেমন আছে??”ডাক্তার বাবু হাসতে হাসতে বললেন “ভালো আছে, চিন্তার কোন কারণ নেই।”সেই মুহূর্তে নার্স একটি সদ্যোজাত ফুটফুটে শিশু কে নিয়ে বাইরে এসে বললেন “এই দেখুন আপনাদের নতুন অতিথি। সুনন্দ দৌড়ে গিয়ে নাতনিকে কোলে নিয়ে ওর মুখের দিকে তাকাতেই চমকে উঠল!” এ কে…..!! এ যে অনুরূপার কার্বন কপি!!” মনে মনে এটা ভাবার সঙ্গে সঙ্গেই শিশুটি ওর দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের কোণে সুমধুর দুষ্টু হাসির রেখা টেনে যেন বলতে চাইল “তুমি আমাকে চিনতে পারছ না সুনন্দ …?? আমি তোমার অনু। শুধু তোমার জন্যই আবার ফিরে এসেছি …..।”

ekhansangbad
Author: ekhansangbad

Related News

Also Read