বাংলা ১২৬০ সালের ৮ই পৌষ (ইং- ১৮৫৩ সালের ২২শে ডিসেম্বর) বৃহস্পতিবার, পঞ্জিকা অনুসারে অগ্রহায়ণ কৃষ্ণা সপ্তমী তিথিতে এই বাংলার বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর মহকুমার অন্তর্গত প্রত্যন্ত গ্রাম জয়রামবাটীর এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ শ্রীযুক্ত রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সহধর্মিণী শ্যামাসুন্দরী দেবীর কোল আলো করে জগৎ জননী শ্রীশ্রীমা আবির্ভূতা হয়েছিলেন।
শ্রীশ্রীমায়ের পিতা শ্রীযুক্ত রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায় একদা স্বপ্নে মাতা লক্ষ্মীর দর্শন লাভ করেন। এক হেমাঙ্গী স্বর্ণ আভূষণ ভূষিতা বালিকাকে স্বপ্নে দেখেন। সেই অসামান্যা সুন্দরী বালিকাকে পরিচয় জিজ্ঞেস করতে সেই বালিকা তাঁর গলা জড়িয়ে বলেন – “এই আমি তোমার কাছে এলুম।” নিদ্রা ভঙ্গের পর শ্রী রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায় বুঝতে পারলেন – সেই বালিকা আর কেউ নয় – স্বয়ং ভগবতী।
শ্রীশ্রীমা স্বয়ং তাঁর জন্মকথা সম্বন্ধে অলৌকিক কাহিনী আছে তাহা তিনি নিজ মুখে ভক্তদের কাছে বলেছেন — “আমার মা (শ্যামাসুন্দরী দেবী) শিওড়ে ঠাকুর দেখতে গিয়েছিলেন৷ ফেরবার সময় হঠাৎ শৌচে যাবার ইচ্ছা হওয়ায় দেবালয়ের কাছে এক গাছতলায় যান৷ শৌচের কিছুই হলো না কিন্তু বোধ করলেন, একটা বায়ু যেন তাঁর উদর মধ্যে ঢোকায় উদর ভয়ানক ভারী হয়ে উঠল৷ বসেই আছেন৷ তখন মা দেখেন যে, লাল চেলী পড়া একটি পাঁচ-ছ বছরের অতি সুন্দরী মেয়ে গাছ থেকে নেমে তাঁর কাছে এসে কোমল বাহু দুটি দিয়ে পিঠের দিক থেকে তার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমি তোমার ঘরে এলাম, মা৷’ তখন মা অচৈতন্য হয়ে পড়েন৷ সকলে গিয়ে তাঁকে ধরাধরি করে নিয়ে এল৷ সেই মেয়েই মায়ের উদরে প্রবেশ করে, তা থেকেই আমার জন্ম৷ বাড়িতে ফিরে এসে মা এই ঘটনাটি বলেছিলেন’৷”
শ্রীযুক্ত রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায় বা শ্যামাসুন্দরী দেবী – কেউই মেয়ের নাম সারদা রাখেননি। তাঁরা রেখেছিলেন অন্য নাম – ক্ষেমঙ্করী।
কিভাবে ক্ষেমঙ্করী থেকে সারদায় পৌঁছল জীবন, সে কথাও নিজেই বলেছেন শ্রীশ্রীমা। “আমার মা আমার নাম রেখেছিলেন ক্ষেমঙ্করী। আমি হবার আগে, আমার যে মাসিমা এখানে (জয়রামবাটীতে) সেদিন এসেছিলেন, তাঁর একটি মেয়ে হয়। মাসিমা তার নাম রেখেছিলেন সারদা। সেই মেয়ে মারা যাবার পরেই আমি হই। মাসিমা আমার মাকে বলেন, দিদি, তোর মেয়ের নামটি বদলে সারদা রাখ; তাহলে আমি মনে করব আমার সারদাই তোর কাছে এসেছে এবং আমি ওকে দেখে ভুলে থাকব। তাইতে আমার মা আমার নাম সারদা রাখলেন।“
এই যে শ্রীশ্রীমায়ের নাম সারদা, যার সূত্রে পরবর্তীকালে ঠাকুর তাঁকে বললেন সরস্বতী, তার পিছনেও কাজ করছে ঐশ্বরিক অভিপ্রায়। শিহড়ে কীর্তনের আসরে পল্লীরমণীর কোলে বসা দুবছরের ছোট্ট মেয়ে সারদা দুখানি কচি হাত বাড়িয়ে চিনিয়ে দিলেন ভিড়ের মাঝে ছদ্মবেশী রাজা গদাইকে।
ঠাকুরকে ইষ্টপথে সাহায্য করতে এগিয়ে আসা শ্রীশ্রীমা সারদা দেবীকে ঠাকুর নিজেই লীলাসঙ্গিনীরূপে নির্বাচিত করেছিলেন। পাত্রী দেখা চলছে শুনে ঠাকুর বললেন, জয়রামবাটীর রামচন্দ্র মুখুজ্যের বাড়িতে পাত্রী তাঁর জন্য ‘কুটোবাঁধা’ হয়ে রয়েছে।
নির্দিষ্ট শুভ দিনে শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে বিবাহ হল সারদার। কিন্তু এ যেন শুধু বিবাহই নয়, নতুন এক সাধনার শুরু। পত্নীকে ত্যাগ করে এই সাধনা নয়, বরং এই সাধনা তাঁকে গ্রহণ করে। শুধু গ্রহণ করে নয়, মর্যাদা দিয়ে গ্রহণ করে। নিজের কাছে, নিজের পাশে রেখে এই সাধনা। তিনি বলেন, “এই যে শক্তি (শ্রীশ্রীমা সারদা দেবী) আমি সামনে রেখেছি, এর দ্বারাই সংসার বন্ধন মোচন করবো।”
একেবারে শুরুর দিকে, কামারপুকুরে তাঁর মুখ থেকে যখন অমৃতবাণী বর্ষিত হয়, ছোট্ট সারদা তখন অঘোরে ঘুমায়। পাড়ার মেয়েরা আক্ষেপ করে, “এমন কথাগুলি শুনলে না, ঘুমিয়ে পড়লে !” কিন্তু তিনি তাঁকে তুলতে বারণ করেন। বলেন,”না গো না, ওকে তুলো না। ওকি সাধে ঘুমোচ্ছে ? এসব কথা শুনলে আর এখানে থাকবে না – চোঁচাঁ দৌড় মারবে।”
একদিন নৌকা করে বালি হয়ে দুজনে দেশের বাড়ি যাচ্ছেন, শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন,” আমি জানি তুমি কে, কিন্তু এখন বলব না।”
দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুর শ্রীশ্রীমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কি গো, তুমি কি আমায় সংসারপথে টেনে নিতে এসেছ ?” স্বতঃস্ফূর্ত সরলতায় স্পষ্ট ভাষায় শ্রীশ্রীমা বললেন, “তা কেন, আমি তোমাকে সংসারপথে কেন টানতে যাব ? তোমার ইষ্টপথেই সাহায্য করতে এসেছি।”
দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের পদসংবাহন করতে করতে শ্রীশ্রীমা প্রশ্ন করলেন, “আমাকে তোমার কি বলিয়া বোধ হয় ?” ঠাকুরের সুস্পষ্ট ঘোষণা – “যে মা মন্দিরে আছেন তিনিই এই শরীরের জন্ম দিয়াছেন ও সম্প্রতি নহবতে বাস করিতেছেন এবং তিনিই এখন আমার পদসেবা করিতেছেন। সাক্ষাৎ আনন্দময়ীর রূপ বলিয়া তোমাকে সর্বদা সত্য সত্য দেখিতে পাই !”
তাই তো শিক্ষা দিয়ে প্রস্তুত করেন সহধর্মিণীকে। ষোড়শীরূপে পূজো করেন – উদ্বোধিত করেন তাঁর দেবীশক্তি। তিনি তো জানেন সারদাই সেই জগজ্জননী।
পূর্ণ মর্যাদায় তিনি তাঁকে দেবীর আসনে প্রতিষ্ঠিত করে সাধনার সঙ্গী করেছিলেন। তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথে শ্রীশ্রীমা সারদার দিক থেকে যে অতুলনীয় সাহায্য পেয়েছেন, সেকথা তিনি বারংবার মুক্তকন্ঠে স্বীকার করেছেন। জানিয়ে গিয়েছিলেন – তাঁর অবর্তমানে জগতের সহায় হবেন এই মা ! সারদা সরস্বতী।
বিশ্বজননী মা সারদা। একাধারে তিনি ঠাকুরের লীলাশক্তি, অপরধারে বিশ্বমাতা। মাতৃস্নেহে সকলকে তিনি নিজ মুখেই বলেছেন – “আমি সত্যিকারের মা; গুরুপত্নী নয়, পাতানো মা নয়, কথার কথা মা নয় – সত্য জননী।”
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও শ্রীশ্রীমা একই ভাবাগ্নির দুটি শিখা, একই শক্তিতরঙ্গের দুটি ধারা, একই সত্যের দূটি অবয়ব৷ আবার যেমন ব্রহ্ম ও তার শক্তি, অগ্নি ও তার দাহিকাশক্তি, তেমনই শ্রীরামকৃষ্ণ ও তাঁর শক্তি শ্রীশ্রীমা৷
ॐ যথাগ্নের্দাহিকা শক্তিঃ রামকৃষ্ণে স্থিতা হি যা।
সর্ববিদ্যাস্বরূপাং তাং সারদাং প্রণমাম্যহম॥