টুলু গাঙ্গুলী :- যে মানুষটা শ্বশুরবাড়ির সকলের জন্য প্রান পাত করে দেয়, গতরকে গতর বলে না শুধু সকলের খেয়াল রাখে-তার স্বামী বেহাত হয় কি করে? সেই মেয়েমানুষটা হল উমারানী-এ বাড়ির বড় বউ ৷
দেওর ননদ স্বামী শ্বশুর শাশুড়ি ভরা ভর্ত্তি সংসারে বউ হয়ে এল উমারানী ৷
এতটাই পরিশ্রম করতে পারতো যে বলার নয়। সকলের মুখের গোড়ায় সব জিনিস যোগান দিত ৷
বাড়ির সকলে উমার উপর এতটাই নির্ভরশীল হয়ে ওঠে যে বলার নয় ৷ কে বলে বড় বউমা- কে বলে বড় বউদি। সারা বাড়িতে শুধু একটাই ডাক ৷
বাড়ির সকলে পাড়া প্রতিবেশির কাছে খুব সুখ্যাতি করতো। এই যেমন বড় বউমা না হলে আমাদের চলবে না সে একাই একশো ইত্যাদি ইত্যাদি ৷
পাড়ার লোকের কাছেও খুব নাম কিনেছে এই উমা ৷ কে খেতে পায়না, কার রোগের ঔষধ, এসব সাহায্য সাধ্যমত করে।
তাছাড়া অতিথি আপ্যায়ন তো আছেই, বাড়িতে এলে কেউ শুধু মুখে ফেরৎ যায় না ৷ নিদেন পক্ষে এক কাপ চা দুটো বিস্কুট আছেই৷
উমা এ সংসারে এসে খুব খুশি।
আসলে ভালো নামের কাঙাল হল এই উমা ৷
সংসারে সকলের খেয়াল রাখতে রাখতে স্বামীকেই পাত্তা দেয়নি ৷ স্বামী সনৎ কোলকাতায় থাকে সপ্তাহে সপ্তাহে বাড়ি আসে। আপিসে চাকরি করে ৷
প্রথম প্রথম বিয়ের পর বছর খানেক স্বামীর খেয়াল রাখতো। তার পর মেয়ে হল, তার নাম রাখল পরী৷ এই পরীকে মানুষ করা তার মধ্যেই বাড়ির সব কাজ সামলানো ৷ বাচ্ছা হতে যা মাস খানেক বাপঘর কাটিয়ে ছিল অনেক কষ্টে ৷ এসেই কর্তাত্তী শুরু করে দেয় ৷
এখন সপ্তাহ পরে যখন সনৎ আসে মা নয় ছোটো বোন আসে সনৎ এর চা জল খাবার নিয়ে ৷
তখনকার দিনে সব বিকালবেলা দেখা যেত বাড়ির বউরা গা ধুয়ে চুল বেঁধে সেজে গুজে ফিটফাট হয়ে থাকতো৷ স্বামীরা দেখে খুশিই হত ৷
সনতের ভাগ্যে আর সেটা দেখা হয়ে ওঠেনি ৷সনৎ যখন আসে দেখে তার বউ নয় গরুকে খড় দিচ্ছে নয় শাশুড়ির চুল বাঁধছে। তার পর রাতের খাবারের জোগার হচ্ছে ৷
উমা শুধু আড়চোখে দেখে নিল – সনৎ বাড়ি ঢুকলো ৷
উমাকে ডাকে কিন্তু উমার আর পাত্তা নেই ৷ সে সংসারের কাজ সেরে শাশুড়ি শ্বশুরের সেবা করে, পায়ে তেল মালিশ করে তবেই স্বামীর কাছে আসে। কখনো মেয়ে উঠে পরে ৷
কখনো শাশুড়ি হাঁক দেয় ৷
স্বামী আদর করতে যায় যখন, তখন উমা গভীর ঘুমে কাদা ৷
এর আগে কতবার উমার জন্য ফল মিষ্টি এনে বাড়ির সকলকে লুকিয়ে সনৎ উমাকে দেয় । উমার তো আবার স্বামীর ভালোবাসা সহ্য হয় না ৷ সেগুলো বাড়ির সকলের মধ্যে ভাগ
করে দেয় ৷ সকলে এটাই জানে যে বড়বউ একা খেতে জানে না ৷
বছরে যা কাপড় সকলের সঙ্গে দেয় সেটা তো সনৎ উমাকে দেয়ই তার পরে আবার বছরে আলাদা মাঝে-সাজেই ভালো শাড়ি এনে দেয় ৷ সব স্বামীই চায় তার স্ত্রীকে ভালো রাখতে, খুশি দেখতে ৷
কিন্তু উমা সে বান্দাই নয়, বলে হাগো তুমি কিগো আমার একটা মাত্র ননদ আমি নতুন শাড়ি পড়লে সে দুঃখ পাবে তা ছাড়া মা-ই বা কি ভাববে ? তার থেকে বরঞ্চ তুমি মায়ের আর বোনের জন্য শাড়ি আনো তার পর পরবো ।
এখন দুই ভাই ও বোনেরও বিয়ে হয়ে গেছে ৷ উমার কাজ বেড়েছে বই কমেনি ৷
সনৎও একজন মানুষ কি করেই বা সব সময় বউ এর এত ভালো মানুষী মানবে ?
উমার যেন ভালো সাজার ঘোর লেগে গেছে ।
আজ পরীর বছর পাঁচেক বয়স হল ৷ এই পাঁচ বছরে বাপের বাড়ি যায় নি বললেই হয়। এর মধ্যে বার দুয়েক মায়ের অসুখে দেখতে আসে ৷
কিন্তু মায়ের মরনকালে মায়ের কাছে আসতে পারেনি ৷ সেই সময় শ্বশুরের পা ভেঙে যায় আবার তার উপর স্ট্রোক হয় ৷
আরও দুটো বউ ছিল তাদের উপর ওনার ভরসা হয় না ৷
যে মা পেটে ধরলো তার উপর কোনো দায়িত্ব পালন করলো না – ভাবা যায় !
আসলে লোকের যেমন মদ,মেয়েমানুষ, গাঁজা, চরস এসবের নেশা থাকে- উমার সেরকম নাম কেনার নেশা আছে ৷
এরকম ভাবেই চলতে থাকে ৷
এবার সনৎ ভাবে যাক বাবা আর নয় কোলকাতায় সে ঘর দেখেছে এবার মেয়ে বউকে নিয়ে রাখবে ৷ নিজের করে পাবে স্ত্রীকে মেয়েকে ৷ মেয়েকে সে ভালো করে মানুষ করবে ৷
সনৎ যখনই বাড়িতে কথাটা বলে যে ঘর ভাড়া করে চলে যাবে, যত না মা বাবা আপত্তি করে তার থেকে উমা বেশি আপত্তি করে ৷
উমা বলে এত দিনে তুমি এই বুঝলে আমায় ৷ আজ আমার দুই জা এসেছে তারা আমার ছোটো বোনের মত তারা সংসারের কি বোঝে ?
তাদের অল্প বয়স তারা এখন ঘুরবে ফিরবে আনন্দ করবে আর আমি কি না !
না না তুমি আমায় এ অনুরোধ
কোরো না ।
উমার উপর সংসারের সকলে চাল চেলে নেয় শুধু তাকে সকলে বাড়ে তুলে দেয় ৷ জায়েরা বলে আমার দিদিকে যেন মা-মা মনে হয় ৷
আজ দেওররা তাদের বউদের নিয়ে মাঝে মাঝেই হেথা হোথা বেড়াতে যায় ৷
সনৎ এখন মাসে একবার আসে কিনা সন্দেহ৷ যদিও কখনো সখনো আসে সংসারে খরচ-খরচা দিয়ে চলে যায় ৷
তাতেও উমার ভ্রূক্ষেপ নেই ৷
সংসারে উমা এখন সর্বেসর্বা ৷
শ্বশুর প্রায় মাস ছয়েক বিছানায় পরে ছিল তার পর মারা যায়। এই ছমাস উমা ছাড়া আর কেউ ধারে কাছে যায়নি শ্বশুরের । বলা ভালো উমা কাউকে ধারে কাছে ঘেঁষতে দেয়নি ৷
উমা সংসারে এমন একটা ভাব দেখায় যেন সে না থাকলে সংসার অচল হয়ে যাবে ৷ এমন কি জায়েদের ছেলে মেয়ে হোতে তাদের বাপের বাড়ি যেতে দেয়নি।
সব নিজে হাতে তাদের যত্নআত্তি করেছে ৷
সকলে ধন্য ধন্য করে বলে বউ হতে হয়তো এমন ৷ কোনো দিন নিজের সুখের কথা ভাবে নি ৷ সে সব শুনে উমা খুব আপ্পুত ৷
এদিকে নিজের মেয়েটা যে বড় হচ্ছে সেদিকে হুঁস নেই ৷
শুধু মেয়েকে বলবে গুরুজনরা যা বলবেন তাই শুনে চলবে ৷ সে মেয়ে মানবে কেন সেকি একটা পুতুল? গুরুজন মানেই সব তার কথা শুনে চলতে হবে ৷
একদিন বাঁশের মাচায় পরী বসে বসে পা দোলাতে দোলাতে একটা বড় পিয়ারা খাচ্ছিল ৷ একসঙ্গে মা ঠাকুমা বলে উঠলো মেয়েছেলে পরের ঘরে যেতে হবে অলুক্ষনের মত পা দোলাচ্ছিস? মা বললো তোর জ্ঞান নেই যে দুটো ছোটো ছোটো ভাই তাদেরকে ভাগ করে দিয়ে খাই- অমনি ভাইরা সব কোথায় ছিল দিদির পিয়ারা কেড়ে নিয়ে ছুটে পালালো ৷ পিয়ারার শোকে পরী মাটিতে শুয়ে কেঁদে গড়ানটি দিতে লাগল ৷ তাতে মায়ের মেয়েকে
ভোলানো চুলোয় গেল উল্টে বললো উঠে পর,তুই ওদের বড় দিদি তোকে অনেক সহ্য করতে হবে ৷ পরী বলে আমি সহ্য করবো না । ওই ভায়েদের আমি মাটিতে পুঁতে দেবো ৷
দুই জা পরীর উপর রেগে আগুন আর উমা এসে পরীর চুলের মুঠি ধরে যেখানে সেখানে চর থাপ্পর কষিয়ে দেয় বলে- বল একবার বাজে কথা তাহলে তোকে আমি এক্ষুনি গর্ত খুলে পুঁতে দেবো।
ছিঃ অমন মেয়ের মুখে
আগুন ৷
জায়েরা ধন্য ধন্য করতে লাগল ৷ উমা নাম যশের কাঙাল, বুকটা গর্বে ফুলে উঠলো তার ৷
সেদিন পরী এতটাই দুঃখ পেয়েছে যে বলার নয়। বাচ্ছা মেয়ে মাত্র এগারো-বারো বছর বয়স সবার অলক্ষে ঘরের আরকাটায় গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে ৷
যাহ্ সব শেষ!
– এই বয়েসের বাচ্ছারা খুব আবেগপ্রবন হয় ৷ এর আগেও অনেক বার এই ভাই বোনের ঝগড়াঝাটি হয় আর তার মা মেয়েকে খালি বলে তুই বড় ৷ একবারের জন্য ভাইদের কেউ দোষ ধরেনা তাদের কেউ বকাঝকা করেনা ৷ শুধু ভাইদের হয়ে বিশেষ করে পরীর মা খুব সাফাই গাইতো ।
এবার বোঝ কি তুই হারালি ?
জা দেওর শাশুড়ি তাদের কাছে কত নাম কিনলি ?
সব বাচ্ছা সমান নয়_ যে যেমন মানসিকতা নিয়ে মানুষ হয় সেটা মা বাবাকে বুঝতে হবে। বিশেষ করে মাকে ৷
পরী খুব অভিমানী সেটা তার অমুলক নয়। তার মা যদি তাকে না পাত্তা দেয় !
মাগী একবার বুঝলো না আজ আকাশ ফাটিয়ে কাঁদলেও পরী আর ফিরবে না ৷
মায়েদের অবহেলার জন্য এরকম ভাবে ফুলের মত বাচ্ছাদের অকালে প্রানটা চলে যাচ্ছে ৷
কার যে কখন কোন কথা মনে লাগে সেটা মায়েদের বুঝতে হবে ৷
পরীকে যদি তার মা রাতে যখন শোয় আদর যত্ন করতো আরও বেশি ভালোবাসতো, পরী যদি এটা জানতো তার মা তাকেই বেশী ভালোবাসে তা হলেও সে এরকম ভাবে মরতো না ৷ উমা যেদিন থেকে জায়েদের ছেলে হয়েছে তাদেরকে পাশে নিয়ে শুয়েছে আর পরী তার ঠাকুমার কাছে শুয়েছে ৷
এসব মেয়েমানুষ কবে আপন পর বুঝবে ? একটা কথা সবার জানা দরকার-একজন মানুষ সকলকে খুশি করতে পারে না। সকলের কাছে ভালো হওয়া যায় না ৷
সনৎ এর জন্য উমাকে দায়ী করে আর পরীর জন্য প্রচন্ড পরিমানে শোক পায় ৷ বলেছে আর জীবনেও এ বাড়ির চৌকাট মারাবে না ৷ এখোনো যতটুকু আসতো পরীর জন্য-আর না ৷
এখন উমার যা হাল! না ঘরকা না ঘাটকা!
লোকে বলে সন্তান শোক নিবারন হয় স্বামীর কাছে ৷ উমার সে
রাস্তাও বন্ধ ৷ তার স্বামী অনেক ধৈয্যবান পুরুষ কিন্তু আর ধৈয্য রাখতে পারলো না ৷
যে স্ত্রী স্বামীকে সঙ্গ দেয় না সে আবার কিসের স্ত্রী !
এখন এই বছর তিনেক হল তার অন্য মেয়ে মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক হয়েছে ৷
পরী মারা যাওয়ার মাসখানেক পর শাশুড়ি রোগে পরে ৷ উমা আর কাজ-কম্ম কিছু করেনা শুধু গুম হয়ে বসে থাকে ৷ এখন দুই জা সব বাধ্য হয়ে কাজ করে বঠে তবে খুব গজ গজ করে বিশেষ করে উমার উপর ৷
বলে চিরকাল শোক বুকে করে বসে থাকলে চলবে ৷ সংসারে কাজ নেই যত্তসব !
শাশুড়ি বলে ওকে তোমরা কিছু বোলোনা ৷
এ বাড়িতে উমার বলে আর কিছু রইলো না ৷
এবার উমা নিজের ঘরে একা থাকে পরীর স্মৃতি তাকে কুড়ে কুড়ে খায় ৷ আজ সে না কারো মা না কারো স্ত্রী না কারোর মেয়ে ৷
এমন মানুষও সংসারে থাকে যারা শুধু ভালো নাম কেনার জন্য স্বামী সন্তানকে কষ্ট দেয় আসলে তারা নিজেকেই ফাঁকি দেয় ৷
হ্যাঁ অবশ্যই সংসারের কাজ করতে হবে বইকি তবে তারও একটা নির্দিষ্ট গন্ডি আছে, অতি জিনিসটাই ক্ষতি ৷
একদিন সনৎ কে তার মা ডেকে পাঠালো ৷ সনৎ এল, মা বললো আমি আর বেশি দিন বাঁচবো না ৷ তুই বড় বউমাকে তোর কাছে নিয়ে যা ৷ আমি আর ওর কষ্ট দেখতে পাচ্ছিনা — ওই অভাগির বেটি নিজের সর্বনাশ নিজে করেছে ৷
সনৎ বললো মা তুমি আমায় ক্ষমা কর। ওর উপর থেকে আমার মন সরে গেছে ৷ দিনের পর দিন ওর থেকে আমি শুধু অবহেলাই
পেয়েছি ৷ অনেক চেষ্টা করেছিলাম মানিয়ে নেওয়ার ৷ ও পরীকেও মেরে ফেলেছে ৷
না না মা,তুমি আমায় এ অনুরোধ কোরো না ৷
ওকে যদি মেনে নিই দেবলার প্রতি আমার অবিচার করা হবে ৷
মা বললো তুই সত্যিই বিয়ে করেছিস?
বিয়ে করিনি, বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছি তোমার ওই বড় বউমার জন্য ৷ দেবলা খুব ভালো মেয়ে আমার জীবন সে ভরিয়ে দিয়েছে। শুধু একটাই দুঃখ পরীকে হারিয়ে !দেবলা আমায় বলে ছিল পরীকে আমাদের কাছে রাখবে ভালো স্কুলে ভর্তি করবে ৷ আমি কিছু দিনের মধ্যেই পরীকে এখান থেকে নিয়ে যেতাম ৷ পরী মা আমায় সে সুযোগ দিল না- বলতে বলতে সনৎ কেঁদে ফেললো I
মা তুমি ভেবো না আমি তোমার আর উমার দরুন মাসে মাসে খরচখরচা ভায়েদের হাতে দিয়ে যাবো আমার কর্তব্যে কোনো দিন অবহেলা করিনি আর
করবোও না ৷
সেই সময় দুই ভাইপো এসে বলে জেঠু দিদিকে নিয়ে এসোনা আমরা আর দিদির পিয়ারা কেড়ে খাবো না ৷
উমা সব শুনে হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকে ৷
সনতের উমাকে দেখে কিছু বলার আগে উমা শাশুড়িকে বলে মা আমি আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না ৷
উমাকে দেখে সনৎ এটাই ভাবলো উমার চেতনা হওয়ার নয় ৷
সনৎ চলে যাওয়ার আগে উমার উপর একটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হু বলে চলে গেল ৷
বছর খানেক বাদ হঠাৎ সনৎ রাত্রি বেলা উমাকে নিতে আসে বলে দেবলা আর বাঁচবে না সে মৃত্যুর আগে তোমায় দেখতে চেয়েছে আর আজ সকালে তার মেয়ে হয়েছে ৷ ডাক্তারবাবু জবাব
দিয়ে গেছে ৷ এখন তো মা বেঁচে নেই ৷
দেরি হয়ে যাবে উমা তুমি চল ৷
উমাকে দেবলা শুধু চোখ মেলে একবার দেখলো তার পর সব শেষ ৷
দেবলার মেয়েকে উমা কোলে নিয়ে বলে-আমার পরী ৷