Select Language

[gtranslate]
২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ শুক্রবার ১৮ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

। । অবলম্বন ।।

অনিন্দিতা গুহ :- সেদিন এক মূহুর্তে অনামিকার জীবনে অভিশাপ নেমে এসেছিল।লোকটা প্রায় ধুমকেতুর মত অনামিকার জীবনে আছড়ে পড়েছিল। সেদিন এক অজানা কন্ঠস্বরে সাড়া দেওয়াই তার জীবনের কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল।কি জানি কোন অপরাধের শাস্তি তাকে তার জীবনের এতগুলো বছর নষ্ট করে দিল! আজও সেই স্মৃতি অনামিকার মনে দগদগে ঘায়ের মত জীবন্ত হয়ে রয়েছে।


সেই অভিশপ্ত দিনে অনামিকার অফিস থেকে বেরোতে একটু দেরি হয়ে যাওয়ায় রোজের আটটার ট্রেনটা মিস হয়ে গেল।এরপর ট্রেন ছিল একঘন্টা পর। হঠাৎ মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হল। বাড়িতে অসুস্থ বাবা ভালোভাবে হাঁটা চলা করতে পারেন না। কলেজের পড়াশোনা কোনোরকমে শেষ করে সবে তিন মাস হল সে নতুন চাকরিতে জয়েন করেছে।চোখে তার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন।বাবা মা-মরা মেয়েটাকে অনেক অভাব অনটনের মধ্যেও লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করেছেন।এখন সে একটু বাবাকে সুখের মুখ দেখাতে চায়। অনিন্দিতা গুহ
স্টেশনের বেন্ঞ্চে বসে সে এসব সাত পাঁচ চিন্তা করছিল।স্টেশন চত্বরে বেশী লোক ছিল না। হঠাৎ একটা অজানা কন্ঠস্বরে তার সম্বিৎ ফিরল।
“আচ্ছা নটার ট্রেনটা কি বেরিয়ে গেছে?”
অনামিকা অন্ধকারে লোকটিকে দেখতে পেল না। আন্দাজে উত্তর দিল,”না।”
“যাক বাবা বাঁচলাম”, বলে সে এগিয়ে এসে অনামিকার পাশে এসে বসল। এবার অনামিকা লোকটিকে ভালো করে একবার দেখল। আগন্তুক নিজের হাতে থাকা ফ্লাস্ক থেকে চা ☕ঢেলে অনামিকার দিকে এগিয়ে দিল। অনামিকা একটু ইতস্তত করল।তবে এই বৃষ্টিতে একটু চায়ের তলব লেগেছিল। লোকটা জোরাজোরি করতে সে চায়ের কাপটা নিল।
এর কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন চলে এল।দুজনে একই কামরায় উঠল। অদ্ভুত ভাবে সেদিন কামরায় ওরা দুজন ছাড়া আর কেউ ছিল না।লোকটা অনামিকাকে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কোথায় নামবেন? “
“শেষ স্টেশনে।”


অনামিকা উত্তর টুকু দিয়ে আর কোনো কথা বলল না।লোকটাও চুপ করে গেল।বেশ কয়েকটা স্টেশন পরে লোকটা কেমন যেন তাড়াহুড়ো করে নেমে গেল। অনামিকার ব্যাপারটা একটু অবাক লাগল।আর দুটো তিনটে স্টেশন পরে সেও নামবে।বাবা হয়তো খুব চিন্তা করছে। বাবাকে একটা ফোন কিনে দেবে এমাসের মাইনেটা পেলে।এখন একটা ফোন অনামিকার কাছে থাকে। অফিসের কাজে ফোন রাখতেই হয়।
একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। বৃষ্টিটা🌧️ একটু ধরেছে। হঠাৎ চোখে পড়ে একটা ব্যাগ।
“আরে এই ব্যাগটা তো সেই অপরিচিত লোকটার হাতে ছিল।সে বোধহয় ফেলে গেছে।ঠিক আছে আমি স্টেশনে নেমে স্টেশন মাস্টারের কাছে জমা দিয়ে দেব।”


গন্তব্যে ট্রেন থামতেই সে ব্যাগটা নিয়ে নামতে যাবে একদল রেল পুলিশ তাকে গ্রেফতার করল। অনামিকা কিছু বুঝে উঠতে পারল না।তারা ব্যাগ থেকে কিসব সাদা পাউডারের প্যাকেট বার করল। ওগুলো নাকি মাদক। অনামিকা অনেক করে পুলিশ কে বোঝানোর চেষ্টা করল যে এই ব্যাগটি তার নয় তার সাথে এই কামরায় একজন ভদ্রলোক ছিলেন। তিনি ব্যাগটি ফেলে গেছেন।তাই সে ব্যাগটা স্টেশন মাস্টারের কাছে জমা দিতে যাচ্ছিল।
একজন মহিলা পুলিশ তার হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে বলল,”চলুন ম্যাডাম জেলে গিয়ে এসব মনগড়া গল্প বলবেন।এখন চলুন।”
মাল সমেত সে হাতেনাতে ধরা পড়ল। কেউ তার কথা বিশ্বাস করল না। অনামিকার সাত বছরের কারাদণ্ড হল।মেয়ের জেলে যাওয়ার খবর শুনে তার বাবা শোকে অল্পদিনেই এ জগতের মায়া ত্যাগ করলেন।মারা যাওয়ার আগে একবার মেয়ের সাথে জেলে দেখা করতে এসেছিলেন। সেদিন অনামিকা তার বাবার চোখে তার প্রতি ঘৃণা প্রত্যক্ষ করেছিল।বাবা বলেছিলেন,”তুই আমার মুখাগ্নি করবি না।আজ থেকে তুই আমার কাছে মৃত। সারাজীবন এত কষ্ট করেছি তবু কোনো অসৎ কাজ করিনি।আর তুই আমার মুখে চুন কালি দিলি। “
অনামিকা অনেক কেঁদে বাবাকে বোঝানোর চেষ্টা করল যে সে নিরপরাধ। কিন্তু বাবা তার কোনো কথা না শুনে চলে গেলেন।এরপর আর বাবার সাথে তার দেখা হয়নি। এসেছিল তাঁর মৃত্যু সংবাদ। কিন্তু বাবার ইচ্ছা অনুযায়ী তার এক দুঃসম্পর্কের দাদা অনামিকার বাবার মুখাগ্নি করল। সেদিন অনামিকা বাবার শবদেহের সামনে কেঁদে কেঁদে বলেছিল,”পৃথিবীতে কেউ আমাকে বিশ্বাস করল না। এমনকি তুমি ও আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে!”
এরপর আরো পাঁচ বছর কাটল।জেলে থাকাকালীন ভালো আচরণের কারনে তার সাজার মেয়াদ কিছুটা কমিয়ে দেওয়া হল।জেলে থাকাকালীন কাজের পারিশ্রমিক বাবদ সামান্য কিছু টাকাও পেল।


জেলে বসে বসে অনামিকা ঠিক করে নিয়েছিল যে সে সেই শয়তান লোকটাকে ঠিক খুঁজে বার করে নিজেকে নিরপরাধী প্রমাণ করবে।
জেল থেকে ছাড়া পেয়ে সে হন্যে হয়ে লোকটাকে খুঁজতে লাগল‌ ।লোকটা সেদিন যে স্টেশনে নেমেছিল তার আশেপাশে ঘুরে বেড়াতে লাগল। কিন্তু এই বিরাট শহরে একটা নাম না জানা অপরিচিত একজনকে খুঁজে বের করা খড়ের গাদায় সূঁচ খোঁজার সামিল।
কিন্তু একদিন দৈবাৎ হতাশ হয়ে সে একটা পার্কের ধারে এসে বসেছিল।একটা ফুটফুটে বাচ্চার দিকে তার নজর যায়। বাচ্চাটিকে একা একা খেলতে দেখে এত দুঃখের মধ্যেও অনামিকার মনটা কিছুক্ষণের জন্যে কেমন যেন ফুরফুরে হয়ে গেল। হঠাৎ চোখে পড়ল বাচ্চাটি “বাবা” ” বাবা” বলে একটি লোকের দিকে ছুটে গেল। লোকটাকে দেখেই অনামিকার মাথায় আগুন 🔥 জ্বলে গেল।
সঙ্গে সঙ্গে সে নিজেকে সংবরণ করে নিল।”না এখন এত তাড়াহুড়ো করে লাভ নেই। লোকটা আমাকে দেখলে সাবধান হয়ে যাবে। তাছাড়া ও কখনোই নিজের মুখে অপরাধ স্বীকার করবে না।অন্য কিছু উপায় ভাবতে হবে।”


অনামিকা অতি সন্তর্পনে লোকটাকে অনুসরণ করল।লোকটা পার্কের থেকে ঢিল ছোঁড়া
দুরত্বে একটা গলিতে থাকে।
সেদিন সারারাত অনামিকার ঘুম এল না।এক অজানা দুশ্চিন্তা তাকে গ্রাস করল।
সে টানা কদিন লোকটাকে অনুসরণ করল।তারপর তার মাথায় একটা প্ল্যান এল।
লোকটি রোজ সকালে তার ছেলেকে স্কুলে ছাড়তে যেত। আবার ছুটি হলে আনতে যেত। একদিন অনামিকা দেখল ছেলেটা স্কুলের গেটের সামনে একা দাঁড়িয়ে। অনামিকা বলল যে সে বাচ্চাটির মাসি হয়। স্কুলের দারোয়ান বাচ্চাটিকে জিজ্ঞেস না করে অনামিকার হাতে বাচ্চাটিকে দিয়ে দিল। বাচ্চাটি একটা চকলেট দেখে খুব সহজেই অনামিকার কোলে চলে এল।ফলে কারো কোনো সন্দেহ হল না।


বাচ্চাটিকে সাথে নিয়ে সে নর্থ বেঙ্গল এর ট্রেনে উঠে পড়ল। তার আসল প্ল্যান ছিল বাচ্চাটির বাবাকে ব্ল্যাকমেল করে তার নিজের মুখে পুলিশের সামনে অপরাধ স্বীকার করাবে।আর সে নিজেকে কলঙ্কমুক্ত করবে।
বাচ্চাটি কিছুক্ষণ পর বাবার কাছে যাওয়ার জন্য বায়না ধরল। অনামিকা এর জন্যে আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল।সে একটা শরবতের সাথে হাল্কা ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে বাচ্চাটিকে খাইয়ে দিল। বাচ্চাটি সারারাত ঘুমিয়ে রইল।
সকালে নর্থবেঙ্গল পৌঁছে সে একটা ঘর ভাড়া নিল। ছোট বাচ্চা দেখিয়ে সহজেই সে থাকার একটা নিরাপদ বন্দোবস্ত করল।বাড়ির মালকিন বেশ দয়ালু। পাহাড়ের মানুষ মন খুব সরল।


বাচ্চাটি প্রথম প্রথম কান্নাকাটি করলেও খাওয়া দাওয়া পেয়ে কেমন যেন স্বাভাবিক হয়ে গেল। অনামিকা একটু ভয় পাচ্ছিল যদি কারো সন্দেহ হয়।সে বাচ্চাটিকে বাইরে বেশী আনত না ঘরেই রাখত।
এভাবে এক সপ্তাহ কাটল। এদিকে ওখানে হাওয়া কেমন জানা দরকার। অনামিকা বাচ্চাটিকে মালকিনের জিম্মায় রেখে নিজের শহরে ফিরল।
ছোট্ট বাচ্চা এখনও গুছিয়ে কথা বলতে পারে না।তাই সে মালকিনকে কিছু বলতে পারবে না। এটুকু ঝুঁকি নিতেই হল।

শহরে ফিরে লোকটার বাড়ির সামনে এসে দেখে লোকের ভিড় জমেছে। সামনে পুলিশ দাঁড়িয়ে। অনামিকা ভয় পেল।তবে কি লোকটা ছেলেকে খুঁজতে পুলিশ ডেকেছে?ডাকতেই পারে।এটাই তো স্বাভাবিক।সে তবুও সাহস করে মুখ লুকিয়ে ভিড়ের মধ্যে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখল লোকটা রক্তাক্ত অবস্থায় মরে পড়ে আছে।

দৃশ্যটা দেখে অনামিকার মাথায় আকাশ ☁️ ভেঙে পড়ল। তার নিরপরাধ হওয়ার একমাত্র সাক্ষীও আর রইল না।তাকে সারাজীবন অপরাধীর তকমা নিয়ে বাঁচতে হবে।সে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক মহিলাকে বলতে শুনল,”লোকটা খুব পাজি ছিল। সারাদিন নেশা ভান করে পড়ে থাকত।মা মরা ছোট বাচ্চাটাকে ঠিকমত খেতে পর্যন্ত দিত না।মারধোর করত। কদিন ধরে ছেলেটাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না।আমরা বললাম পুলিশে খবর দাও।কোনো উচ্চবাচ্য করল না।ছবি নিয়ে এক দুদিন নিজে খুঁজল।তারপর আবার যেই কে সেই।নেশা করে পড়ে থাকত‌।আজ সকালে এখানে শুয়ে ছিল গাড়ি এসে চাপা দিয়ে গেছে।আপদ ছিল একটা।”

অনামিকা সব শুনে তাড়াতাড়ি জায়গাটা ছেড়ে দিল।ট্রেনে চড়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভাড়া বাড়িতে ফিরল।এখন সে বাচ্চাটিকে নিয়ে কি করবে ভেবে পেল না। একবার ভাবল সে পুলিশের কাছে বাচ্চাটি কে দিয়ে আসবে। কিন্তু পুলিশ যদি তাকে আবার ফাঁসিয়ে দেয়!

এসব ভাবতে ভাবতে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কড়া নাড়ল। বাড়ির মালকিন দরজা খুলতে খুলতে আধো বাঙলা আধো হিন্দিতে বললেন,”আপনার বেটা তো সারাদিন মা মা বলে রো রাহা থা।”

বাচ্চাটি অনামিকাকে দেখে ছুট্টে এসে জড়িয়ে ধরল। বাচ্চাটির মমতা মাখা আলিঙ্গনে অনামিকার মনে চলতে থাকা দ্বিধা দ্বন্দ্ব এক লহমায় মুছে গেল। এতদিন পর্যন্ত যে ছিল তার চালের ঘুঁটি আজ সে তার জগৎ হয়ে উঠল।এই জগতে সহায় সম্বল হীন দুটি প্রাণ বেঁচে থাকার আশ্রয় খুঁজে পেল।সে ছেলেটার নাম রাখল সহায়।আজ থেকে সে হয়ে উঠল অনামিকার সহায়।


সৌজন্যে প্রতিলিপি

ekhansangbad
Author: ekhansangbad

Related News

Also Read